বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ এগারো ভাই-বোনের মধ্যে সপ্তম। ছোটবেলায় ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। গড়নে লম্বা হওয়ায় গোলরক্ষকের পজিশনে খেলতেন। সিনেমারও পোকা ছিলেন। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন। হাই স্কুলে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। একসময় স্বপ্ন দেখতেন পুলিশ হবেন।
ইউরোপে যেতে চেয়েছিলেন
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৯৯৭ সালে। এরপর চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো দেশে যেতে। আবেদনও করলেন। কিন্তু স্কলারশিপ মিলল না। বললেন, ‘ছাত্র হিসেবে যে খুব ভালো ছিলাম তা নয়। তাই প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও ছিল।’
প্রকাশনা দিয়ে শুরু
যখন দেখলেন উন্নত দেশে যাওয়া সহজ হবে না, তখন প্রকাশনাশিল্পে মনোযোগ দিলেন। বেশ কয়েকটি গল্প ও কবিতার বইও প্রকাশ করেছিলেন নিজের শিমুল প্রকাশনী থেকে। একটা সময় দেখলেন, প্রকাশনীর হালে খুব একটা পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল। মাহবুবের মেজো ভাই আগে থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলেন। ভাবলেন, সেখানে যাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায়
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে পা রাখলেন সিউলের মাটিতে। ‘ঘড়িতে সন্ধ্যা ৮টা। চমৎকার আবহাওয়া আর পাহাড়ঘেরা পরিবেশ। মুগ্ধ হলাম।’ বললেন মাহবুব। তবে এই মুগ্ধতার রেশ কাটতেও বেশি সময় লাগেনি। কারণ পোশাক কারখানায় কাজের পরিবেশ। অস্বাস্থ্যকর, প্রচণ্ড শব্দ। ধুলাবালি, আগুনের উত্তাপ—কোনোটাই বাদ ছিল না। তাঁর ভাষায়, কাজের পরিবেশ ‘থ্রিডি’। মানে Darty, difficult & dangerous । বললেন, ‘প্রবাস কষ্টের জানতাম। কিন্তু এতটা হবে ভাবিনি। বাসস্থানের অবস্থাও তথৈবচ। দম ফেলার ফুরসত মিলত না। হাঁপিয়ে উঠতাম।’ তবে সহকর্মীদের সহায়তায় অল্পদিনেই কাজ রপ্ত করতে পেরেছিলেন।
দুর্ঘটনার শিকার হলেন
প্রথম সপ্তাহ দিনে এবং পরের সপ্তাহ রাতে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হতো। দিনে মানিয়ে নিলেও রাত জেগে কাজ করাটা ছিল কষ্টকর। এর মধ্যে এক দিন দুর্ঘটনার শিকার হলেন। টানা কয়েক মাস ভুগতে হয়েছিল। এর পর থেকে রাতে কাজ করতে ভয় লাগত। এক দিন কারখানার মালিককে গিয়ে বললেন, ‘রাতে নয়, দিনে কাজ করতে চাই।’ কিন্তু মালিক রাজি হননি। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে বছর দুয়েক কাজ চালিয়ে গেছেন। একসময় সেই কারখানার কাজ ছেড়ে দিলেন।
এবার আইনি লড়াইয়ে
চাকরি ছাড়ার পর মালিক পাওনা টাকা দিতে চাইছিল না। অনেক দেনদরবার চালিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। পরে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় আইনের আশ্রয় নিলেন। রায় মাহবুবের পক্ষে গেল। তখন থেকেই অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সমাধানের চিন্তা মাথায় আসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড, শ্রমসংক্রান্ত সভা-সেমিনারে অংশ নিতেন।
অন্যদের জন্য আন্দোলনে
২০০৪ সালের দিকে পুরোদমে প্রবাসী শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়লেন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে লাগলেন। যেসব শ্রমিক মালিকের কাছ থেকে পাওনা পাচ্ছিলেন না, তাঁদের বেতন আদায়ে সহায়তা করতেন। শ্রমিকদের কেউ অসুস্থ হলে কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁদেরও সহায়তা করতেন। বললেন, ‘শ্রমিকদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। এখানে এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করেন। কারখানা টু বাসা। নেই কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। তাই ছুটির দিনগুলোতে শ্রমিকদের নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যেতাম।’ এক পর্যায়ে অভিবাসী শ্রমিক ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। উপলব্ধি করলেন, আইনের পরিবর্তন না হলে অভিবাসীদের অধিকার আদায় অসম্ভব।
এবার গণমাধ্যম
অভিবাসীদের নিয়ে কোরিয়ান মিডিয়ায় যেসব অনুষ্ঠান বা খবর প্রচারিত হতো সেগুলো পছন্দ হতো না মাহবুবের! কারণ কী? ‘শুধু শ্রমিকদের অসহায়ত্ব কিংবা সরকারি প্রপাগান্ডা দেখানো হতো কনটেন্ট আকারে। অভিবাসীদের দুরবস্থার গভীরে না গিয়ে শুধু উপরিতলটায় দেখানো হতো।’ এক পর্যায়ে অভিবাসীদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে মাহবুব তথ্যচিত্র তৈরি করতে থাকেন। কোরিয়ার জাতীয় গণমাধ্যমে সেগুলো প্রচার করা হয়।
kalerkantho
অভিবাসী শ্রমিক টিভি
২০০৪ সালে নেপাল, মিয়ানমার, চীনসহ কয়েকটি দেশের অভিবাসীদের নিয়ে ‘অভিবাসী শ্রমিক টিভি’ (মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স টেলিভিশন) চালু করলেন। মাহবুব বললেন, ‘শ্রমিক আন্দোলনের গুরুত্ব থাকলেও সেটা ছিল খুব কষ্টকর, দীর্ঘ যাত্রা। টিভি চ্যানেলের চ্যালেঞ্জটা ছিল বেশ উপভোগ্য। কারণ সেখানে স্বাধীনভাবে আমাদের কথা বলতে পারতাম।’ প্রথমে কোরিয়ান ভাষার টক শো, প্রামাণ্যচিত্র এবং পরে বাংলা, ইংরেজি, কোরিয়ানসহ ১০টি ভাষায় খবর প্রচার করতে থাকেন। মাহবুব সংবাদ উপস্থাপন করতেন। অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। ২০০৬ সাল থেকে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করেন। এ আয়োজনের পরিচালক ছিলেন মাহবুব। তিন দিনের এই উৎসবে বিভিন্ন দেশের চমৎকার সব সিনেমা দেখানো হতো। তখন থেকেই কোরিয়ান মিডিয়া ফলাও করে এসব খবর প্রচার করতে থাকে।
এবার বড় পর্দায়
২০০৫ সালে এক দিন অভিবাসী শ্রমিক টিভির অফিসে একটা ফোন এলো। এক কোরিয়ান পরিচালক মাহবুবের কাছে জানতে চাইলেন তিনি অভিনয়ে আগ্রহী কি না? অভিবাসীদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েই শর্টফিল্মটির গল্প। শুনে রাজি হয়ে গেলেন মাহবুব। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিয়মিত বিভিন্ন সিনেমায় কাজ করতে লাগলেন। চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সও করলেন। মাহবুবের অভিনীত শর্টফিল্মটি সিউল চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয়। নাম ‘দ্য রোড অব দ্য রিভেঞ্জ।’ বললেন, ‘অভিনয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথম দিকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। রাত জেগে কাজ করেছি। তবে সিউল চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে।’
পুরস্কারও পেয়েছেন
মাহবুবের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বান্ধবী’। সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। তবে প্রথমে এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য নয়, মাহবুবের ডাক পড়ে চিত্রনাট্যের সঙ্গে অভিবাসীদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মিল আছে কি না, তা দেখার জন্য। পরিচালকের ইচ্ছা ছিল অভিবাসীদের মধ্য থেকেই একজনকে নায়ক করার। যিনি কোরিয়ান ভাষায় সাবলীল। তবে যাঁকেই আনা হচ্ছিল, পরিচালকের পছন্দ হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে মাহবুব বলে বসেন, ‘আমিই অভিনয় করতে চাই।’ তবে সিনেমাটির জন্য স্বল্প সময়ে প্রায় ১৩ কেজি ওজন কমাতে হয়েছিল তাঁকে। এ পর্যন্ত ১০টি সিনেমা, ৫৬টি নাটক এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। মাহবুব অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য সিটি অব ক্রেন’, ‘পারফেক্ট প্রপোজাল’, ‘মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, ‘হোয়ার ইজ রনি’, ‘ইউ আর মাই ভ্যাম্পায়ার’, ‘লাভ ইন কোরিয়া’ ইত্যাদি। ২০১২ সালে প্রথম অভিবাসী হিসেবে পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড (সেজং কালচারাল অ্যাওয়ার্ড)। উল্লেখ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের জন্য প্রতিবছর মোট পাঁচজনকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এখন সিনেমা পরিবেশনা করছেন
কোরিয়ান তরুণী লি মিয়ংকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। দুজনের বোঝাপড়াও বেশ ভালো। এখন কান ফেস্টিভালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো দক্ষিণ কোরিয়ায় পরিবেশন করছেন মাহবুব। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় চলচ্চিত্র তৈরি এবং পরিবেশনবিষয়ক এম অ্যান্ড এম ইন্টারন্যাশনাল কম্পানির সিইও। বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়ার পরিচালক হিসেবে এশিয়া চলচ্চিত্র উৎসব, বৈশাখী উৎসবসহ সিউলে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। জানালেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজ করার ইচ্ছা আছে।