ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হতাশ তিস্তাপারের মানুষ ‘তিস্তা বাঁচলেই হামরা বাঁচমো’

তিস্তাপারের মানুষ ভেবেছিল, ২০১১ সালের মতো এবার আর মমতা দিদি তাদের নিরাশ করবেন না। কিন্তু আশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ঝরেছে তাদের গলায়। ‘বন্যা ও মরুভূমি করি ভারত হামাক মারি ফেলবার চায়। দুঃখ একটাই—দ্যাশ স্বাধীনের ৪৬ বছর পার হইল; কিন্তু বাঁচি থাকতে তিস্তার পানি চুক্তি দেকি যাবার পাইনো না। ’ রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকার ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সালাম এভাবেই ক্ষোভের কথা জানান।

৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর ভেতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাজার বছর ধরে যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে রংপুর অঞ্চলের মানববসতি ও সভ্যতা, ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গান, সেই তিস্তা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে মরে যাচ্ছে। তার বুকজুড়ে জলের সেই খরস্রোত আর নেই। হিমালয়ের তুষার গলা পানি আর বৃষ্টিধারায় তিস্তার পানি যতই বেড়ে উঠুক, এখন তা ভারতের হাতে ‘বন্দি’। তিস্তার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। উজানে ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার প্রাকৃতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি বোরো আবাদের এ মৌসুমে নদীতে পানির অভাবে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলাধীন তিস্তা সড়ক সেতুর নিচে সামান্য পানি বালতি দিয়ে তুলে নদীর বুকে চাষ করা বোরোক্ষেতে পানি দিচ্ছিলেন পাশের ঢুষমারা চরের লোকমান আলী। কয়েক বছর ধরে এভাবেই কষ্ট করছেন তিনি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘কী করমো বাহে—হামার দুঃখ আর শ্যাষ হয় না। এমন করি কত দিন ভালো থাকা যায়!’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বোলে ভারত গেইচে? কই, এইবারও তো একটা সমাধান হইল না। জানেন তো তিস্তা বাঁচলেই হামরা বাঁচমো। ’

তিস্তায় পানি না থাকায় এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদ-নদী ও শাখা খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার জয়রামওঝা চরের বাসিন্দা দুলাল মিয়া জানান, আগে তাঁরা তিস্তার চরে গম, ভুট্টা, কাউন, চিনাবাদাম, আলুসহ রকমারি ফসল ফলাতেন। নদীর পানিতে সেচ সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ কম হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তাঁরা।

পানির অভাবে নদীর ভাটিতে তিস্তার ছোট-বড় শতাধিক খেয়াঘাট বন্ধসহ নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জয়রামওঝা এলাকার বাসিন্দা জয়নাল, মজিবর ঘাটিয়াল তাঁরা পেশায় সবাই মৎস্যজীবী। নিজেদের ভিটামাটি নেই। তাঁদের ভাষায়, গত এক মাস থেকে তাঁরা বলতে গেলে বেকার। নদীতে পানি না থাকায় মাছ মিলছে না। তাই তাঁরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। কাজের সন্ধানে ছুটছেন দক্ষিণাঞ্চলে ও ঢাকা শহরে।

বর্ষা মৌসুমে পাল্টে যায় তিস্তার রূপ। গভীরতা না থাকায় দুই কূল উপচে নদীপারে দেখা দেয় বন্যা। চোখের সামনেই বসতভিটাসহ ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তিস্তা। কিন্তু শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে নদীর তীরবর্তী এলাকায় সেচসংকটের পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপ কিংবা মাটির কুয়ায় শিগগিরই পানি মেলে না। পরিণতিতে চরাঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেয় এ সময়।

তিস্তাপারের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, কয়েক বছর ধরে তিস্তার বেহালে নানামুখী সমস্যায় পড়েছে নদীপারের মানুষ।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে আপত্তি জানিয়ে তাঁর সফর বাতিল করেছিলেন। এর পরও তিস্তা এবং সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে সময়। দুই দেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে সই হওয়া সীমান্ত চুক্তি এবং এর আওতায় ২০১১ সালের প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতীয় পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল আনার চেষ্টায় সে সময় বাদ সেধেছিলেন মমতা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে এসে মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময়ও তাঁর সফরে তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্তে সন্ত্রাস বন্ধ এবং ছিটমহল বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে বলে আশা করেছিল সবাই। এ কারণে ওই সময় তাঁর বাংলাদেশ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল তিস্তাপারের মানুষ।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

হতাশ তিস্তাপারের মানুষ ‘তিস্তা বাঁচলেই হামরা বাঁচমো’

আপডেট টাইম : ০৩:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৭

তিস্তাপারের মানুষ ভেবেছিল, ২০১১ সালের মতো এবার আর মমতা দিদি তাদের নিরাশ করবেন না। কিন্তু আশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ঝরেছে তাদের গলায়। ‘বন্যা ও মরুভূমি করি ভারত হামাক মারি ফেলবার চায়। দুঃখ একটাই—দ্যাশ স্বাধীনের ৪৬ বছর পার হইল; কিন্তু বাঁচি থাকতে তিস্তার পানি চুক্তি দেকি যাবার পাইনো না। ’ রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকার ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সালাম এভাবেই ক্ষোভের কথা জানান।

৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর ভেতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাজার বছর ধরে যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে রংপুর অঞ্চলের মানববসতি ও সভ্যতা, ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া গান, সেই তিস্তা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে মরে যাচ্ছে। তার বুকজুড়ে জলের সেই খরস্রোত আর নেই। হিমালয়ের তুষার গলা পানি আর বৃষ্টিধারায় তিস্তার পানি যতই বেড়ে উঠুক, এখন তা ভারতের হাতে ‘বন্দি’। তিস্তার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। উজানে ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার প্রাকৃতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি বোরো আবাদের এ মৌসুমে নদীতে পানির অভাবে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলাধীন তিস্তা সড়ক সেতুর নিচে সামান্য পানি বালতি দিয়ে তুলে নদীর বুকে চাষ করা বোরোক্ষেতে পানি দিচ্ছিলেন পাশের ঢুষমারা চরের লোকমান আলী। কয়েক বছর ধরে এভাবেই কষ্ট করছেন তিনি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘কী করমো বাহে—হামার দুঃখ আর শ্যাষ হয় না। এমন করি কত দিন ভালো থাকা যায়!’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বোলে ভারত গেইচে? কই, এইবারও তো একটা সমাধান হইল না। জানেন তো তিস্তা বাঁচলেই হামরা বাঁচমো। ’

তিস্তায় পানি না থাকায় এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদ-নদী ও শাখা খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার জয়রামওঝা চরের বাসিন্দা দুলাল মিয়া জানান, আগে তাঁরা তিস্তার চরে গম, ভুট্টা, কাউন, চিনাবাদাম, আলুসহ রকমারি ফসল ফলাতেন। নদীর পানিতে সেচ সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ কম হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তাঁরা।

পানির অভাবে নদীর ভাটিতে তিস্তার ছোট-বড় শতাধিক খেয়াঘাট বন্ধসহ নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জয়রামওঝা এলাকার বাসিন্দা জয়নাল, মজিবর ঘাটিয়াল তাঁরা পেশায় সবাই মৎস্যজীবী। নিজেদের ভিটামাটি নেই। তাঁদের ভাষায়, গত এক মাস থেকে তাঁরা বলতে গেলে বেকার। নদীতে পানি না থাকায় মাছ মিলছে না। তাই তাঁরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। কাজের সন্ধানে ছুটছেন দক্ষিণাঞ্চলে ও ঢাকা শহরে।

বর্ষা মৌসুমে পাল্টে যায় তিস্তার রূপ। গভীরতা না থাকায় দুই কূল উপচে নদীপারে দেখা দেয় বন্যা। চোখের সামনেই বসতভিটাসহ ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায় তিস্তা। কিন্তু শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে নদীর তীরবর্তী এলাকায় সেচসংকটের পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপ কিংবা মাটির কুয়ায় শিগগিরই পানি মেলে না। পরিণতিতে চরাঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেয় এ সময়।

তিস্তাপারের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, কয়েক বছর ধরে তিস্তার বেহালে নানামুখী সমস্যায় পড়েছে নদীপারের মানুষ।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে আপত্তি জানিয়ে তাঁর সফর বাতিল করেছিলেন। এর পরও তিস্তা এবং সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে সময়। দুই দেশের মধ্যে ১৯৭৪ সালে সই হওয়া সীমান্ত চুক্তি এবং এর আওতায় ২০১১ সালের প্রটোকল বাস্তবায়নে ভারতীয় পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল আনার চেষ্টায় সে সময় বাদ সেধেছিলেন মমতা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে এসে মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময়ও তাঁর সফরে তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্তে সন্ত্রাস বন্ধ এবং ছিটমহল বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে বলে আশা করেছিল সবাই। এ কারণে ওই সময় তাঁর বাংলাদেশ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল তিস্তাপারের মানুষ।