সারাজীবন ভারতে বসবাস করার পর গোকুল চন্দ্র সাহা গত সপ্তাহে ঘুম থেকে জেগে জানতে পারলেন সরকার তার নাগরিকত্বই বাতিল করে দিয়েছে। ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজ্য আসামের ১৯ লাখের বেশি লোককে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে তার নামও রয়েছে।
৬৮ বছর বয়সী গোকুল চন্দ্রের দাবি, তিনি ভারতের নাগরিক- সেই প্রমাণ তার আছে। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, এমন হাজারো ঘটনা আছে। যার মধ্যে গোকুল চন্দ্রের ঘটনাটি একটি। এতে আসামের নাগরিকত্ব নিবন্ধন (এনআরসি) চেষ্টায় ব্যাপক বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার মুসলমানদের বিতাড়িত করতেই এই নিবন্ধনের আয়োজন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে আশঙ্কা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ধর্মের বহু লোক এই ফাঁদে পড়ে গেছেন।
এটি মুসলমান কিংবা হিন্দু- যেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করা হোক না কেন, এটি বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ, আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত করে তুলেছে। অন্যায়ভাবে তাদের রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করায় ব্যাপক হতাশায় ভুগছেন অসমীয়রা।
আসামের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গোকুল চন্দ্রের দুই কন্যাও একই নথি ব্যবহার করেছেন এবং তারা নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, এই নিবন্ধনের কোথাও গোঁজামিল রয়েছে।
‘গত দুই সপ্তাহ ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না আমি। এটা হয়রানি,’ বললেন এই অসমীয়।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশী আসাম ভারতের সবচেয়ে দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্ন রাজ্য। সেখানকার তিন কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার ৩০ শতাংশ বাংলাভাষী।
আর দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক মুসলমান। বাকিরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আর জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অসমীয় ভাষীরা হিন্দু।
নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উত্তেজনা রাজ্যটিতে আগে থেকেই ছিল। ১৯৮৩ সালে সহিংসতায় দুই হাজারের বেশি বাংলাভাষী মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
সেই উত্তেজনায় একটা স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের চাপ বাড়ছিল। স্থানীয় হিন্দু নেতৃত্ববৃন্দ বলছেন, নাগরিকত্ব নিবন্ধনের মাধ্যমে সেই সমাধান আসবে।
১৯৭১ সালের আগে আসামে বসবাস করার প্রমাণ দিতে না পারলেই নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে।
যারা আসামে জন্ম নিয়েছেন, তাদের প্রমাণ করতে হবে ১৯৭১ সালের আগে তার দাদা কিংবা বাবা-মা আসামে ছিলেন।
বিভিন্ন দিক থেকে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে বিজেপি। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মুসলমান। নাগরিকত্ব নিবন্ধন থেকে বাতিলের প্রথম নিশানা হবেন তারা বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশজুড়েই এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া কার্যকর করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুসলমানদের উচ্ছেদ করতেই এটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে মানুষের আতঙ্ক বাড়ছে।
কিন্তু শনিবার যখন চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, গোকুল চন্দ্রের মতো বহু বাংলাভাষী হিন্দুকেও রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া আরও বহু পরিবারের সদস্যদের নাম তালিকায় ওঠেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই নথিপত্র দেয়ার পরও কারও নাম তালিকায় এসেছে, কেউ বাদ পড়েছেন।
লোকজনকে কীভাবে নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার জবাব নেই। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও বিভ্রান্তি তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে।
নয়াদিল্লিতে মোদি থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ নেতারা কোনো কথা বলছেন না। নাম প্রকাশে এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। মুসলমান ও হিন্দু- দুই সম্প্রদায়ের লোকজনই তালিকা থেকে বাদ গেছেন।
তবে তালিকায় নাম না ওঠা হিন্দুদের জন্য কিছুটা আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। কারণ তাদের প্রতি দেশটির ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের সমর্থন রয়েছে।
২০১৬ সালের রাজ্যসভার নির্বাচনে বাংলাভাষী হিন্দুরাও বিজেপির পেছনে জড়ো হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে স্থানীয় বিজেপি নেতারা চাপ দিচ্ছেন, যাতে ভোটের ঘাঁটি সুরক্ষায় একটি জরুরি আইনি সংশোধন পাস করা হয়।
এদিকে মুসলমানদের রক্ষায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কোনো আহ্বান আসছে না।
সৈয়দ বুরহান আহমেদ নামে এক অসমীয় বলেন, তাদের অন্যায়ভাবে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এএফপিকে তিনি বলেন, আমার ছেলে ও কন্যা আমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নথিপত্র ব্যবহার করেছে। কিন্তু এনআরসিতে আমার নাম ওঠেনি।
কথিত ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে তালিকা থেকে বাদ পড়া লোকজন আগামী ১২০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। সেখানে তারা ব্যর্থ হলে আদালতে যেতে পারবেন।
ভারত সরকার বলছে, তালিকায় নাম না ওঠা লোকজন রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে না। ভারতীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল রেখেই সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
কিন্তু সেখানে আতঙ্ক রয়েছে যে নিবন্ধন ব্যবস্থার মতো আপিলও হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে পড়তে পারে। সমালোচকরা বলছেন, ট্রাইব্যুনাল কর্মকর্তারা যোগ্য নয়।
বুরহান আহমেদ বলেন, কয়েক প্রজন্ম ধরে আসামে মুসলমানরা বাস করছেন। কয়েক শতক আগে এখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে আমাদের কাছে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে। কিন্তু তার পরেও এখানে সন্দেহ রয়েছে।