বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশের সমাজে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সামনে নাকি আইকন নেই, তারুণ্যের নাকি প্রতীকী চরিত্র নেই। আসলেই কি নেই? গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর ছেলে-মেয়েদের মুখে মুখে বিদেশী সব নাম। নেইমার, মেসি, রোনালদো, সালমান খান, শাহরুখ, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সিলোনাসহ নানা বিদেশী চরিত্র আর ঘটনার বাহাদুরিতে মনোজগতের রাজপথ, অলিগলি সয়লাব। আমাদের নিজস্ব কিছু নাই? ছিল এবং আছে, কিন্তু আমরা নিজেরটা কখনোই চিনতে পারিনি, কারণ আমাদেরকে জানতে দেয়া হয়নি। শেখ কামালকে ঠিকমত কয়জন চেনে বাংলাদেশে? আজ শেখ কামালের ৬৮তম জন্মদিন।
খুব বেশী দলীয় কিংবা রাজনীতি সচেতন না হলে শেখ কামাল ও তাঁর কীর্তি নিয়ে দেশের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ শেখ কামালকে কখনোই আমরা আমাদের টেলিভিশন, সংবাদপত্রে, ফেসবুকে সঠিক মর্যাদা আর মূল্যায়ন দিয়ে হাজির করিনি। যারা আবার শেখ কামালকে চেনেন, জানেন তারাও তাঁকে কয়জন ঠিকমত অনুসরণ করে? শেখ কামালের মত মানুষকে আমরা যদি অনুসরণ করতে পারতাম তাহলে সমাজ হত গতিশীল, জীবন হত শৈল্পিক আর বাংলাদেশ হত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। একজন তরুণ/তরুণীর জীবন কতখানি কর্মময় হতে পারে, নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনে তা করে দেখিয়েছেন শেখ কামাল।
২৩/২৪ বছর বয়সে আমরা কী করি? কেউ আমরা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি, কেউ মাস্টার্সে পড়ি, কিংবা সেশনজট না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গিয়ে চাকরির তালাশ করি। এখনো তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের বড় একটা অংশ সরকারি চাকুরে হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে প্রথম বর্ষ থেকেই যারপরনাই শামিল। সরকারি একটা চাকরি ম্যানেজ করতে পারলেই যেন জীবনের সব পাওয়া হয়ে গেল! আরেকদল ছেলে-মেয়ে বিদেশে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, যারা বিদেশ যেতে পারেনা তারা বাংলাদেশ বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করে । শুধুই নিজের উন্নতির চেষ্টা। কিন্তু শেখ কামাল ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ।
পরোপকারী মন থাকলে অল্প বয়সেই সমাজ-হিতৈষী কত কিছু করা যায় তার নজির সৃষ্টি করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামাল। মহাউজ্জ্বল চির তরুণ শেখ কামাল যে মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে মাসেই শাহাদাত বরণ করেছিলেন শেখ কামাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে শেখ কামালকেও হত্যা করেছিল খুনিরা। শেখ রাসেলের মত বাবুকেও ঘৃণ্য খুনিরা সেদিন রেহাই দেয়নি।
শেখ কামাল যদি এখন বেঁচে থাকতেন, তাহলে উনার বয়স হত ৬৭। শেখ কামাল বেঁচে থাকলে হয়ত আজ বাংলাদেশ ফুটবলে বিশ্বকাপ খেলত! হঠাৎ করে ফুটবল বিশ্বকাপের কথা বললাম, অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। হয়ত বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলত না, আবার খেলতই না, এটাও বলা যাবেনা। কারণ শেখ কামালের পক্ষে এটা অসম্ভব ছিলনা। তাহলে ফুটবল দিয়েই শুরু হোক শেখ কামালের কথা।
‘আবাহনী’ শব্দটা বিশ্বের কোনো বাঙালী যদি না শুনে থাকেন, তাহলে বিশাল লজ্জার ব্যাপার। এপার বাংলা, ওপার বাংলা তথা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসবাসরত সব বাঙালীর কানে এই শব্দ একবার হলেও গেছে বলে আমার বিশ্বাস। আবাহনী বাংলাদেশের একটি ফুটবল ক্লাবের নাম। এখনকার ছেলে-মেয়েরা যারা স্যাটেলাইট অথবা ইন্টারনেট শক্তির কল্যাণে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সার খেলা দেখতে নিশুতি রাতের ঘুম হারাম করেন, তাদের পক্ষে ৮০/৯০ এর দশকের আবাহনী ক্লাবের খেলার দিন দেশের পরিস্থিতির বিশেষত্ব বুঝে উঠা সম্ভব হবেনা। ঢাকা বলেন, গ্রাম বলেন সবখানে দেশের মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত। একদল আসমানি রঙের আবাহনীর পক্ষে, আরেকদল সাদা-কালো জার্সির ঐতিহ্যবাহী দল ‘মোহামেডান’ এর পক্ষে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার স্টেডিয়াম খা খা করলেও সে সময় আবাহনী-মোহামেডান খেলা হলে স্টেডিয়ামে জায়গা পাওয়া ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শেখ কামাল। খেলাধুলায় বিপ্লব করে সমাজ পরিবর্তন করার চেষ্টা করছিলেন শেখ কামাল। আজকে ফুটবলের দুরবস্থা দেখে দূর থেকেও নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাচ্ছেন শেখ কামাল। যদিও এই কষ্ট আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। ভুটানের সাথেও আমরা এখন ড্র করতে চাই, এতটাই নিচে নেমে গেছে আমাদের ফুটবল। একটি ক্লাব কীভাবে পুরো দেশকে ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্ব দিতে পারে তার উদাহরণ আবাহনী। ফুটবলে না পারুক, ক্রিকেটে কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম এক পরাশক্তি। দেশের ক্রিকেটে আবাহনী ক্লাবের অবদান ঐতিহাসিক।
লেখক হাসান শরীফ তার ‘পরের জন্মে মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই’ শীর্ষক লেখায় শেখ কামাল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শেখ কামাল ছিলেন প্রচন্ড ক্রীড়ানুরাগী। শাহীন স্কুলে পড়ার সময় স্কুল একাদশে নিয়মিত ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল খেলতেন। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে নিয়মিত খেলেছেন। দীর্ঘকায় শেখ কামালের সেই চমৎকার ‘বোলিং’ ছিলো চোখে পড়ার মতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ কামাল শুধু খেলোয়াড় হিসাবে নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করেন। বন্ধুদের নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় তৈরী করেন ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’। ফুটবল খেলায় তিনি শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা উপমহাদেশেই পশ্চিমা স্টাইলে বিপ্লব এনেছিলেন। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশী কোচ বিল হার্ট কে এনে ফুটবল প্রেমিকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! তখন ক্লাব তো দুরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশী কোচ ছিলোনা’।
স্বাধীন বাংলাদেশে বড় বড় লোকেরা ছেলে-মেয়ে মানুষ করবেন কীভাবে ভেবে পান না। স্বাধীনতার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে ব্যস্ত শেখ মুজিব জীবনে এক যুগেরও বেশী সময় জেলে কাটিয়ে কীভাবে সন্তান মানুষ করেছিলেন সেটিও কম বিস্ময়কর নয়। বড় ছেলেকে তিনি ছোটবেলায় ছায়ানটে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তাই সঙ্গীতের উপর শেখ কামালের দখল ছিল বেশ। উনার গলা বেশ ভালো ছিল। একবার এক ডকুমেন্টারিতে শেখ কামালের নিজের গলায় একটি গান শুনেছিলাম। শুধু গান গাইলেও উনি বাংলাদেশের বড় তারকা হয়ে বেঁচে থাকতেন আমাদের মাঝে, এ কথা বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবেনা। শেখ কামাল সঙ্গীতে কীরূপ পণ্ডিত উঠেছিলেন, তার একটা উদাহরণ দিই। তিনি নিজ দায়িত্বে ‘স্পন্দন’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি ব্যান্ডদল গঠন করেছিলেন। এ গানের দলের মাধ্যমে তিনি পল্লীগীতি আর আধুনিক নানা সঙ্গীত যন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করে দেশের সঙ্গীত জগতে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন।
খেলাধুলাকে জীবনের এতটাই অপরিহার্য অংশ মনে করতেন যে, যাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনিও ছিলেন একজন বড় খেলোয়াড়। দৌড়বিদ সুলতানা খুকি কে শেখ কামাল ১৯৭৫ সালের ১৪ই জুলাই বিয়ে করেছিলেন। এক মাসও ঘর-সংসার করা হয়নি তাদের। খুনিরা আর সবার সাথে নববধূ সুলতানা খুকিকেও হত্যা করে সে ভয়াল শেষ রাতে।
ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেছিলেন শেখ কামাল। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে শেখ কামাল কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এটাও আমাদের প্রজন্মের অনেকে জানেনা। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
শেখ কামাল নিয়ে এক লেখায় সব কথা বলা যাবেনা। ক্রীড়া, সঙ্গীত, রাজনীতি, সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তিনি সংক্ষিপ্ত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। শেখ কামালের মত তরুণের জীবনী আমাদের বর্তমান সময়ের অনেক দিশেহারা মানুষের পথ-প্রদর্শক হতে পারে। কিন্তু শেখ কামাল নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং এর অন্যান্য সহযোগী সংগঠনসমূহের তেমন উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনা। অন্যরা যখন শেখ কামাল নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালায় কিংবা সত্য প্রচারণা চালায়না, তখন আওয়ামীলীগের, ছাত্রলীগের কিংবা যুবলীগের উচিত এমন কিছু করা যাতে দেশের কোটি কোটি মানুষ শেখ কামালের উজ্জ্বল জীবনের ঘটনাগুলো জানতে পারেন।
কিন্তু আসলে কি কেউ কিছু করবে? আলোচনা সভা, মিলাদ, ফেসবুকে পোস্ট ইত্যাদি দিয়ে শেখ কামালকে হয়ত স্মরণ করা হবে। কিন্তু শেখ কামালকে নতুন প্রজন্ম ঠিকমত জানতে পারবেনা। শেখ কামালের উপর বিশ্বজয়ী চলচ্চিত্র হতে পারে কিংবা বানানো যায় ভালো কিছু ডকুমেন্টারি। আমাদের সাধ আছে, সাধ্য নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিংবা যুবলীগের যাদের অনেকেরই কোটি কোটি টাকা আছে, তারা তো একটু উদ্যোগ নিতেই পারেন। কিন্তু কাজের কাজ কেউ কিছু করবে বলে মনে হয়না। যে দেশে এখন পর্যন্ত জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বলার মত কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি, সে দেশে শেখ কামালকে নিয়ে কেউ বড় কিছু করবেন, তা আমার বিশ্বাস হয়না। নিজেদের আপনারা যত ভালোবাসেন, তা যদি বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ কামালদের বাসতেন তাহলে দেশের পরিস্থিতি এমন থাকেনা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।