বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের দেশ ও সমাজের জন্য আরো বেশি সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করার কথা বলছেন। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, অর্থ উপার্জন, ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য রাজনীতি করছেন না, তিনি দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি করছেন, কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার এসব কথা সবাই যে খুব ভালোভাবেই নিচ্ছেন, তা মনে হয় না। যারা শেখ হাসিনার আদর্শ ও রাজনীতি পছন্দ করেন না, তারা এসব কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। এটি তার কথার কথা হিসেবেই ভাবেন, বোঝেন এবং বলারও চেষ্টা করেন কেউ কেউ।
শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত লাভের জন্য যে রাজনীতি করেন না, সেটি একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ঢাকা শহরে তার পিতার ৩২ নম্বরের বাড়িটি তারা রাষ্ট্রের কাছে দান করে দিয়েছেন। তার স্বামীর সুধাসদনটি ছাড়া তার নিজের কোনো বাসভবন বা বাড়িঘর ঢাকা শহরে রয়েছে—এমনটি শোনা যায় না। অথচ তিনি প্রায় ষোলো বছর ধরে বাংলাদেশের সরকার প্রধান। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংসদ নেতা অথবা বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি ঢাকা শহরে একখন্ড জায়গা কেনার মতো উপার্জন করেছেন। তার পরও এ পর্যন্ত আমরা শুনিনি যে ঢাকার কোনো অভিজাত এলাকায় তার নিজের নামে কোনো জমি বা বাসাবাড়ি আছে। এটি প্রমাণ করে যে, তিনি ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিকে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করার বাইরে আলাদা করে কিছু দেখেননি, পাওয়ার চেষ্টাও করেননি।
তবে তিনি ইদানীং বলছেন, তার বয়স হয়েছে, অবসরে যেতে চান, অবসরটি তিনি টুঙ্গিপাড়াতেই কাটাতে চান। ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউই জানি না। তিনি হয়তো মনে করছেন, একসময় বয়সের কারণে তাকে অবসরে যেতে হবে। সেই সময়টি তিনি তার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়াতেই কাটাতে চান। সেখানে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারে অনেকেই সমাধিস্থ অবস্থায় আছেন। তিনিও হয়তো তার শেষ জীবন এবং মৃত্যুর পর সেখানেই থেকে যেতে চান। তার এ ভাবনাগুলোর সঙ্গে ঢাকা শহরে থাকা বা এখানেই বাকি জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগতভাবে তাকে এখনো সাদাসিধা জীবনযাপন করতেই দেখা যায়। মানুষের আপদে-বিপদে তিনি তার হাত উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব শেখ হাসিনার ব্যক্তিজীবনের বৈশিষ্ট্যের কথা সবারই জানা। এখানে নতুন করে কিছু বলার, ভিন্নভাবে ভাবার কিছু আছে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা জনগণের রাজনীতিতে আসার পর পিতার মতোই জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজনীতি করছেন। তার ব্যক্তিগত জীবনটা অনেকটাই বঙ্গবন্ধুর মতোই খোলামেলা, সহজ, উদার এবং সাদাসিধে। সবার কাছেই এটি খোলামেলা, তেমন কিছু গোপন আছে বলে মনে হয় না।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসে যা দিয়েছেন তার তালিকা যেমন বিশাল, তেমনি আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের পথচলায় একসময় নতুন করে মূল্যায়নের বিষয় হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষকরা যখন গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন; তখন তাকে একজন আত্মত্যাগী অনুসরণীয় রাজনীতির মানুষ ও নেতা হিসেবে খুঁজে পাবেন। আমি সেই বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। ভবিষ্যতের জন্য সেটি থাক। তবে আমার কাছে দলীয় রাজনীতির বাইরে একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে মনে হয় শেখ হাসিনা যে কথাগুলো তার দলের নেতাকর্মীদের জন্য প্রায়ই বলে থাকেন; সেগুলো অনুধাবন করা, পালন করার নেতা ও কর্মী কতটা আছেন, তা নিয়ে মাঝেমধ্যে আমার মধ্যেও দ্বিধা হয়। চারপাশে যখন তাকাই, তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা ইত্যাদির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনার ত্যাগের ছিটেফোঁটা প্রভাবও পড়তে দেখি না। এখন কেন যেন সব কিছুতেই বৈষয়িক লাভের বিষয়টি বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। আমি বলি না রাজনীতি করে নিজের সব কিছু উজাড় করে দেওয়ার প্রয়োজন খুব একটা পড়ে বলে মনে হয় না। নিজের যা আছে তা রেখে দেশ এবং জাতির জন্য কাজ করার মনোবৃত্তি এখন রাজনীতিতে যেন ভীষণভাবে কমে গেছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত আছেন—এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা খুব আবেগের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। এটি ভালো কথা যারা আওয়ামী লীগ করবেন তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নীতি ও পরিকল্পনা সফল করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন; এটিই তো আমাদের কাছে প্রত্যাশার বিষয়। তাদের দলীয় কাজকর্মের উদ্দেশ্যও তাই হওয়ার কথা। তা হলেই তো আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ে আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, জনগণের কাছে সমাদৃত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক উন্নতি, সমৃদ্ধ আওয়ামী লীগের আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটলে অবশ্যই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। কারণ আওয়ামী লীগ উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, বৈষম্যহীন অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে নীতি-আদর্শে প্রতিষ্ঠিত দল; যার ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু, বাস্তবায়নে হাল ধরেছেন শেখ হাসিনা।
সেই দল বাংলাদেশে রাজনীতিতে যত বেশি সফল হবে; বাংলাদেশে তত বেশি ওই সব আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটবে। এ বাস্তবায়নটি ঘটবে যদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলের ঘোষিত নীতি-আদর্শ, পরিকল্পনা মতো কাজ করেন। এর জন্য তৃণমূল থেকে ওপর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সততার সঙ্গে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা তো তাদের সম্মুখেই জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তারা কি শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করছেন? মনে হয় না। এ ছাড়া জনগণের সঙ্গে তাদের কজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে সেই মূল্যায়ন করার সুযোগ তো দলের মধ্যে দেখা যায় না। সবাই দলকে ব্যবহার করে কিছু একটা হতে চান। আবার দলে যারা যোগ্য আছেন কিংবা সৎ নিবেদিত আছেন, তাদের এগিয়ে দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রশাসনে তাদের কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা তাতে দল ও রাজনীতির স্বার্থের চাইতে ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতার সিঁড়ি স্থাপন করার উদ্যোগ-বাসনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এরা আসলেই এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে দলের গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেয়ে সাধারণ মানুষকে বিরূপ মনোভাবাপন্ন করতেই বেশি ভূমিকা রাখছেন।
লক্ষ করুন, ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের মাদরাসা কমিটি অধ্যক্ষের অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা, মাদরাসার অর্থ লোপাট ইত্যাদিতে যুক্ত থাকা, নিরপরাধ নুসরাতের হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ইত্যাদিতে যাদের ভূমিকা বলিষ্ঠ ছিল, তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বলে জানাজানি হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। এমন পরিস্থিতি শুধু ওই মাদরাসাকেন্দ্রিকই নয়; দেশব্যাপী অনেক জায়গাতেই কমবেশি রয়েছে। আসলেই এই মানুষগুলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার আদৌ যোগ্যতা রাখেন কি না, সেই প্রশ্ন কি কেউ করেন? তাদের কি সেই ধরনের লেখাপড়া আছে? কিংবা সমাজে ভালো চিন্তা করার মতো তাদের সুখ্যাতি আছে কি? আমার তো মনে হয় অনেক জায়গাতেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অনেকেরই সেটি নেই। অথচ তারাই দলের স্থানীয় পর্যায়ের পদ-পদবি দখল করে আছেন। এ রকম নেতাকর্মীর সংখ্যা খুব বেশি থাকতে হবে—এমনটি নয়। আওয়ামী লীগে সম্ভবত এখন এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে; যখন গ্রামেগঞ্জে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত, মার্জিত, দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েরা দলে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। এর ফলে আওয়ামী লীগে ভালো নেতাকর্মী তৈরি হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের কথা আমরা যা দেখি ও শুনি তাতে মনে হয় অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হতে এসে আদর্শের চর্চার ব্যবস্থাপনার অভাবে গতানুগতিক ধারাতে তারাও আদর্শ বিচ্যুত কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের প্রবণতা দূর করার উপায় হচ্ছে আওয়ামী লীগের দর্শন, রাজনীতি, কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা। রাজনীতি শুধু বক্তৃতা দেওয়ার জায়গা নয়, দলের আদর্শ জানা, বোঝা এবং এর প্রয়োগে নিজেকে সৎ, মেধাবী ও যোগ্য মানুষ হিসেবে যুক্ত করারও বিষয়। আমাদের রাজনীতিতে এখন আদর্শের চর্চা, চিন্তা ও মনন নেই, আছে শুধু প্রচার-প্রচারণা-বক্তৃতা।
বঙ্গবন্ধুর লেখা বই, পুস্তক, ড্রয়িং রুমে সাজিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক হিসেবে নিজেকে নেতাকর্মীদের কাছে প্রচার করা যেতে পারে কিংবা ড্রয়িং রুমে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি টাঙিয়ে দেখানো যেতে পারে, কিন্তু ধারণ করার বিষয়টি একেবারেই শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতির বিষয়; যা নিরন্তর নেতাকর্মীদের করতে হয়। বঙ্গবন্ধু এবং তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী রাজনীতিবিদরা, রাজনীতির লেখাপড়া কত ভালো জানতেন তা আমরা সে সময়ে দেখেছি, শেখ হাসিনাকে দেখছি তিনি প্রয়োজনীয় লেখাপড়া শত কাজের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তো লেখাপড়ার সেই চর্চা খুব বেশি দেখা যায় না। তাদের অনেককেই স্থানীয় পর্যায়ের অনেক অবৈধ কর্মকান্ডে যুক্ত হতে দেখা যায়। তা হলে শেখ হাসিনার বক্তব্য আদর্শ চর্চার আহ্বান, বঙ্গবন্ধুর নীতি ও দর্শনের বাস্তবায়নের সুযোগ কোথায়?
লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক