ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হঠাৎ একদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে

আফফান উসামা; গাণিতিক সূত্র মেলানো গেলেও গড়মিলের এই জীবনে এখন আর হিসেব মেলে না। দিনপঞ্জিকা গেছে অবসরে, সময় আটকে গেছে সপ্তাহের ছয়দিন আর শুক্রবারের মারপ্যাঁচে।

সপ্তাহের ছয়দিন থেকে শুক্রবারকে আলাদা করে বলার কারণ হলো এলার্ম ঘড়ি। আটটার অফিস ধরার তাড়া নাই জেনে সেদিন সেও নিশ্চুপ ঘুমিয়ে যায়। বড় কাছের হয়ে উঠে বিছানাটা। কী সুখ এই বিছানায়!

প্রতি সপ্তাহের একই নিয়ম আর একই গল্প। কখনও কোনো শুক্রবারের ‘বিয়ে’ নিয়ে আসে ভিন্ন উপলক্ষ্য। এইতো! সব কিছু মিলিয়ে শুক্রবারে একটুখানি ভালো থাকার কি প্রাণান্তকর চেষ্টা!

তবে এবারের শুক্রবারটা সাজাতে চেয়েছিলাম ভিন্নরূপে। ঠিক চেয়েছি বললে ভুল হবে, ফেসবুকে হঠাৎ সামনে আসা ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের একটা ইভেন্ট ভাবতে বাধ্য করে। হঠাৎ উড়তে ইচ্ছে করে ছুটতে দূর-দিগন্তে। ইচ্ছে করে ভবঘুরে হতে।

ইভেন্টের স্থান টাঙ্গুয়ার হাওর, রওনা দেয়ার সময় বৃহস্পতিবার রাত। সদ্যই জ্বর থেকে সেরে উঠা শরীরে হঠাৎ যেন শিহরণ খেলে গেল। যোগাযোগ করলাম তাদের সঙ্গে। যেতে পারব, তবে আসন সংখ্যা হাতেগোনা। তবুও সবার পেছনে।

মাত্র ৮ ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে প্রস্তুতি শুরু। চুল ছাঁটানো বাদে বোধহয় বাকি সবটাই পেরেছি। পেরেছি বন্ধু মিতুলকেও রাজি করাতে। অবশ্য রাজি না হয়ে কোথায় যাবে? জীবন যুদ্ধে সেও যে ক্লান্ত পথিক এখন। পরিবারের দায়িত্ব যে নিজেকে নিজের হতে দেয় না!

রাত দশটার পরই আমি মোটামুটি প্রস্তুত। অপেক্ষা কেবল মিতুলের। বেচারা ১১টায় বাসায় ফিরে কোনোরকমে দৌড়ে ১২টার বাস ধরতে বেরিয়েছে। অথচ গিয়ে শুনে, বাস ছাড়বে রাত একটায়। কপাল হয়তো একেই বলে!

কপাল আমাদের আসলেই মন্দ কিনা, তা পরীক্ষা করতে যাত্রাপথে বসে লটারিও কিনলাম। আর বাসের শেষের গণসিটে বসে গরম আর গতির সঙ্গে ‘নাচতে নাচতে’ ভোর চারটায় পৌঁছে গেলাম হাওর পাড়ে। যদিও মাঝে ঘুমানো হয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

বাসের মাঝেই পরিচয় হয়েছিল ‘মিলিওনিয়ার’ শাওন ভাইয়ের সঙ্গে। তার নামের সাথে তার কাজের তেমন মিল নাই। ফলে দুর্ভাগাদের সঙ্গে বাসের পেছনের সিটে ঠাঁই হয়েছিল তার। পুরো সফরজুড়ে এই ব্যাকবেঞ্চারদের থেকে আর তার মুক্তি মেলেনি।

তবে আমাদের থেকেও বড় দুর্ভাগা ছিলেন আরও এক ভাই, যিনি কিনা প্রেমিকার বিয়ের দুঃখ ভুলতে নাম দিয়েছিলেন ট্যুরে। অন্য সবার মতো তারে আমিও সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, ‘কেন যে মানুষ ছ্যাঁকা খেয়ে আত্মহত্যা করে?’

অবশ্য আত্মহত্যা না করে সবাই যদি এমন ছ্যাঁকা খেয়ে ট্যুর দিতো, বাসের শেষ সিটটাও অবশ্য আমাদের আর জুটতো না। তবে পৌষ মাস হতো ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের। এই শহরে প্রতি শুক্রবারে কতো শতো প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে হয় অন্য কারও সঙ্গে।

কথায় আছে– ‘সকালের সূর্য বলে দেয় দিনটা কেমন হবে।’ আমরাও তেমন হাওর ট্যুর কেমন হবে, তার আভাস পেয়ে গিয়েছিলাম ভোরের আলো ফুটতেই। রাতের মায়াবী চাঁদ আর সকালের সূর্য একসঙ্গেই হেসে উঠে হাওরে। প্রকৃতির কি অপরূপ দৃশ্য! সুবাহানাল্লাহ।

ভ্রমণের সময়টা যে উপভোগ্য হবে, তা যেমন বুঝেছিলাম; তেমনি সূর্য মামা সকালেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, দিনটা তার হতে চলেছে। ভোর পেরোতেই দেখা মেলে রোদ্দুরের, সময়ের সঙ্গে যা আরও প্রখর হতে শুরু করে। টইটম্বুর ভেজা কাপড় বিশ মিনিটেই শুকিয়ে যাওয়া তো সেই কথাই বলে।

শুক্রবারের সকালে সাতটার আগে নাস্তা! বিষয়টা কতটা বিস্ময়কর, অনেকের বিস্ফোরিত চোখই তা বলে দিচ্ছিল। জলে ভাসতে ভাসতে খিচুড়ি বিলাস, প্রেমিকা ছাড়া আর কতোটা জমে? বন্ধু মিতুলের অবশ্য অতো হিসেব-নিকেশ নেই। যা নেই, তা নিয়ে ভেবে কি হবে!

আড্ডাবাজি আর গলাবাজি করেই সকাল নয়টায় পৌঁছে গেলাম লাকমাছড়ায়। যেখানে পানি আর পাহাড়ের এমন বন্ধুত্ব যেন নিজের একাকিত্ব বাড়ায়! এমন জায়গায় একাকিত্বের দহন হয়তো আরও বাড়তো, যদি না বিবাহিত দম্পতিদের অবস্থা নিজের চোখে না দেখতাম!

নাতিশীতোষ্ণ শব্দটা আসলে কী এবং কেন, তা বুঝতে পেয়েছি লাকমাছড়ায়। আর এখানকার ছবির ভিউ এতো সুন্দর যে, আপনি ভিজবেন না ছবি তুলবেন, এই দ্বিধাতেই কয়েক ঘণ্টা সময় পার হয়ে যাবে।

লাকমাছড়া থেকে ফিরে ডুব দিলাম নীলাদ্রি লেকে। নীল জলে গা ভেজালাম দীর্ঘক্ষণ। লাকমাছড়া যেমন তৃপ্তি এনে দিয়েছিল মনের মাঝে, নীলাদ্রি লেকের ঠান্ডা পানি যেন প্রশান্তি এনে দেয় দেহে। মাঝে রুমান ভাইয়ের পরামর্শে পেটও ঠান্ডা হয় দেড় গ্লাস লেবু-শরবতে।

এদিকে, সূর্য যেন ধীরেধীরে আরও তপ্ত হতে শুরু করে। লেক থেকে উঠে বোটের কাছে যেতেই ভেজা কাপড় শুকিয়ে গা আবারও ঘামতে শুরু করে। আর বোটে পৌঁছে পায়ে যেন ফোস্কা পড়ে যাবার উপক্রম। ছাদ যেন রূপান্তর হয়েছে উত্তপ্ত কড়াইয়ে।

গরমের তীব্রতা থেকে মুক্তি পেতে বোট এবার ছুটলো ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। মাঝের সময়টা কেটে গেল ছবি তুলে, নানান খেলাধুলা আর গল্পগুজবে। ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছা মাত্রই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল, মনটা ভালো হয়ে উঠলো নিমিষেই।

এতো এতো মানুষের দাপাদাপিতে পানিটা যদিও হয়ে উঠে ঘোলাটে, তাতে কি আর আনন্দে ভাটা পড়ে? যে যেভাবে পেরেছে ভিজেছে, ভিজিয়েছে। নেচেছে, মেতেছে। নিজেকে যেন উৎসর্গ করে দিয়েছে পানির কাছে। পানিতে ভিজেই চায়ের কাপে চুমুক! অনুভূতিটা অনেকদিন মনে থাকবে।

মনে থাকবে বয়সে ছোট দুটি ‘আপু’র কথা। ভ্রমণ গল্পটা রঙিন করে তুলেছিল এই দুটো মেয়ে। রিয়া আর সিনথি। বিশেষ করে ভীষণ দুঃখ বুকে পোষা বাপ্পারাজ (ছদ্মনাম) ভাইকে দুজনে যেভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো, তা দেখে হাসি থামানো যেন দায়। অনেকদিন মনে থাকবে তাদের কথা।

অবশ্য মনে না রেখেও উপায় নাই। ‘মেয়াদহীন’ পাঁচটা লটারি এই দুজনেই ধরিয়ে দিয়েছিল আমাদের হাতে। নাহয় আমাদের যে ভাগ্য, একটা পুরস্কার তো পাবার কথাই ছিল। আমার মনে হয়, এরা ষড়যন্ত্র করেছে বিম্পির সাথে মিলে।

এরপর ক্ষুধার্ত পেটকে পরিতৃপ্ত করার পালা। গরম ভাপ ওঠা ভাতের সাথে হাওরের টাটকা মাছ আর সাথে হাসের ঝোল আর গরম ডাল। ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই খাবার যেন হয়ে উঠেছে অমৃতসম!

এরপর ফেরার পালা। তবে সেখানেই বিপত্তি। শেষ বেলায় আয়োজন করা হলো মুড়ি ভর্তার। একইসঙ্গে ঘোষণা করা হল, লটারির পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। আগেই বলেছি, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে। ফলে পুরস্কার তো পাইইনি, মুড়ি খাবার স্বাদটাও চলে গেছে।

তবে প্রকৃতি তো বটেই, ভ্রমণের সুখ সঙ্গী-সাথীতে। তাতে জুড়ি মেলা ভার। অনেকের নাম জানি, অনেকের জানি না। কারও সঙ্গে ভবিষ্যতে হয়তো দেখা হবে, হয়তো বা হবে না। তবে যে ভালোবাসা ফেরি করে গেছেন, তাদের মনে রাখতে সেটুকুই বাধ্য করবে।

যাহোক, প্রায় ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে অবশেষে ঘরে ফেরা রাত দশটার পরে। মাঝের সময়ে প্রকৃতির মুগ্ধতা ছাড়াও আর কি দেখেছি জানেন? ‘ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের’ আন্তরিকতা। ভ্রমণের বিঘ্নতা কাটিয়ে দিয়েছেন তারা ভালোবাসা দিয়ে।

কোনো তাড়াহুড়ো নেই, নিষেধ নেই। আছে সেবা, সবার খোঁজ রাখা। সহায়তা ও তথ্য দিয়ে উপকৃত করার মন্ত্রমুগ্ধতা। এরপর যখন আবার আপনার থালায় ভাত তুলে দেবেন, নিজেরা না খেয়ে আপনার প্রয়োজন পূর্ণ হয়েছে কিনা খোঁজ নেবেন; তাদের ‘ধন্যবাদ’ বলা ছাড়া আর কিইবা বলার থাকে!

ধন্যবাদ রুমান ভাই। ধন্যবাদ না থেকেও থাকা আমার ফকির নামের বড়লোক ভাইকে। কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য শিবলি আর তুষারেরও। ছোট হয়েও কতো সুন্দর করে আগলে রেখেছে বড় ভাইদের। ধন্যবাদ আপুদেরও। তবে খিচুড়ির বদলে বিরিয়ানি খাওয়া আর লটারি নিয়ে ষড়যন্ত্র করাটা মানতে পারলাম না।

সব শেষে বলি– সীমাবদ্ধতার এই জীবনে সবারই মনে এক সুপ্ত ইচ্ছে থাকে। কারও তা পূরণ হয় কোনো এককালে, কারওবা সুযোগ আর সামর্থ্যের বেড়াজালে স্বপ্নটাকে মাটিচাপা দিয়েই ছুটে চলতে হয় বাস্তবতার নিরিখে।

সেই সুপ্ত ইচ্ছেগুলোর কোনো একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকে ভ্রমণ! জাত-ধর্ম ঊর্ধে রেখে, শ্রেণি বিভেদ ভুলে প্রায় প্রতিটি মানুষের ইচ্ছেগুলো এই একটা জায়গায় এসে মিলে যায়, মিশে যায়; গান ধরে সমস্বরে।

টাঙ্গুয়ার হাওর, ১৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। জীবন ডায়েরিতে লিখে রাখলাম দিনটা। সাধ্য, সামর্থ্য, সুযোগ আর সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিঁড়ে এই দিনে চলে গিয়েছিলাম প্রকৃতির টানে, প্রভুর সৃষ্টির প্রেমে পড়তে।

 

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হঠাৎ একদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে

আপডেট টাইম : ০৫:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আফফান উসামা; গাণিতিক সূত্র মেলানো গেলেও গড়মিলের এই জীবনে এখন আর হিসেব মেলে না। দিনপঞ্জিকা গেছে অবসরে, সময় আটকে গেছে সপ্তাহের ছয়দিন আর শুক্রবারের মারপ্যাঁচে।

সপ্তাহের ছয়দিন থেকে শুক্রবারকে আলাদা করে বলার কারণ হলো এলার্ম ঘড়ি। আটটার অফিস ধরার তাড়া নাই জেনে সেদিন সেও নিশ্চুপ ঘুমিয়ে যায়। বড় কাছের হয়ে উঠে বিছানাটা। কী সুখ এই বিছানায়!

প্রতি সপ্তাহের একই নিয়ম আর একই গল্প। কখনও কোনো শুক্রবারের ‘বিয়ে’ নিয়ে আসে ভিন্ন উপলক্ষ্য। এইতো! সব কিছু মিলিয়ে শুক্রবারে একটুখানি ভালো থাকার কি প্রাণান্তকর চেষ্টা!

তবে এবারের শুক্রবারটা সাজাতে চেয়েছিলাম ভিন্নরূপে। ঠিক চেয়েছি বললে ভুল হবে, ফেসবুকে হঠাৎ সামনে আসা ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের একটা ইভেন্ট ভাবতে বাধ্য করে। হঠাৎ উড়তে ইচ্ছে করে ছুটতে দূর-দিগন্তে। ইচ্ছে করে ভবঘুরে হতে।

ইভেন্টের স্থান টাঙ্গুয়ার হাওর, রওনা দেয়ার সময় বৃহস্পতিবার রাত। সদ্যই জ্বর থেকে সেরে উঠা শরীরে হঠাৎ যেন শিহরণ খেলে গেল। যোগাযোগ করলাম তাদের সঙ্গে। যেতে পারব, তবে আসন সংখ্যা হাতেগোনা। তবুও সবার পেছনে।

মাত্র ৮ ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে প্রস্তুতি শুরু। চুল ছাঁটানো বাদে বোধহয় বাকি সবটাই পেরেছি। পেরেছি বন্ধু মিতুলকেও রাজি করাতে। অবশ্য রাজি না হয়ে কোথায় যাবে? জীবন যুদ্ধে সেও যে ক্লান্ত পথিক এখন। পরিবারের দায়িত্ব যে নিজেকে নিজের হতে দেয় না!

রাত দশটার পরই আমি মোটামুটি প্রস্তুত। অপেক্ষা কেবল মিতুলের। বেচারা ১১টায় বাসায় ফিরে কোনোরকমে দৌড়ে ১২টার বাস ধরতে বেরিয়েছে। অথচ গিয়ে শুনে, বাস ছাড়বে রাত একটায়। কপাল হয়তো একেই বলে!

কপাল আমাদের আসলেই মন্দ কিনা, তা পরীক্ষা করতে যাত্রাপথে বসে লটারিও কিনলাম। আর বাসের শেষের গণসিটে বসে গরম আর গতির সঙ্গে ‘নাচতে নাচতে’ ভোর চারটায় পৌঁছে গেলাম হাওর পাড়ে। যদিও মাঝে ঘুমানো হয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

বাসের মাঝেই পরিচয় হয়েছিল ‘মিলিওনিয়ার’ শাওন ভাইয়ের সঙ্গে। তার নামের সাথে তার কাজের তেমন মিল নাই। ফলে দুর্ভাগাদের সঙ্গে বাসের পেছনের সিটে ঠাঁই হয়েছিল তার। পুরো সফরজুড়ে এই ব্যাকবেঞ্চারদের থেকে আর তার মুক্তি মেলেনি।

তবে আমাদের থেকেও বড় দুর্ভাগা ছিলেন আরও এক ভাই, যিনি কিনা প্রেমিকার বিয়ের দুঃখ ভুলতে নাম দিয়েছিলেন ট্যুরে। অন্য সবার মতো তারে আমিও সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, ‘কেন যে মানুষ ছ্যাঁকা খেয়ে আত্মহত্যা করে?’

অবশ্য আত্মহত্যা না করে সবাই যদি এমন ছ্যাঁকা খেয়ে ট্যুর দিতো, বাসের শেষ সিটটাও অবশ্য আমাদের আর জুটতো না। তবে পৌষ মাস হতো ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের। এই শহরে প্রতি শুক্রবারে কতো শতো প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে হয় অন্য কারও সঙ্গে।

কথায় আছে– ‘সকালের সূর্য বলে দেয় দিনটা কেমন হবে।’ আমরাও তেমন হাওর ট্যুর কেমন হবে, তার আভাস পেয়ে গিয়েছিলাম ভোরের আলো ফুটতেই। রাতের মায়াবী চাঁদ আর সকালের সূর্য একসঙ্গেই হেসে উঠে হাওরে। প্রকৃতির কি অপরূপ দৃশ্য! সুবাহানাল্লাহ।

ভ্রমণের সময়টা যে উপভোগ্য হবে, তা যেমন বুঝেছিলাম; তেমনি সূর্য মামা সকালেই বুঝিয়ে দিয়েছিল, দিনটা তার হতে চলেছে। ভোর পেরোতেই দেখা মেলে রোদ্দুরের, সময়ের সঙ্গে যা আরও প্রখর হতে শুরু করে। টইটম্বুর ভেজা কাপড় বিশ মিনিটেই শুকিয়ে যাওয়া তো সেই কথাই বলে।

শুক্রবারের সকালে সাতটার আগে নাস্তা! বিষয়টা কতটা বিস্ময়কর, অনেকের বিস্ফোরিত চোখই তা বলে দিচ্ছিল। জলে ভাসতে ভাসতে খিচুড়ি বিলাস, প্রেমিকা ছাড়া আর কতোটা জমে? বন্ধু মিতুলের অবশ্য অতো হিসেব-নিকেশ নেই। যা নেই, তা নিয়ে ভেবে কি হবে!

আড্ডাবাজি আর গলাবাজি করেই সকাল নয়টায় পৌঁছে গেলাম লাকমাছড়ায়। যেখানে পানি আর পাহাড়ের এমন বন্ধুত্ব যেন নিজের একাকিত্ব বাড়ায়! এমন জায়গায় একাকিত্বের দহন হয়তো আরও বাড়তো, যদি না বিবাহিত দম্পতিদের অবস্থা নিজের চোখে না দেখতাম!

নাতিশীতোষ্ণ শব্দটা আসলে কী এবং কেন, তা বুঝতে পেয়েছি লাকমাছড়ায়। আর এখানকার ছবির ভিউ এতো সুন্দর যে, আপনি ভিজবেন না ছবি তুলবেন, এই দ্বিধাতেই কয়েক ঘণ্টা সময় পার হয়ে যাবে।

লাকমাছড়া থেকে ফিরে ডুব দিলাম নীলাদ্রি লেকে। নীল জলে গা ভেজালাম দীর্ঘক্ষণ। লাকমাছড়া যেমন তৃপ্তি এনে দিয়েছিল মনের মাঝে, নীলাদ্রি লেকের ঠান্ডা পানি যেন প্রশান্তি এনে দেয় দেহে। মাঝে রুমান ভাইয়ের পরামর্শে পেটও ঠান্ডা হয় দেড় গ্লাস লেবু-শরবতে।

এদিকে, সূর্য যেন ধীরেধীরে আরও তপ্ত হতে শুরু করে। লেক থেকে উঠে বোটের কাছে যেতেই ভেজা কাপড় শুকিয়ে গা আবারও ঘামতে শুরু করে। আর বোটে পৌঁছে পায়ে যেন ফোস্কা পড়ে যাবার উপক্রম। ছাদ যেন রূপান্তর হয়েছে উত্তপ্ত কড়াইয়ে।

গরমের তীব্রতা থেকে মুক্তি পেতে বোট এবার ছুটলো ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। মাঝের সময়টা কেটে গেল ছবি তুলে, নানান খেলাধুলা আর গল্পগুজবে। ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছা মাত্রই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল, মনটা ভালো হয়ে উঠলো নিমিষেই।

এতো এতো মানুষের দাপাদাপিতে পানিটা যদিও হয়ে উঠে ঘোলাটে, তাতে কি আর আনন্দে ভাটা পড়ে? যে যেভাবে পেরেছে ভিজেছে, ভিজিয়েছে। নেচেছে, মেতেছে। নিজেকে যেন উৎসর্গ করে দিয়েছে পানির কাছে। পানিতে ভিজেই চায়ের কাপে চুমুক! অনুভূতিটা অনেকদিন মনে থাকবে।

মনে থাকবে বয়সে ছোট দুটি ‘আপু’র কথা। ভ্রমণ গল্পটা রঙিন করে তুলেছিল এই দুটো মেয়ে। রিয়া আর সিনথি। বিশেষ করে ভীষণ দুঃখ বুকে পোষা বাপ্পারাজ (ছদ্মনাম) ভাইকে দুজনে যেভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো, তা দেখে হাসি থামানো যেন দায়। অনেকদিন মনে থাকবে তাদের কথা।

অবশ্য মনে না রেখেও উপায় নাই। ‘মেয়াদহীন’ পাঁচটা লটারি এই দুজনেই ধরিয়ে দিয়েছিল আমাদের হাতে। নাহয় আমাদের যে ভাগ্য, একটা পুরস্কার তো পাবার কথাই ছিল। আমার মনে হয়, এরা ষড়যন্ত্র করেছে বিম্পির সাথে মিলে।

এরপর ক্ষুধার্ত পেটকে পরিতৃপ্ত করার পালা। গরম ভাপ ওঠা ভাতের সাথে হাওরের টাটকা মাছ আর সাথে হাসের ঝোল আর গরম ডাল। ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই খাবার যেন হয়ে উঠেছে অমৃতসম!

এরপর ফেরার পালা। তবে সেখানেই বিপত্তি। শেষ বেলায় আয়োজন করা হলো মুড়ি ভর্তার। একইসঙ্গে ঘোষণা করা হল, লটারির পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। আগেই বলেছি, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে। ফলে পুরস্কার তো পাইইনি, মুড়ি খাবার স্বাদটাও চলে গেছে।

তবে প্রকৃতি তো বটেই, ভ্রমণের সুখ সঙ্গী-সাথীতে। তাতে জুড়ি মেলা ভার। অনেকের নাম জানি, অনেকের জানি না। কারও সঙ্গে ভবিষ্যতে হয়তো দেখা হবে, হয়তো বা হবে না। তবে যে ভালোবাসা ফেরি করে গেছেন, তাদের মনে রাখতে সেটুকুই বাধ্য করবে।

যাহোক, প্রায় ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে অবশেষে ঘরে ফেরা রাত দশটার পরে। মাঝের সময়ে প্রকৃতির মুগ্ধতা ছাড়াও আর কি দেখেছি জানেন? ‘ময়মনসিংহ ট্রাভেলার্সের’ আন্তরিকতা। ভ্রমণের বিঘ্নতা কাটিয়ে দিয়েছেন তারা ভালোবাসা দিয়ে।

কোনো তাড়াহুড়ো নেই, নিষেধ নেই। আছে সেবা, সবার খোঁজ রাখা। সহায়তা ও তথ্য দিয়ে উপকৃত করার মন্ত্রমুগ্ধতা। এরপর যখন আবার আপনার থালায় ভাত তুলে দেবেন, নিজেরা না খেয়ে আপনার প্রয়োজন পূর্ণ হয়েছে কিনা খোঁজ নেবেন; তাদের ‘ধন্যবাদ’ বলা ছাড়া আর কিইবা বলার থাকে!

ধন্যবাদ রুমান ভাই। ধন্যবাদ না থেকেও থাকা আমার ফকির নামের বড়লোক ভাইকে। কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য শিবলি আর তুষারেরও। ছোট হয়েও কতো সুন্দর করে আগলে রেখেছে বড় ভাইদের। ধন্যবাদ আপুদেরও। তবে খিচুড়ির বদলে বিরিয়ানি খাওয়া আর লটারি নিয়ে ষড়যন্ত্র করাটা মানতে পারলাম না।

সব শেষে বলি– সীমাবদ্ধতার এই জীবনে সবারই মনে এক সুপ্ত ইচ্ছে থাকে। কারও তা পূরণ হয় কোনো এককালে, কারওবা সুযোগ আর সামর্থ্যের বেড়াজালে স্বপ্নটাকে মাটিচাপা দিয়েই ছুটে চলতে হয় বাস্তবতার নিরিখে।

সেই সুপ্ত ইচ্ছেগুলোর কোনো একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকে ভ্রমণ! জাত-ধর্ম ঊর্ধে রেখে, শ্রেণি বিভেদ ভুলে প্রায় প্রতিটি মানুষের ইচ্ছেগুলো এই একটা জায়গায় এসে মিলে যায়, মিশে যায়; গান ধরে সমস্বরে।

টাঙ্গুয়ার হাওর, ১৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। জীবন ডায়েরিতে লিখে রাখলাম দিনটা। সাধ্য, সামর্থ্য, সুযোগ আর সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিঁড়ে এই দিনে চলে গিয়েছিলাম প্রকৃতির টানে, প্রভুর সৃষ্টির প্রেমে পড়তে।