ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর্যটনের মহাসড়ক ভাটী এলাকা

ভাটী এলাকা। সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। প্রকৃতি যেন নিজহাতে সাজিয়েছে। ছয় মাস থৈথৈ পানি। ছয় মাস শুস্ক। বর্ষায় অপরূপ সাজে সাজে পুরো এলাকা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মাঝখানে ছোট ছোট বাড়িঘর। দ্বীপের মতো।

ছয় মাস পানির সাথে সংগ্রাম। নৌকায় চড়ে বেড়ানো। স্ফটিকস্বচ্ছ পানিতে গোসল। সাঁতার কাটা। মিঠাপানিতে মাছধরা। দ্বীপসম বাড়িগুলোতে বসে আড্ডা, পুঁথিপাঠ, আউল বাউল ভাটিয়ালি গানের আসর। জমেওঠে নানা দাদার কাছে গল্পশোনা। বাকি ছয় মাস ক্ষেতে খামারে কাজ। এই হলো ভাটীর জীবন। জীবনের সাথে জীবীকার একটা দারুন মেলবন্ধন।

কৃষিকাজ। মাছ চাষ। গরু মোটাতাজা করন। হাঁস মুরগি ছাগল পালন। ভাটী এলাকার মানুষের জীবীকার উপায়। কেউ ব্যবসা করে। হাতেগোনা ক’জন চাকরি। যারা শহরে পড়ালেখা শিখেছে তারা চাকরি করছে। বিদেশে থাকা। নানারকম কাজ করা। বিদেশে নিজের মতো ব্যবসা করা লোকের সংখ্যাও আজকাল বেড়েছে।

একটিমাত্র সড়ক। পাল্টে গেছে ভাটী এলাকা। বদলে গেছে জীবন। প্রত্যন্ত গ্রামে লেগেছে শহরের ছোঁয়া। টাই স্যুট পরে লোকজন চলাফেরা করে। প্রাইভেট কার সারি সারি। বোঝার উপায় নেই যে ভাটী এলাকা। আন্তর্জাতিক মানের সড়ক বললে ভুল হবেনা। সড়কটির নাম দেয়া হয়েছে মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম সড়ক।

সড়কটি দেখার জন্য প্রতিদিন ভীড় করে হাজার হাজার পর্যটক। দেখার মতোই। একে ভাটী এলাকার ভাগ্য পরিবর্তনের সিঁড়ি বলা যায়। একটা সড়ক কিভাবে পাল্টেদেয় একটি এলাকাকে তার জ¦লন্ত উদাহরণ এই সড়কটি।

সড়কটিকে কেন্দ্রকরে গড়ে ওঠেছে পর্যটনশিল্প। দেশী বিদেশী পর্যটকরা নদীর স্রোতের মতো ছুটে আসে একনজর দেখতে। বর্ষাকালে দুইপাশে থৈথৈ পানি। মাঝখানে পিচঢালা মসৃন সড়ক। পানি থেকে ওঠে আসে হিমশীতল বাতাস। গাড়ি চলছেতো চলছেই। যানজট নেই। ট্রাফিক সিগনাল নেই। হর্ণের শব্দ নেই। কালোধূঁয়া নেই।

মিঠামইনের নতুন সড়ক

বাঙ্গালপাড়া থেকে অষ্টগ্রাম হয়ে মিঠামইনের উপর দিয়ে ইটনা। এইরকম একটা ড্রাইভ জীবনের জন্য দরকার। মন শান্ত করে। প্রাণে লাগায় দোলা। চেঁচামেচি নেই। কোলাহল নেই। নেই টেনশন। পেরেশানি। দু’টো দিন অন্য এক জগতে কাটানো। প্রকৃত প্রকৃতি বোধহয় একেই বলে।

শুস্ক মৌসুমে দুই পাশে সবুজ ধান। মাঝখানে রাস্তা। গাড়ি চলতে চলতে মনে হবে সবুজের রাজ্য। নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়ানো। সড়কের পাশে দারুন সব কফির দোকান। প্রকৃতির কাছে বসে কফি পানের মজাটাই আলাদা।

নীল আকাশ। খোলা মাঠ। দিগন্তজোড়া ঘন সবুজ ধান ক্ষেত। মুক্ত বাতাস। মাঝে মধ্যে লেকের মতো খাল। মাঝখানে বসে কফি খাওয়া। যেন কল্পনা।
কল্পনাকে বাস্তব রূপদিয়েছেন একজন মানুষ। ভাটী এলাকার স্বপ্নদ্রষ্টা। ভাটীর শার্দুল। বরপুত্র। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। তাঁর শ্রম ঘাম সাধনা ও স্বপ্নের ফসল এই সড়কটি।

কিশোরগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত তিন থানা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা। এই তিন থানা মিলে একটি সংসদ এলাকা। বর্তমান মহামান্য দীর্ঘদিন ছিলেন এখানকার সংসদ সদস্য। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার থেকে আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশের রাষ্টপতি। সবাই গর্বের সাথে বলে ভাটী এলাকার কৃতি সন্তান। তাঁর সুযোগ্যপুত্র রেজোয়ান আহম্মদ তৌফিক বর্তমান এমপি। তিনিও ভাটী এলাকার প্রতি বেশ যত্মশীল।

একজন স্বপ্নদ্রষ্টার কারনে পাঁচশত বছর এগিয়ে গেছে একটি এলাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দর্শন-‘গ্রাম হবে শহর’। এই দর্শনের প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করছে ভাটী এলকার মানুষ। পর্যটনের মহাসড়কে প্রবেশ করছে এক সময়ের অবহেলিত ভাটী এলাকা। সারাবিশে^র সবাই চেনে। জানে ভাটী এলাকা সম্পর্কে। এর রূপসৌন্দর্য্য সম্পর্কে। পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। মাত্র ক’দিনে মন জয় করেছে হাজার হাজার পর্যটকের। পর্যটনশিল্পের বিকাশে এ যেন এক নতুন মাত্রা।

পর্যটকদের নেশা ভাটী এলাকার মিঠাপানির তাজা মাছ। সবুজ সতেজ শব্জি। শুটকির ভর্তা। পুটি মাছের চর্চরি। উন্নতমানের কোন হোটেল মোটেল না থাকলেও ছোটখাটো হোটেলে এগুলো পাওয়া যায়। মনের আনন্দে ঘুরেবেড়িয়ে পর্যটকরা স্বাদগ্রহণ করে দেশী মাছের।

এখনো পুরোদমে জমে ওঠেনি। গড়েওঠেনি হোটেল মোটেল রিসোর্ট। কাজ চলছে। দু’এক বছরের মধ্যে পাল্টে যাবে ভাটীর চেহারা। দেশী বিদেশী মানুষের পদচারনায় বদলে যাবে রুচিনীতি। শহরের মানুষের মতো ভাটী এলাকার মানুষও পেন্ট শার্ট জুতা পরে ঘুরবে। ফিরবে। এর ঢেউ অনেক আগেই লেগেছে। এবার পাল্টে যাবে দৃশ্যপট।

মিঠামইনের হাওরে পুরোদমে চলছে সেনানিবাসের কাজ। স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয় স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স হচ্ছে। মানুষের মুখে হাঁসি দেখা যায়। ক’বছর আগেও যে মানুষটি পেরেশানিতে দিন কাটাতো তার চোখে মুখে আনন্দ। একটা মাত্র সড়ক বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মনের জোর। গড়ে তুলেছে বিশাল কর্মক্ষেত্র। পুরোপুরি পর্যটনকেন্দ্র হলে আরো পাল্টে যাবে জীবন। অর্থনীতি। রাজনীতি। সমাজনীতি।

কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৩টি থানা। হাওর থানা তিনটির ইতিহাস বেশ পুরানো। অষ্টগ্রাম থানার পনির সবার প্রিয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে এই পনিরের চাহিদা আছে। এক সময় অষ্টগ্রামকে বলা হতো পনিরের গ্রাম। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও মানুষ অষ্টগ্রাম যায় পনিরের খোঁজে। পর্যটকরা পনির খেতে ছুটে যায়। মিঠামইন হতে অষ্টগ্রাম যেতে মাত্র বিশ মিনিট সময় লাগে। চৎকার রাস্তা দিয়ে সবাই ঘুরে আসে পনির রাজ্য অষ্টগ্রাম।

অষ্টগ্রাম থানার একটি গ্রামের নাম ভাতশালা। নামটি বেশ চমৎকার! নামের একটা তাৎপর্য আছে। মিঠামইন থানায় আছে বেশক’টি আখড়া। খলাপাড়া গ্রামে গোধর গোস্বামীর আখড়া। কাঠখালে দিল্লির আখড়া। বর্ষাকালে দিল্লির আখড়ার দৃশ্য অপূর্ব। চারপাশে পানি। হিজল গাছগুলোর অর্ধেকের বেশি পানির নীচে। মাথাটা ভাসমান। চমৎকার দৃশ্য!

ঘাগড়া ইউনিয়নের ভরা গ্রামে মালিকের দরগাহ। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা শ্রেণি পেশার লোক আসে এই দরগায়। ইটনায় আছে রাইটুটি গ্রাম। দেখারমতো। গ্রামটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।

পর্যটকরা ভাটী এলাকায় আসে পানি আর হাওর দেখতে। বর্ষাকালে পানি। শুস্ক মৌসুমে ধানী জমি।

একটা সময় ছিলো যখর হাওরের মানুষ ছয় মাস কাজ করতো। ছয় মাস থাকতো বেকার। পানিবন্দী মানুষের জীবন ছিলো দুর্বিসহ। সময় কাটতোনা। সেই মানুষগুলো এখন প্রচন্ড ব্যস্ত। বর্ষকালে তাদের ব্যস্ততা আরো বাড়ে। পর্যটকদের ভীড়ে ভাটী এলাকা থাকে মুখরিত। তখন কেউ করে খাবারের ব্যবসা। কেউ নৌকা চালানো। কেউবা মোটর সাইকেল, অটো ইত্যাদি। যে এলাকার মানুষ জীবনে গাড়ি দেখেনি, তাদের বাড়ির সামনে থাকে গাড়ি। নৌকার জায়গা দখল করেছে গাড়ি।

এক সময় বলা হতো ভাটী এলাকায় ছিলো “বর্ষায় নাও শুকনায় পাও”। সেই প্রবাদ প্রবচন এখন অতীত।  নৌকার জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মানুষ যা ভাবেনি তাই হয়েছে।

আমাদের পূর্বপুরুষরা পঞ্চাশ ষাট মাইল পায়ে হেটে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতেন। সকালে বের হতেন। পৌঁছাতেন বিকালে। পরের দিন সারাদিন কাজ। রাতে হোটেলে। পরদিন ভোরে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরতেন। সন্ধ্যায় ডাকাতের ভয়। যেকরেই হোক বিকালে পৌঁছাতে হতো। এখন সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা যে কোন সময় ঘাগড়া হতে কিশোরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হতে ঘাগড়া যাওয়া আসা করা যায়। সাবমার্জেবল রাস্তা মানুষের জীবনকে করেছে সহজ। দূরকে করেছে কাছে।

সাবমার্জেবল রাস্তা নির্মান নিয়ে ২০০১ সালে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)-তে আমি রিপোর্ট করেছিলাম। তখন আওয়ামী লীগ নেতা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে, পর্যটন প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভাটী এলাকায় সাবমার্জেবল রাস্তা তৈরির পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিছুদিন পরই তা বাস্তবায়ন হয়।

বলা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই শুরু হয় ভাটী এলাকার উন্নয়ন। এই সরকারের সময়ই এলাকাটি পর্যটন এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে পা রাখছে পর্যটনের মহাসড়কে।

গাইডলাইন

  • ঢাকার মহাখালী, গুলিস্তান ও সায়দাবাদ হতে কিশোরগঞ্জ হয়ে মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম যাওয়া যায়।
  • মহাখালী হতে অনন্যা বাসে গাজীপুর হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন বাস ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।
  • মহাখালী হতে ওজানভাটী বাসে কিশোরগঞ্জের বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড হয়ে চামড়াঘাট। মিঠামইন যাবার জন্য চামড়াঘাটের আগে বালিখলা মোড় নেমে অটোতে ফেরিঘাট। তারপর মিঠামইন।
  • গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে থেকে যাতায়াত বাস। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা।
  • সায়দাবাদ ফ্লাইওভার থেকে নামার মাথা (উত্তর মাথা), গোলাপবাগ হতে যাতায়াত বাস। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল।
  • সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল হতে ইশাখাঁ পরিবহণ। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। সময় লাগে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা।
  • কিশোরগঞ্জ গাইটাল বা বত্রিশ হতে অটো কিংবা সিএনজিতে বালিখলা ফেরিঘাট। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা।
  • বালিখলা হতে ফেরি পার হয়ে অটোতে মিঠামইন জনপ্রতি ৪০ টাকা।
  • ঢাকা থেকে সরাসরি মাইক্রোবাসে মিঠামইন জনপ্রতি ৫০০ টাকা। বাস ছাড়ে মিরপুর মাজার রোড হতে।
  • ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে কোন পেরেশানি ছাড়া সরাসরি মিঠামইন। গাজীপুর কিংবা ভৈরব যে কোন দিক দিয়েই যাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জ হয়ে মিঠামইন যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন চার ঘন্টা।
  • কিশোরগঞ্জে সিএনজি (গ্যাস) আছে। চৌদ্দশত-এর পাশে। শহরে প্রবেশের আগে।
  • করিমগঞ্জে পেট্রোলপাম্প আছে।
  • মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম কোথাও পেট্রোল, অকটেন বা গ্যাস পাম্প নেই। করিমগঞ্জ থেকে অকটেন রিজার্ভ করা নিরাপদ।
  • পর্যটকদের থাকার জন্য নিকলী ও মিঠামইনে দু’টি হোটেল আছে।
  • এলাকা ঘুরার জন্য শুস্ক মৌসুমে অটো/সিএনজি। র্বর্ষা মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা/স্পীডবোট।
  • বর্ষা মৌসুমে গাড়ি রাখতে হবে চামড়াঘাট অথবা বালিখলাঘাট। তারপর ইঞ্জিনের নৌকা/স্পীডবোটে ঘোরাঘুরি।
  • ভাটী এলাকায় ভ্রমন আনন্দদায়ক ও নিরাপদ। সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
  • খোলা আকাশে মুক্ত বাতাসে কোলাহলমুক্ত ভ্রমনের জন্য উপযুক্ত স্থান কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-এর হাওর এলাকা।

লেখক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন

সিনিয়র সাংবাদিক কলামিষ্টঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের সাবেক খন্ডকালীন শিক্ষক [২০১৩-২০১৯]রিসোর্সপার্সন প্রেস ইনস্টিটিউ বাংলাদেশ [পিআইবি] সাবেক নির্বাহী প্রযোজক, এনটিভি নিউজ

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

পর্যটনের মহাসড়ক ভাটী এলাকা

আপডেট টাইম : ১২:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪

ভাটী এলাকা। সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। প্রকৃতি যেন নিজহাতে সাজিয়েছে। ছয় মাস থৈথৈ পানি। ছয় মাস শুস্ক। বর্ষায় অপরূপ সাজে সাজে পুরো এলাকা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মাঝখানে ছোট ছোট বাড়িঘর। দ্বীপের মতো।

ছয় মাস পানির সাথে সংগ্রাম। নৌকায় চড়ে বেড়ানো। স্ফটিকস্বচ্ছ পানিতে গোসল। সাঁতার কাটা। মিঠাপানিতে মাছধরা। দ্বীপসম বাড়িগুলোতে বসে আড্ডা, পুঁথিপাঠ, আউল বাউল ভাটিয়ালি গানের আসর। জমেওঠে নানা দাদার কাছে গল্পশোনা। বাকি ছয় মাস ক্ষেতে খামারে কাজ। এই হলো ভাটীর জীবন। জীবনের সাথে জীবীকার একটা দারুন মেলবন্ধন।

কৃষিকাজ। মাছ চাষ। গরু মোটাতাজা করন। হাঁস মুরগি ছাগল পালন। ভাটী এলাকার মানুষের জীবীকার উপায়। কেউ ব্যবসা করে। হাতেগোনা ক’জন চাকরি। যারা শহরে পড়ালেখা শিখেছে তারা চাকরি করছে। বিদেশে থাকা। নানারকম কাজ করা। বিদেশে নিজের মতো ব্যবসা করা লোকের সংখ্যাও আজকাল বেড়েছে।

একটিমাত্র সড়ক। পাল্টে গেছে ভাটী এলাকা। বদলে গেছে জীবন। প্রত্যন্ত গ্রামে লেগেছে শহরের ছোঁয়া। টাই স্যুট পরে লোকজন চলাফেরা করে। প্রাইভেট কার সারি সারি। বোঝার উপায় নেই যে ভাটী এলাকা। আন্তর্জাতিক মানের সড়ক বললে ভুল হবেনা। সড়কটির নাম দেয়া হয়েছে মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম সড়ক।

সড়কটি দেখার জন্য প্রতিদিন ভীড় করে হাজার হাজার পর্যটক। দেখার মতোই। একে ভাটী এলাকার ভাগ্য পরিবর্তনের সিঁড়ি বলা যায়। একটা সড়ক কিভাবে পাল্টেদেয় একটি এলাকাকে তার জ¦লন্ত উদাহরণ এই সড়কটি।

সড়কটিকে কেন্দ্রকরে গড়ে ওঠেছে পর্যটনশিল্প। দেশী বিদেশী পর্যটকরা নদীর স্রোতের মতো ছুটে আসে একনজর দেখতে। বর্ষাকালে দুইপাশে থৈথৈ পানি। মাঝখানে পিচঢালা মসৃন সড়ক। পানি থেকে ওঠে আসে হিমশীতল বাতাস। গাড়ি চলছেতো চলছেই। যানজট নেই। ট্রাফিক সিগনাল নেই। হর্ণের শব্দ নেই। কালোধূঁয়া নেই।

মিঠামইনের নতুন সড়ক

বাঙ্গালপাড়া থেকে অষ্টগ্রাম হয়ে মিঠামইনের উপর দিয়ে ইটনা। এইরকম একটা ড্রাইভ জীবনের জন্য দরকার। মন শান্ত করে। প্রাণে লাগায় দোলা। চেঁচামেচি নেই। কোলাহল নেই। নেই টেনশন। পেরেশানি। দু’টো দিন অন্য এক জগতে কাটানো। প্রকৃত প্রকৃতি বোধহয় একেই বলে।

শুস্ক মৌসুমে দুই পাশে সবুজ ধান। মাঝখানে রাস্তা। গাড়ি চলতে চলতে মনে হবে সবুজের রাজ্য। নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়ানো। সড়কের পাশে দারুন সব কফির দোকান। প্রকৃতির কাছে বসে কফি পানের মজাটাই আলাদা।

নীল আকাশ। খোলা মাঠ। দিগন্তজোড়া ঘন সবুজ ধান ক্ষেত। মুক্ত বাতাস। মাঝে মধ্যে লেকের মতো খাল। মাঝখানে বসে কফি খাওয়া। যেন কল্পনা।
কল্পনাকে বাস্তব রূপদিয়েছেন একজন মানুষ। ভাটী এলাকার স্বপ্নদ্রষ্টা। ভাটীর শার্দুল। বরপুত্র। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। তাঁর শ্রম ঘাম সাধনা ও স্বপ্নের ফসল এই সড়কটি।

কিশোরগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত তিন থানা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা। এই তিন থানা মিলে একটি সংসদ এলাকা। বর্তমান মহামান্য দীর্ঘদিন ছিলেন এখানকার সংসদ সদস্য। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার থেকে আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশের রাষ্টপতি। সবাই গর্বের সাথে বলে ভাটী এলাকার কৃতি সন্তান। তাঁর সুযোগ্যপুত্র রেজোয়ান আহম্মদ তৌফিক বর্তমান এমপি। তিনিও ভাটী এলাকার প্রতি বেশ যত্মশীল।

একজন স্বপ্নদ্রষ্টার কারনে পাঁচশত বছর এগিয়ে গেছে একটি এলাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দর্শন-‘গ্রাম হবে শহর’। এই দর্শনের প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করছে ভাটী এলকার মানুষ। পর্যটনের মহাসড়কে প্রবেশ করছে এক সময়ের অবহেলিত ভাটী এলাকা। সারাবিশে^র সবাই চেনে। জানে ভাটী এলাকা সম্পর্কে। এর রূপসৌন্দর্য্য সম্পর্কে। পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। মাত্র ক’দিনে মন জয় করেছে হাজার হাজার পর্যটকের। পর্যটনশিল্পের বিকাশে এ যেন এক নতুন মাত্রা।

পর্যটকদের নেশা ভাটী এলাকার মিঠাপানির তাজা মাছ। সবুজ সতেজ শব্জি। শুটকির ভর্তা। পুটি মাছের চর্চরি। উন্নতমানের কোন হোটেল মোটেল না থাকলেও ছোটখাটো হোটেলে এগুলো পাওয়া যায়। মনের আনন্দে ঘুরেবেড়িয়ে পর্যটকরা স্বাদগ্রহণ করে দেশী মাছের।

এখনো পুরোদমে জমে ওঠেনি। গড়েওঠেনি হোটেল মোটেল রিসোর্ট। কাজ চলছে। দু’এক বছরের মধ্যে পাল্টে যাবে ভাটীর চেহারা। দেশী বিদেশী মানুষের পদচারনায় বদলে যাবে রুচিনীতি। শহরের মানুষের মতো ভাটী এলাকার মানুষও পেন্ট শার্ট জুতা পরে ঘুরবে। ফিরবে। এর ঢেউ অনেক আগেই লেগেছে। এবার পাল্টে যাবে দৃশ্যপট।

মিঠামইনের হাওরে পুরোদমে চলছে সেনানিবাসের কাজ। স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয় স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স হচ্ছে। মানুষের মুখে হাঁসি দেখা যায়। ক’বছর আগেও যে মানুষটি পেরেশানিতে দিন কাটাতো তার চোখে মুখে আনন্দ। একটা মাত্র সড়ক বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মনের জোর। গড়ে তুলেছে বিশাল কর্মক্ষেত্র। পুরোপুরি পর্যটনকেন্দ্র হলে আরো পাল্টে যাবে জীবন। অর্থনীতি। রাজনীতি। সমাজনীতি।

কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৩টি থানা। হাওর থানা তিনটির ইতিহাস বেশ পুরানো। অষ্টগ্রাম থানার পনির সবার প্রিয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে এই পনিরের চাহিদা আছে। এক সময় অষ্টগ্রামকে বলা হতো পনিরের গ্রাম। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও মানুষ অষ্টগ্রাম যায় পনিরের খোঁজে। পর্যটকরা পনির খেতে ছুটে যায়। মিঠামইন হতে অষ্টগ্রাম যেতে মাত্র বিশ মিনিট সময় লাগে। চৎকার রাস্তা দিয়ে সবাই ঘুরে আসে পনির রাজ্য অষ্টগ্রাম।

অষ্টগ্রাম থানার একটি গ্রামের নাম ভাতশালা। নামটি বেশ চমৎকার! নামের একটা তাৎপর্য আছে। মিঠামইন থানায় আছে বেশক’টি আখড়া। খলাপাড়া গ্রামে গোধর গোস্বামীর আখড়া। কাঠখালে দিল্লির আখড়া। বর্ষাকালে দিল্লির আখড়ার দৃশ্য অপূর্ব। চারপাশে পানি। হিজল গাছগুলোর অর্ধেকের বেশি পানির নীচে। মাথাটা ভাসমান। চমৎকার দৃশ্য!

ঘাগড়া ইউনিয়নের ভরা গ্রামে মালিকের দরগাহ। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা শ্রেণি পেশার লোক আসে এই দরগায়। ইটনায় আছে রাইটুটি গ্রাম। দেখারমতো। গ্রামটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।

পর্যটকরা ভাটী এলাকায় আসে পানি আর হাওর দেখতে। বর্ষাকালে পানি। শুস্ক মৌসুমে ধানী জমি।

একটা সময় ছিলো যখর হাওরের মানুষ ছয় মাস কাজ করতো। ছয় মাস থাকতো বেকার। পানিবন্দী মানুষের জীবন ছিলো দুর্বিসহ। সময় কাটতোনা। সেই মানুষগুলো এখন প্রচন্ড ব্যস্ত। বর্ষকালে তাদের ব্যস্ততা আরো বাড়ে। পর্যটকদের ভীড়ে ভাটী এলাকা থাকে মুখরিত। তখন কেউ করে খাবারের ব্যবসা। কেউ নৌকা চালানো। কেউবা মোটর সাইকেল, অটো ইত্যাদি। যে এলাকার মানুষ জীবনে গাড়ি দেখেনি, তাদের বাড়ির সামনে থাকে গাড়ি। নৌকার জায়গা দখল করেছে গাড়ি।

এক সময় বলা হতো ভাটী এলাকায় ছিলো “বর্ষায় নাও শুকনায় পাও”। সেই প্রবাদ প্রবচন এখন অতীত।  নৌকার জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মানুষ যা ভাবেনি তাই হয়েছে।

আমাদের পূর্বপুরুষরা পঞ্চাশ ষাট মাইল পায়ে হেটে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতেন। সকালে বের হতেন। পৌঁছাতেন বিকালে। পরের দিন সারাদিন কাজ। রাতে হোটেলে। পরদিন ভোরে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরতেন। সন্ধ্যায় ডাকাতের ভয়। যেকরেই হোক বিকালে পৌঁছাতে হতো। এখন সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা যে কোন সময় ঘাগড়া হতে কিশোরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হতে ঘাগড়া যাওয়া আসা করা যায়। সাবমার্জেবল রাস্তা মানুষের জীবনকে করেছে সহজ। দূরকে করেছে কাছে।

সাবমার্জেবল রাস্তা নির্মান নিয়ে ২০০১ সালে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)-তে আমি রিপোর্ট করেছিলাম। তখন আওয়ামী লীগ নেতা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে, পর্যটন প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভাটী এলাকায় সাবমার্জেবল রাস্তা তৈরির পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিছুদিন পরই তা বাস্তবায়ন হয়।

বলা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই শুরু হয় ভাটী এলাকার উন্নয়ন। এই সরকারের সময়ই এলাকাটি পর্যটন এলাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে পা রাখছে পর্যটনের মহাসড়কে।

গাইডলাইন

  • ঢাকার মহাখালী, গুলিস্তান ও সায়দাবাদ হতে কিশোরগঞ্জ হয়ে মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম যাওয়া যায়।
  • মহাখালী হতে অনন্যা বাসে গাজীপুর হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন বাস ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।
  • মহাখালী হতে ওজানভাটী বাসে কিশোরগঞ্জের বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড হয়ে চামড়াঘাট। মিঠামইন যাবার জন্য চামড়াঘাটের আগে বালিখলা মোড় নেমে অটোতে ফেরিঘাট। তারপর মিঠামইন।
  • গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে থেকে যাতায়াত বাস। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা।
  • সায়দাবাদ ফ্লাইওভার থেকে নামার মাথা (উত্তর মাথা), গোলাপবাগ হতে যাতায়াত বাস। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ গাইটাল।
  • সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল হতে ইশাখাঁ পরিবহণ। ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ বত্রিশ বাসস্ট্যান্ড। বিরতিহীন ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ টাকা। সময় লাগে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা।
  • কিশোরগঞ্জ গাইটাল বা বত্রিশ হতে অটো কিংবা সিএনজিতে বালিখলা ফেরিঘাট। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা।
  • বালিখলা হতে ফেরি পার হয়ে অটোতে মিঠামইন জনপ্রতি ৪০ টাকা।
  • ঢাকা থেকে সরাসরি মাইক্রোবাসে মিঠামইন জনপ্রতি ৫০০ টাকা। বাস ছাড়ে মিরপুর মাজার রোড হতে।
  • ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে কোন পেরেশানি ছাড়া সরাসরি মিঠামইন। গাজীপুর কিংবা ভৈরব যে কোন দিক দিয়েই যাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জ হয়ে মিঠামইন যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন চার ঘন্টা।
  • কিশোরগঞ্জে সিএনজি (গ্যাস) আছে। চৌদ্দশত-এর পাশে। শহরে প্রবেশের আগে।
  • করিমগঞ্জে পেট্রোলপাম্প আছে।
  • মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম কোথাও পেট্রোল, অকটেন বা গ্যাস পাম্প নেই। করিমগঞ্জ থেকে অকটেন রিজার্ভ করা নিরাপদ।
  • পর্যটকদের থাকার জন্য নিকলী ও মিঠামইনে দু’টি হোটেল আছে।
  • এলাকা ঘুরার জন্য শুস্ক মৌসুমে অটো/সিএনজি। র্বর্ষা মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা/স্পীডবোট।
  • বর্ষা মৌসুমে গাড়ি রাখতে হবে চামড়াঘাট অথবা বালিখলাঘাট। তারপর ইঞ্জিনের নৌকা/স্পীডবোটে ঘোরাঘুরি।
  • ভাটী এলাকায় ভ্রমন আনন্দদায়ক ও নিরাপদ। সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
  • খোলা আকাশে মুক্ত বাতাসে কোলাহলমুক্ত ভ্রমনের জন্য উপযুক্ত স্থান কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-এর হাওর এলাকা।

লেখক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন

সিনিয়র সাংবাদিক কলামিষ্টঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের সাবেক খন্ডকালীন শিক্ষক [২০১৩-২০১৯]রিসোর্সপার্সন প্রেস ইনস্টিটিউ বাংলাদেশ [পিআইবি] সাবেক নির্বাহী প্রযোজক, এনটিভি নিউজ