রাজধানীর হাতিরপুল বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের একটি তাজা রুই মাছ কেনেন ব্যাংক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। কিন্তু সমস্যা বোঝা গেল রান্নার পর। মাছ থেকে এক ধরনের উৎকট গন্ধ আসছে এবং মাছ খেতেও তেমন স্বাদ নেই। শুধু রুই মাছ নয়, রাজধানীর বাজারগুলোয় বিক্রি হওয়া অধিকাংশ তাজা কাতল, পাবদা, কই, তেলাপিয়া ও পাঙাশের মতো মাছে রান্নার পর এক ধরনের উৎকট গন্ধ আসছে। এ ছাড়া মাছের স্বাদও ভালো না। এ ঘটনায় একাধিক ভোক্তা প্রশ্ন করেছেন- তাজা মাছে কেন রান্নার পর গন্ধ আসবে? আগের মতো স্বাদ কেন পাওয়া যাচ্ছে না? এসব মাছ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর? ভোক্তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য।
মাছ চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাছ চাষী, মৎস্য কর্মকর্তা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগেও দেশি কিংবা চাষ করা বিদেশি মাছেও প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ ছিল। ওই সময় পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার ছিল, কৃত্রিম খাবার দেওয়া হলেও তাতে ক্ষতিকর কিছু ছিল না। কিন্তু স্বল্প সময়ে অধিক মাছ উৎপাদন এবং মুনাফা ঘরে তুলতে চাষিরা এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এখন যেসব পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে এবং মাছকে যেসব খাবার খাওয়ানো হচ্ছে, তাতে মাছের বৃদ্ধি হচ্ছে বটে, তবে এর ‘ফুড ভ্যালু’ নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
অধিকাংশ মাছের খামারের ওপর কিংবা পাশেই রয়েছে মুরগির খামার। অধিক লাভের আশায় খামারিরা পুকুরে একসঙ্গে মাছ-মুরগি পালন করেন। চাষ করা দেশি-বিদেশি সব মাছে কৃত্রিম খাবার দেওয়া হয়। সামুদ্রিক পচা মাছ, ট্যানারির বর্জ্য, সিসাসহ ক্ষতিকর ধাতু মেশানো হয় মাছের খাবারে। এ ধরনের খাবারে মাছ মোটাতাজা করা হয়। এসব খাবারে মাত্রারিক্ত ক্ষতিকর লিড, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়াম থাকায় মাছ অস্বাভাবিক বড় হয়। একই সঙ্গে স্বাদ-গন্ধে পরিবর্তন হয়ে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ হারায়। এ ছাড়া বেশি উৎপাদনের লোভে অল্প জায়গায় মাছ চাষ করা হচ্ছে। এ কারণেই এসব মাছে কোনো স্বাদ-গন্ধ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, একেকটি পুকুর-জলাশয়ে বছরে তিন-চারবার মাছ চাষ করা হচ্ছে। খাবারের ওপর খাবার দেওয়া হচ্ছে। এতে মাছ দ্রুত বড় হচ্ছে ঠিক; কিন্তু স্বাদ-গন্ধ নেই। খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) অলক কুমার সাহা আমাদের সময়কে বলেন, মাছে উৎকট গন্ধের জন্য অপরিষ্কার পানি, কৃত্রিম খাবার এবং চাষ পদ্ধতি দায়ী। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই আমাদের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে মাছ চাষ করছে। সুতরাং আমাদের নিদের্শনা অনুসরণ করলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কম। আমাদের মাঠ পর্যায়ে যারা আছেন, তারা সবসময় এগুলো নজরদারি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নজরদারির ঘাটতির কারণেই বেশিরভাগ খামারিই মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য খেয়ালখুশিমতো ওষুধ, হরমোন ও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন। ডিলাররা প্যাকেটজাত মাছের খাবারে পচা শামুক, ঝিনুক ও নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করেন, যা বিষাক্ত। এ ছাড়া মুরগির বিষ্ঠায় রয়েছে নানা ধরনের মাইক্রোসেল, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তাজা মাছেও গন্ধ আসার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, মাছটা কোথায় চাষ করা হয়েছে এবং পরে কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে, সেটির ওপর গন্ধের বিষয়টি নির্ভর করে। এ ছাড়া খাবার এবং পানির উপাদান যদি খারাপ হয়, তা হলে মাছ থেকে উৎকট গন্ধ আসতে পারে। আবার চাষকৃত পুকুরের ওপর মুরগির খামার করার ফলে কিছু অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। কারণ মুরগির খাবারে অনেক ধরনের রাসায়নিক থাকে। ট্যানারির চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে নানা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। পরে আবার সেটি ব্যবহার করা হয় চাষকৃত মাছের খাবার হিসেবে। এ জন্য আমরা দেখতে পাই প্রাকৃতিক মাছে স্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু চাষকৃত মাছে সেটি নেই। দীর্ঘদিন এই মাছ খাওয়া হলে শরীরে নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। স্বাদ-গন্ধ অটুট রাখতে হলে পানি পরিষ্কারসহ মাছের খাবারে নজর দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, চাষকৃত পুকুরের মাটি-পানি ভালো না হওয়ার জন্য মাছটা সুস্বাধু হয় না এবং গন্ধ হয়। আরেকটি বড় বিষয় হলো- মাছের খাবার হিসেবে বিষ্ঠা ব্যবহার করা হয়। এই বিষ্ঠাটা সরাসরি নিচে যায়। বিষ্ঠার গন্ধটা মাছ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আঁশের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মাছ যখন রান্না করা হয় ওই গন্ধটা পুরোপুরি যাবে না এবং আমাদের মাছের যে স্বাভাবিক স্বাদ আমরা প্রত্যাশা করি, সেটি আসবে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে কিছু ঝুঁকির দিক রয়েছে। হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারের ফলে মুরগির খামারে যে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর দ্রব্য দেওয়া হয়, যেমন ‘হ্যাভি মেটাল’ম, সেগুলো মাছের মধ্যে দিয়ে আমাদের শরীরে চলে আসে। আরেকটি বিষয় হলো- মুরগির খাবারে জন্য ব্যবহার করা হয় হাড়ের গুড়া। হাড়ের গুড়া আসে ট্যানারি থেকে। আর ট্যানারিতে হ্যাভি মেটাল ব্যবহার করা হয় চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে। তখন সেই হাড়ের মধ্যেও হ্যাভি মেটাল থাকে এবং সেগুলো মুরগির বিষ্ঠায় থাকে। আবার মাছের খাবারেও এগুলো ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন, এ ধরনের মাছ স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেউ যদি লম্বা সময় ধরে এ ধরনের মাছ খায়, তা হলে পেটব্যথা, ডায়রিয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের পরিপাকজনিত সমস্যা হতে পারে।