বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ কুয়াকাটা থেকে চরটির অবস্থান পূর্ব-দক্ষিণে। পানিপথে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরবর্তী গাছপালা, জীব-জন্তু ও প্রায়মনুষ্যহীন চর থেকে দেখা আকাশের রক্তিম আভার রূপ অবিশ্বাস্য ভালো লাগার মতো, যা আজীবনের সুখস্মৃতি। লিখেছেন মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম।
ঢাকা শহরের যানজট ঠেলেঠুলে লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণ বাকি থাকতেই একে একে বারোজন ভ্রমণবন্ধু সদরঘাট টার্মিনালে হাজির হই। তিন দিনের ছুটি পেয়ে মাত্রার অতিরিক্ত যাত্রী। লঞ্চের ডেকে হাঁটার সুযোগ নেই। কেবিন ছাড়া যাত্রীরা যে যার মতো শুয়ে-বসে আছে। ভাগ্যিস, নৌ-টার্মিনাল সংশ্নিষ্ট বন্ধু সোহেল আগেভাগেই দুটো ডিলাক্স কেবিন বরাদ্দ রেখেছিল। ৬টা ৪০ মিনিটে হুইসেল বাজিয়ে ঘাট ছেড়ে যায় লঞ্চ। ফতুল্লা যেতেই সংগঠনের ব্যানার বারান্দায় টাঙানো হয়। আমরা যেখানে ভ্রমণে যাই সেসব জায়গা হলো প্রকৃতির চাদর। অথচ আমরা অনেকেই জেনে-না জেনে প্লাস্টিকের গ্লাস, প্লেট, বোতল, চিপ্স-চকোলেটের মোড়ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে আসি, যা কয়েক যুগেও মাটির সাথে মিশে যায় না। এতে প্রকৃতির মারাত্মক দূষণ ও বিপর্যয় ঘটে। অথচ একটু সচেতন হলেই তা রোধ করা সম্ভব। তাই আমরা দুর্গম অঞ্চলের নয়নাভিরাম কোথাও ভ্রমণে গেলে খাবারের পাত্র হিসেবে কলাপাতা ব্যবহার করি। এবার থেকে শুরু করেছি বাঁশ দিয়ে তৈরি গ্লাস। মোড়ক গোছানোর দায়িত্বে ছিল নিবেদিতপ্রাণ হাসিব।
ডিম-খিচুড়ি চলল জোরেশোরে। কিছুটা সময় ধরে চলল আড্ডাবাজি। এর পর এক ঘুমে সকাল ৬টায় পটুয়াখালী। ঘাটে গিয়েই মাইক্রো বাসে কুয়াকাটা। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাই সাগরপার। এদিকে শেষ রাত থেকেই শান্ত সাগর অশান্ত। আবহাওয়ার পূর্বাভাস- ২ নং সতর্ক সংকেত। একেই বলে প্রকৃতির আপন খেয়াল। ভর শীতেও সাগর উত্তাল। নাশতা সারতেই আমাদের কুয়াকাটার ভ্রমণবন্ধু ওমর মিজান কাঁচাবাজার নিয়ে হাজির। দ্রুত ঘাটে চলে যাই। ইঞ্জিন বোট নিয়ে শফিক মাঝিও প্রস্তুত। বেলা প্রায় সাড়ে ১১টায় উত্তাল বঙ্গোপসাগরের নোনা পানিতে ভাসল বোট। একটা সময় দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেল চলাচলরত অন্যান্য জলযান।
বিশাল দরিয়ার মাঝে শুধু আমরাই। মাঝেমধ্যে গাঙচিল উড়ে যায়। সবাই যখন খোশগল্পে মশগুল তখন মাঝির চিৎকারে উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। মোবাইল ফোনে চরের দিকনির্দেশনা চাচ্ছে; জোরে জোরে বলতে লাগল, কুয়াশার কারণে দিক হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে লাগল, বেশি নড়াচড়া করবেন না। সাগরের অবস্থা ভালো না। তার ভয়ার্ত চিৎকার আমাদেরকে বিচলিত করল না। বরং জানিয়ে দিলাম, দিক খুঁজে না পেলে বেশ মজাই হবে। ভেসে বেড়াব বঙ্গোপসাগরে। এমন ভাবলেশহীন কথায় সে বেশ বুঝতে পারল, আমরা ওর চেয়ে বেশি সতর্ক।
আড়াই ঘণ্টার জায়গায় অতিরিক্ত সোয়া ঘণ্টা পর চরের নিশানা পেলে সবাই উৎফুল্ল। চুলো, হাঁড়ি-পাতিল, সদাই নিয়ে এবার ছোট ডিঙিতে চড়ে পর্যায়ক্রমে হতে লাগল। এক সময় আমিও কয়েজনসহ ডিঙিতে চড়লাম। তীরে ভিড়ার কাছাকাছি ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটে গেল। আনন্দে ডিঙির আগায় ফটোশুট আর বাঁধনহারা ঢেউয়ের ঝাপটায় পল্টি খেয়ে ভিজে গেলাম সবাই। শরীরে ভিজা কাপড়। যখন তাঁবু পাতার জন্য চরের মাঝামাঝি যাই, বুঝতে বাকি রইল না যে আমরা এসেছি নীল জলরাশির বঙ্গোপসাগরের বুকে মাথা উঁচু করা অপার সৌন্দর্যময় নয়নাভিরাম প্রকৃতির সান্নিধ্যে। সবাই বেশ আনন্দিত।
দীর্ঘ পথপরিক্রমার ক্লান্তি যেন সব ঝরে পড়ল। শুরু হলো দে-ছুটের তরুণদের দৌড়ঝাঁপ। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা। শুরু হলো প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব কলাপাতা আর বাঁশের গ্লাস ব্যবহারে খাওয়া-দাওয়া। এগুলো সহজে পচনশীল। খানাপিনা শেষে শুরু হলো কালামের প্রস্তুতি। রাতে হবে তার রেসিপিতে আস্ত কোরালের বারবিকিউ। আমাদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের তীব্রতাও বাড়তে থাকল। পাথুরে কয়লায় আগুন জ্বলল। নাচ-গানের তালে প্রায় ৫ কেজির মাছটা ঝলসাতে দেরি, কিন্তু কাঁটাসহ উদরে যেতে সময় লাগল না। ঠাণ্ডা বাতাসে আর বাইরে থাকা গেল না। পরদিন বিজয় দিবস। উঠতে হবে সাতসকালে। সবাই তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম। রাতে তাঁবুবাস হিসেবে এই চরে কোনো ভ্রমণ দল হিসেবে আমরাই প্রথম। একেক তাঁবুতে দুই-তিনজন। কে কখন ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছি টেরই পাইনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন মাত্র আলো ফুটেছে। ঝটপট তৈরি সবাই।
ধীরে ধীরে পুবাকাশে লাল আভা ছড়িয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের সূর্যোদয়ের জানান দিল। কুয়াকাটা থেকে চরটির অবস্থান পূর্ব-দক্ষিণে। পানিপথে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরবর্তী গাছপালা, জীব-জন্তু ও প্রায়মনুষ্যহীন চর থেকে দেখা আকাশের রক্তিম আভার রূপ অবিশ্বাস্য ভালো লাগার মতো, যা আজীবনের সুখস্মৃতি। এবার আমরা এগিয়ে যাই চরের উত্তরদিকে। উত্তাল বাতাসে লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়ছিল। যতই এগিয়ে যাই মুগ্ধতা ভর করে। চরের চারদিকে সমুদ্র। টালমাটাল ঢেউ আছড়ে পাড়ে রেখে যায় শামুক-ঝিনুক। দূর থেকে মনে হবে শিউলি ফুল। প্রেয়সীর আগমনে যত্ন করে কেউ বিছিয়ে রেখেছে। আরও কিছুটা এগোতেই চোখে ধরা দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। তাদের ভুবনে আমাদের আগমন মেনে নিতে পারেনি।
ভালোভাবে ছবি তোলার আগেই লাপাত্তা। আমরাও আর পাখিদের বিরক্তির কারণ না হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে দক্ষিণে ছুটি। জেলেদের তথ্যমতে, চরটি ২০১৭ সালের শেষদিকে আরিফ রহমান নামে এক শৌখিন পর্যটক কুয়াকাটার বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ে চরটিতে যান। তিনি নাম রাখেন চর বিজয়। আরিফ রহমানের তথ্যমতে, চরটি বর্ষায় অনেকাংশ ডুবে যায় বিধায় এখনও সরকারিভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি। চরটির ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় দারুণ। হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য বঙ্গোপসাগরের বুকে সেন্টমার্টিনের মতো আরেক নয়নাভিরাম লীলাভূমি। দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য নতুন আশার আলো এই দ্বিপটির প্রভূত উন্নয়ন, ভ্রমণপিপাসুদের সহজ যাতায়াত ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার জন্য কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রোটারি ক্লাব অব কুয়াকাটা সি-বিচের সভাপতি মোতালিব শরীফকে অবহিত করি। তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেন।
কীভাবে যাবেন?
সদরঘাট নৌ-টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন কোম্পানির লঞ্চ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত পটুয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সেখান থেকে বাসে বা রেন্ট কারে কুয়াকাটা। এ ছাড়া সায়েদাবাদ ও গাবতলী থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সরাসরি কুয়াকাটা পর্যন্ত যায়। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে ইঞ্জিন স্পিডবোটে পৌঁছে যাবেন সহজেই।
যদি ক্যাম্পিং না করা হয় তাহলে আসা-যাওয়া দুই রাত, আর মাঝে একদিনই যথেষ্ট। সংখ্যায় দুই তিনজন হলে জেলেদের কাছ থেকে মাছ-ভাত কিনে খেতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত পানি ও শুকনো খাবার সঙ্গে নিতে হবে।