অনেকটাই যান্ত্রিক ও একঘেয়েমিতে ভরা রাজধানী ঢাকার জীবনযাপন থেকে একটু ভিন্নতার ছোঁয়া প্রত্যাশা করে অনেকেই। মুক্ত বাতাসে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বা বৈচিত্রময় কিছুর সাথে খানিকটা সময় কাটিয়ে তারা দূর করতে চান নিত্যদিনের ক্লান্তিকে। আবারও সতেজ ও চাঙ্গা হয়ে ফিরে আসতে চান কর্মক্ষেত্রে। আর তাদের জন্যই রয়েছে ঢাকার আশেপাশে ঘুরে আসা যায়, এমন কিছু চমৎকার জায়গা। ছুটির দিনে এসব জায়গায় দিনে এসেই দিনে ফিরে যাওয়া সম্ভব।
আসুন, পরিচিত হওয়া যাক এমন কিছু স্থানের সাথেঃ
১। মৈনট ঘাট
মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত মৈনট ঘাট অবস্থিত ঢাকার দোহারে। সেখানে পদ্মার জলরাশি, নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো অনেক ধরনের নৌকা, নদীর তীরে হেঁটে বেড়ানো লোকেদের দেখলে ক্ষণিকের জন্য আপনার বিভ্রান্তি হতেই পারে যে আপনি পদ্মার পারে নয়, দাঁড়িয়ে আছেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের তীরে।
মৈনট ঘাট ঘোরার উপযুক্ত সময় হচ্ছে বৃষ্টি অথবা একটু ঠান্ডার সময় এবং অবশ্যই বিকেল বেলা। গ্রীষ্মের সময়ে এখানে বাদামের চাষ হয় এবং ঘাটের একপাশ জুড়ে দেখা যায় বাদামের বিস্তীর্ণ ক্ষেত। আবার বর্ষার সময়ে পুরোটা পদ্মার পানিতে তলিয়ে যায়। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। শুকনায় বা শীতের সময়েও এর সৌন্দর্যের কমতি নেই। তখন দেখা যাবে পদ্মা নদীর শান্ত রূপ। একটা সন্ধ্যায় পদ্মা নদীতে সূর্যাস্ত দেখলে পরবর্তী একশোটা সন্ধ্যার কথা মনে থাকবে। ঢাকার আশেপাশে হওয়ার কারণে প্রচুর মানুষ এখানে আসছে, ঘুরছে। স্পিডবোট, ট্রলার বা ছোট্ট নৌকা নিয়ে নদীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকেই। ঘাটের থেকে ট্রলার বা নৌকা নিয়ে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত উপভোগ করা এখানকার মূল আকর্ষণ।
ঢাকা থেকে মৈনট ঘাটে আসার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়টি হচ্ছে গুলিস্তানের গোলাপ শাহের মাজারের সামনে থেকে সরাসরি মৈনট ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বিভিন্ন পরিবহনে চেপে বসা। ৯০ টাকা ভাড়া আর দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টার বিনিময়ে আপনি পৌঁছে যাবেন মৈনট ঘাট। ফেরার সময় একই বাসে আবার ঢাকা চলে আসবেন। মৈনট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে শেষ বাসটি ছেড়ে যায় সন্ধ্যা ৬ টায়।
যারা গাবতলী অথবা সাভারের আশেপাশে থাকেন, তারা হেমায়েতপুর থেকে লোকাল সিএনজিতে সরাসরি নবাবগঞ্জ আসতে পারবেন। ভাড়া ১২০ টাকা।
২। নুহাশ পল্লী
কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে গড়া স্বপ্নভুবন ‘নুহাশ পল্লী’। ৪০ বিঘা জমির ওপর গাজীপুরে অবস্থিত এই বাগানবাড়ি, নুহাশ চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট ও পারিবারিক বিনোদনকেন্দ্র। সবুজ গাছপালা দিয়ে আবৃত নুহাশপল্লীর সবটুকু। নুহাশপল্লীতে ঢুকে একটু সামনে গিয়ে মাঠ পেরিয়ে বামপাশে শেফালি গাছের ছায়ায় নামাজ ঘর। এর পাশেই পুরনো লিচু বাগান। লিচু বাগানেই চিরনিদ্রায় শায়িত সবার ভালোবাসার হুমায়ূন। এই বাগানের উত্তরে জাম ও দক্ষিণে আম বাগান। এছাড়াও রয়েছে অনেক অনেক প্রজাতির গাছ-গাছালী। রয়েছে সুইমিং পুল ও পুকুর। তবে, সব কিছুর উপরে দর্শনার্থীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এর শান্ত-সমাহিত পরিবেশ ও সবুজ শ্যামলীমা।
খুব সহজেই যাওয়া যায় নুহাশ পল্লী। ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রভাতী বা বনশ্রী বাসে চড়ে প্রথমে পৌঁছতে হবে গাজীপুরের হোতাপাড়ায়। সেখান থেকে টেম্পুতে করে যাওয়া যাবে পল্লীতে। এছাড়া মাইক্রো বাসে করেও দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারেন অনেকে। তবে, নুহাশ পল্লীতে ঢোকার জন্য ফি দিতে হয়। এই ফি ১২ বছরের উপরের সবার জন্য ২০০ টাকা।
৩। পানাম নগর
বেশ ব্যতিক্রমধর্মী একটি স্থান এই পানাম নগর। এখানকার পুরনো বাড়িঘর ও স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতেই পার হয়ে যায় অনেকটা সময়। বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক স্থানের একটি এই পানাম নগর। ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড’ ২০০৬ সালে একে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি স্থাপনার একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এই পানামনগর ছিল ঈশাখার আমলে বাংলার রাজধানী। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন কিছু ভবন ও স্থাপনা এখানে রয়েছে, যার সাথে জড়িত বাংলার বারো ভুঁইয়াদের ইতিহাস।
এখানেই রয়েছে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর। এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের অবহেলিত ও নিরক্ষর কারিগরদের হস্তশিল্প, জনজীবনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী। জাদুঘরের বিভিন্ন গ্যালারিতে রয়েছে কাঠ খোঁদাই, চারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, লোকজ অলঙ্কারসহ বহুকিছু। লোকশিল্প জাদুঘরের প্রবেশ ফি জনপ্রতি ২০টাকা।
পানাম নগরের কাছেই রয়েছে মেঘনা নদী। নদী ওপারে রয়েছে কাশবন। আর নৌকা ভ্রমণ করে সেখান থেকে যেতে পারেন কাছেরই মায়াদ্বীপে। নদীর পার বা চরে বসে সেখানকার নির্মল ও মুক্ত বাতাসে কেটে যাবে আপনার নিত্যদিনের জড়তা ও ক্লান্তি। সচল হবেন নতুন করে।
ঢাকার থেকে মাত্র ২৭ কিঃমিঃ দূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁতে অবস্থিত পানাম নগর। খুবই সহজ ঢাকা থেকে এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা। ঢাকার গুলিস্তান থেকে ‘মোগরপাড়াগামী’ যে কোনো বাসে চেপে চলে আসতে হবে সোনারগাঁওয়ের মোগারপাড়া। সেখান থেকে টেম্পুতে করে ১৫-২০ মিনিটে চলে আসা যাবে পানামনগরে। একইভাবে, টেম্পুতে করে অল্প সময়ের ভেতরেই আসতে পারবেন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। অবশ্য ময়না দ্বীপে যেতে হলে ওখানকার মেঘনার ঘাট থেকে ট্রলারে করে যেতে হবে।
৪। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
ঢাকার আশেপাশে ঘুরে আসার মতো অন্যতম চমৎকার জায়গা এই বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। বিস্তৃর্ণ শালবনের ভিতর প্রাচীর ঘিরে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সাফারি পার্ক। ভেতরে ঢুকতেই রয়েছে সরু পাকা রাস্তা। দুদিকে বিস্তৃত নানা প্রজাতির গাছ। এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই সাফারি পার্কটি অনেকটাই গড়ে তোলা হয়েছে থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। চলতে চলতে অনেক ধরনের প্রাণীই সেখানে দেখতে পাবেন। সাফারি পার্কটিতে বন্যপ্রাণীরা বিচরণ করে স্বাভাবিকভাবে। জেব্রা, জিরাফের মতো তৃণভোজী নিরীহ প্রাণী ছাড়াও সেখানে রয়েছে বাঘ, সিংহের মতো মাংসাশী প্রাণীও। তবে, সেখানে ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। দুই ইঞ্চি পুরু স্বচ্ছ কিন্তু শক্ত প্লাস্টিকের দেয়াল দিয়ে এসব প্রাণীকে আলাদা করে রাখা হয়েছে অন্যান্য জায়গা থেকে।
পার্ক সম্পর্কে যে কোনো তথ্য জানার জন্য এখানে প্রথমেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু চত্বর, একটি তথ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র। এরপর পার্কের গাড়িতে চড়ে ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পারেন বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, আফ্রিকান চিতা, চিত্রা হরিণ, জলহস্তি, নীল গাইসহ আরো অনেক ধরনের বন্যপশু। তবে, সেটা করতে গেলে জনপ্রতি ফি দিতে হবে ২০০টাকা। সাফারি কিংডমে রয়েছে প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র, জিরাফ প্রজনন স্পট ও পেলিক্যান আইল্যান্ড। শুধু তাই নয়, বিশাল জায়গা নিয়ে রাখা হয়েছে পাখিদেরও। ওয়াচ টাওয়ার থেকেও উপভোগ করতে পারবেন সাফারি পার্কের মনোরম ও আকর্ষণীয় দৃশ্য। ওঠার ব্যবস্থা আছে হাতির পিঠেও।
ঢাকা থেকে গাজীপুরগামী যে কোনো বাসে চড়ে প্রথমে যেতে হবে গাজীপুরে। এরপর টেম্পুজাতীয় যানে করে সেখান থেকে যেতে হবে বাঘের বাজার এলাকায়। সেখান থেকে আরো কিছুদূরে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রবেশপথ।
৫। সাদুল্লাপুর গোলাপ বাগান
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামটি বর্তমানে পরিচিত ‘গোলাপ গ্রাম’ নামে। এখানে বছরজুড়েই গোলাপের গন্ধে ভরে থাকে সারা গ্রাম। বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান ছাড়াও এখানে রয়েছে রজনীগন্ধা, জারভারা ও গ্লাডিওলাসের বাগান। ঢাকার সিংহভাগ গোলাপের চাহিদা এই গ্রামের উৎপাদন থেকেই মেটানো হয়। এক দিনের অবসরে বেড়িয়ে আসতে পারেন গোলাপের এই রাজ্য থেকে।
হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন এখানকার কয়েকটি জমিদারবাড়ি থেকে। এছাড়া বিরুলিয়া ব্রিজের কাছে রয়েছে প্রাচীন ও বিশাল একটি বটগাছ।
এখানে আসতে হলে প্রথমে, উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় নর্থ টাওয়ারের কাছ থেকে লেগুনায় করে দিয়াবাড়ি আসতে হবে। সেখান থেকে মেইনরোড ধরে এগিয়ে লোকাল গাড়িতে বিরুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত গিয়ে আরেকটি অটো ভাড়া করে যেতে হবে সাদুল্লাহপুর গোলাপ গ্রামে।