বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ৭ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ের হিসাব কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত নির্বাচনে পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের নির্বাচনে ৭ সিটির মধ্যে কমপক্ষে ৬টিতে জয় চায় শাসক দল। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস বাকি থাকলেও সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনে জয় এনে দিতে পারবেন এমন মেয়রপ্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। ইতোমধ্যে মেয়রপ্রার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ শুরুর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিকসূত্রে জানা গেছে, আসন্ন সিটি নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থীদের বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপের ভিত্তিতে কোন সিটিতে কাকে মনোনয়ন দিলে ভালো হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনাও দিয়েছেন। রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুরনো প্রার্থীরাই এবার লড়বেন মেয়র পদে। বাকি চার সিটিতে নতুন প্রার্থীদের মনোনয়নের পক্ষে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
আসন্ন সিটি নির্বাচনে রাজশাহীতে আবার দলীয় মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন সাবেক সিটি মেয়র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। সিলেটে সাবেক মেয়র বদরউদ্দীন আহমেদ কামরানের ওপর এবারও আস্থা রাখবে আওয়ামী লীগ। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে বর্তমান মেয়র একরামুল হক টিটু দলীয় মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। পরিবর্তন আসছে রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরশেনে। এই চার সিটিতে নতুন প্রার্থী মনোনয়নের পক্ষে আওয়ামী লীগ।
সেক্ষেত্রে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী হতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, গাজীপুরে গতবারের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম এবার মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ পরিবারের একজনকে ভাবা হচ্ছে মেয়রপ্রার্থী হিসেবে। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের আলোচনায় রয়েছেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত ও ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। দুজনের একজন পাবেন দলীয় মনোনয়ন, তবে কে পাবেন এটি নির্ভর করবে নির্বাচনের আগমুহূর্তের সিদ্ধান্তের ওপর।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ৭ সিটির মধ্যে ৬টিতেই জয়ের লক্ষ্যে কৌশল নির্ধারণের কাজ চলছে। কারণ বড় বিভাগীয় শহরগুলোর এই নির্বাচনের পরই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই সিটি নির্বাচনের ফল জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেই ভাবছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
দলটির নেতারা জানিয়েছেন, রাজশাহী ও সিলেটে মেয়র থাকাকালীন লিটন এবং কামরান যে উন্নয়নকাজ করেছেন, তাতে নিজ নিজ সিটিতে তাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এখনো অন্য যে কারো চেয়ে বেশি। সে কারণে গত নির্বাচনে পরাজিত হলেও আসন্ন নির্বাচনে এ দুজনকেই নৌকা মার্কা দেওয়া হবে। অন্যদিকে ময়মনসিংহে টিটু সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও দলের নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার উপহার হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পাবেন।
বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু গত মেয়র নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দলীয় কোন্দলের কারণে যত সহজে নির্বাচিত হয়েছেন এবারে জাতীয় পার্টি সতর্ক অবস্থানে আছে। মূলত জাতীয় পার্টির সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলেই ভাবছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এমনকি এ সিটিতে আওয়ামী লীগ একটু ভুল করলে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন। সেক্ষেত্রে প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ ও রংপুর-৫ সনের এমপি আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমান দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি প্রতিনিয়ত গণসংযোগ করছেন। নৌকা মার্কার প্রার্থীদের পছন্দের তালিকায় এখন পর্যন্ত তাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বর্তমান মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বলেন, আমি ৫ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রমে কোনো ত্রুটি রাখিনি। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই দল আমাকে আবার মনোনয়ন দিলে জয় এনে দিতে পারব।
অন্যদিকে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গতবার পরাজিত হন সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। এই সিটিতে এবার নতুন প্রার্থী ক্লিন ইমেজের তরুণ নেতা শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগ জিতবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই জুয়েলের প্রতি খুলনার মানুষের আস্থার কথাটিও বিবেচনায় রেখে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ মারা যাওয়ার পর এই সিটিতে নতুন প্রার্থীর কথা ভাবা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বরিশালের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর পরিবারের কাউকেই দলীয় মনোনয়ন দিতে চান দলটির নীতিনির্ধারকরা।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমকে এবার মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার জনপ্রিয়তা স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে বলে জানান নেতাকর্মীরা। জাহাঙ্গীর গত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শেষ মুহূর্তে দলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি বলেন, গাজীপুরে আমার জনপ্রিয়তা গত নির্বাচনেই দেশবাসী দেখেছে। আমি নির্বাচনী মাঠে রয়েছি। মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীদের যেমন সময় দিচ্ছি, তেমনি মেয়রপ্রার্থী হিসেবে সাধারণ জনগণের পাশেও রয়েছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি আরও শক্তিশালী করতে পারব।
সিটি নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত নির্বাচনে ৫ সিটিতে পরাজিত হয়েছিলাম। আসন্ন নির্বাচনে ওই পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করছি। আশাবাদী এবার ৭ সিটিতেই আমাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করবে। ইতোমধ্যেই নির্বাচনের বিষয়ে দলের অভ্যন্তরে কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের অপপ্রচারে ভোটাররা বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু আশা করি এবার ভোটারদের ভুল ভেঙেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, কাদের ভোট দিলে উন্নয়ন হয়। তাই এবার সবকটি সিটিতেই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী সিটি রয়েছে। ইতোমধ্যে ২ সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। সিটি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ এবার শক্তভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সভাপতি কখনো প্রকাশ্যে কাউকে কোনো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন না। তবে ৭ সিটিতে কারা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবেন, এ বিষয়টি উনার মাইন্ড সেটে রয়েছে।
২০১৩ সালের ১৫ জুন একযোগে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরের ৬ জুলাই হয় গাজীপুর সিটির নির্বাচন। এর আগে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটিতে নির্বাচন হয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের শুরুতে ৭ সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কাজ চলছে নির্বাচন কমিশনে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৮ সালের শেষ বা ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ অবস্থায় আগামী বছরের শুরুতেই ৭ সিটিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। ইসির নির্বাচনী রোডম্যাপে পর্যায়ক্রমে প্রথমে রংপুর, এর পর চার সিটি তথা বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট এবং শেষে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা রাখা হচ্ছে। তবে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই ৬ সিটির মেয়াদ কাছাকাছি সময়ে শেষ হবে। তাই অনেক কর্মকর্তা সিটি নির্বাচন একসঙ্গে করার পক্ষে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে আরও জানা গেছে, আসন্ন ৭ সিটি নির্বাচনে কীভাবে জয়লাভ করা যায় তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় বেশ কয়েক নেতা আলাপ-আলোচনা করছেন। দলের ৮ বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিজ বিভাগে সিটি নির্বাচনের কাজ শুরুর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে ৭ সিটিকে জয়ের কৌশল প্রণয়ন করছে আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থীর বিজয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সিটিতে এখন থেকেই দলীয় কোন্দল মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।