বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ষাটোর্ধ্ব গুলমেহের বেগম রাঙ্গুনিয়া রাজা নগর ইউনিয়ন পরিষদে একটি বেসরকারি সংগঠনের দেয়া ত্রাণ নিতে এসেছেন। তিনি বগাবিলীতে পাহাড় ধসে সপরিবারে নিহত নজরুলের মা। মৃত স্বামীর বাৎসরিক মিলাদ দিতে পুরনো বাড়ি পাশের শিয়াল বুক্কায় গ্রামে যাওয়ার কারণে ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনা থেকে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। সোমবার তার সঙ্গে ত্রাণ নিতে এসেছেন প্রতিবেশী সপরিবারে নিহত ইসমাঈলের খালাতো ভাই মতিউর রহমান। পাহাড় ধসে নিহত সন্তানের কথা জিজ্ঞাসা করতেই গুলমেহের বেগমের দুই চোখে নেমে আসে পানি।
তিনি জানান, পেটের দায়ে নিজের বাড়িঘর ফেলে বগাবিলী পাহাড়ি অঞ্চলে খামার বাড়িতে থাকেন। সেখানেই তার ছেলে নজরুল পরের জায়গা বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন। তিনি ওই দিন প্রাণে বেঁচে গেলেও পাহাড় ধস কেড়ে নিয়েছে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিকে।
পাহাড় ধসে নিহত ইসমাঈলের খালাতো ভাই মতিউর রহমান বলেন, ইসমাঈলের সঙ্গে তাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল ২০০ ফুট। ঘটনার আগের দিন রাতে সাহরি খেয়ে শরীর খারাপ বলে ঘুমাতে গিয়েছিলেন ইসমাঈল। সবাই যখন গভীর ঘুমে তখন শুরু হয় পাহাড় ধস। ২০০ ফুট দূরের পাহাড়ের মাটি তেড়ে আসে তাদের ঘরের ওপর। সাহরি খেয়ে ঘুমাতে গেলেও ঘুম না আসায় ভাগ্যক্রমে পাহাড় ধসের আওয়াজ টের পেয়েছিলেন মতিউর। সে বউ-বাচ্চা নিয়ে বের হলেও প্রতিবেশী নজরুল ও খালাতো ভাই ইসমাঈলের পরিবারের সবাই মারা যান।
মতিউর আরও বলেন, আমাদের চেয়েও ঝুঁকিতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এখনও বাস করছেন এ এলাকার আরও শত শত বাসিন্দা। এটা ছাড়া তাদের আর কোনো থাকার ঘর না থাকায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হয়। সরেজমিন রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার মধ্যম নোয়াগাঁ বৈদ্যঘোনা এলাকায় দেখা গেছে, এখানে অর্ধশতাধিক পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকছে। সেখানকার বাসিন্দা কোহিনুর আক্তার (৬০) বলেন, তার ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে থাকেন। কর্ণফুলী নদীভাঙনে সরফভাটা ইউনিয়নের ভূমিরখীল থেকে ১৫ বছর আগে তারা এখানে এসেছেন। নিজেদের কোনো ভিটাবাড়ি নেই।
তিনি আরও বলেন, রাঙ্গুনিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধসে মৃত্যুর খবর তিনিও পেয়েছিলেন কিন্তু কি করবেন। যেখানে দুই বেলা দুই মুঠো ভাত তাদের ঠিকমতো জোটাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে অন্য কোথাও গিয়ে বসতঘর নির্মাণ তাদের চিন্তার বাইরে। তার মতো করে এ এলাকার কুলসুমা বেগম (৩৫), রাহেলা আক্তার (৫২), হুমায়ারা বেগমসহ (৪৮) প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার একইভাবে পাহাড়ের কোলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন।
এদিকে উপজেলার রাজানগর, ইসলামপুর ইউনিয়নে ২২ জন পাহাড় ধসে মারা গেলেও এখনও শতাধিক পরিবার মৃত্যুঝুঁকিতে বাস করছে। একইভাবে পৌরসভার ইছাখালীর আদিলপুর, গুচ্ছগ্রাম, জাকিরাবাদ, পোমরা, বেতাগী, পারুয়া, দক্ষিণ রাজানগর, লালানগর, হোছনাবাদ, চন্দ্রঘোনার বনগ্রাম, সরফভাটা, পদুয়া, কোদালা, শিলক ইউনিয়নসহ রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার মৃত্যুঝুঁকিতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস করছে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মাইকিং ও সচেতন করলেও তারা এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা থেকে সরছেন না। তবে সরকারিভাবে কোনো আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় তারা কোথাও যেতে পারছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বৃষ্টি এলেই তারা পরিবার নিয়ে ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। ইসলামপুর ইউনিয়নের পাহাড়তলী ঘোনায় ছয় পরিবারের ১৪ জন মারা গেলেও এ মৃত্যুপুরীতে বসবাস করা স্থানীয় কৃষক মোতালেব মিয়া জানান, মাইকিং করে সচেতন করলেও আমরা নিরুপায়। তারা মাইকিং করে সরে যেতে বলছেন কিন্তু কোথায় যাব তাতো বলছেন না। আমরা গরিব মানুষ যাব কোথায়। মৃত্যু তো একদিন হবে তাই সে বিশ্বাস মনে রেখে ঝুঁকিতে হলেও এখানে বাধ্য হয়ে থাকছি।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, রাজা নগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের মতো পাহাড় ধসের ঘটনা যাতে আর না হয় মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছি। প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। পাহাড় ধস থেকে বাঁচাতে জরুরি সময়ে নিকটস্থ সরকারি প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যেতে বলা হচ্ছে।