আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতাকর্মীদের চাপে রেখেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্তরা। জাপার শীর্ষ নেতাদের নামে মামলার পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং রংপুর ও খুলনাসহ দেশের বেশকিছু স্থানে জ¦ালাওপোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা ও রংপুরে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় জাপার অনেক নেতা এখনও কারাগারে। তবুও ছাত্র-জনতা এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারও জাপার প্রতি অবিচার করছে। শীর্ষ নেতাদের এমন বক্তব্যে বরফ গলছে না সরকার পক্ষের। অন্যদিকে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বের বিরোধিতা করে যারা রওশন এরশাদকে সামনে রেখে রাজনীতি করছেন, তারাও বর্তমানে আত্মগোপনে। আবার রওশনের অন্যতম মুখপাত্র এরশাদ ট্রাস্টের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ গ্রেপ্তার হয়েছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে জাপা চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা সংবাদ সম্মেলন ও দলীয় অভ্যন্তরীণ সভা করছেন। সমসাময়িক ইস্যুতে তারা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথাও বলছেন। অবশ্য গত কয়েক দিন সংবাদ সম্মেলন বা দলের কোনো আয়োজনে আসছেন না তারা। বিবৃতিও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ দলীয় কার্যালয়ে নিয়মিত এলেও বাকিরা যে যার মতো বাসায় আছেন।
অন্যদিকে, বার্ধক্যজনিতা সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত রওশন নিজ বাসাতেই সময় কাটাচ্ছেন। তবে এই গ্রুপের অন্যতম নেতা গোলাম মসীহ, রওশনপুত্র সাদ এরশাদ ও মশিউর রহমান রাঙ্গার খবর কেউ বলতে পারছে না। অনেকে বলছেন, রাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। আর রওশনের মুখপাত্র ও এরশাদ ট্রাস্টের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদের গ্রেপ্তারের গুঞ্জন রয়েছে। তবে কোনো রাজনৈতিক মামলায় নয়, গত সপ্তাহে ধর্ষণ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যদিও দলের বা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কেউ বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর ‘নানা নাটকীয়তার’ মধ্যদিয়ে দলটির দায়িত্ব নেন জিএম কাদের। পরে সম্মেলনের মধ্যদিয়ে চেয়ারম্যান পদ পাকাপোক্ত করেন জিএম কাদের। তখন থেকেই দলের একটি অংশ কাদেরের নেতৃত্বের প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এসেছে। তখন রওশন এরশাদ অসুস্থ অবস্থায় ভিডিও বার্তায় দেশের বাইরে থেকে দুই পক্ষকে এক হয়ে দল বাঁচানোর নির্দেশনা দেন। যদিও ওই নির্দেশ আলোর মুখ দেখেনি। বরং বিদ্রোহী অংশ রওশনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রতিনিয়ত জিএম কাদেরকে চাপে রাখে। যে কারণে রওশন, তার পুত্র সাদ ও মশিউর রহমান রাঙ্গা গত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি।
জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন একাধিক নেতার ভাষ্য, নির্বাচন এলেই জাতীয় পার্টি এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়ে। ২০০৮ সাল ছাড়া বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোর আগে এমনটাই দেখা গেছে। দলের নেতৃত্বে টানাপড়েনের সুযোগ নিয়ে বারবার অদৃশ্য সুতায় টানে নড়তে হয়েছে জাপাকে। এবার অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পরও সংকটে রয়েছে দলটি। তবে অতীতের মতোই নাটকীয়তা শেষে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে বলে দৃঢ় বিশ^াস দলটির নীতিনির্ধারকদের।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরি হলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং দল থেকে ৩৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। উপনেতা হন জিএম কাদের। ওই নির্বাচনের আগে এরশাদের রহস্যজনক অসুস্থতা ও সিএমএইচে ভর্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যান।
আর ২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পাটি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন এরশাদ। উপনেতা বানান ছোট ভাই জিএম কাদেরকে। এর কিছুদিন পরই জিএম কাদেরকে সরিয়ে এরশাদ পুনরায় স্ত্রী রওশনকে উপনেতার দায়িত্ব দেন। পরে এরশাদ মারা যাওয়ার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি। সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে রওশনপন্থিরা দলীয় মনোনয়ন পাননি। জিএম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা। পরে জিএম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হন।