টার্গেট কিংলিং থেকে জিম্মি করে হত্যা। একটি পর একটি পর্যায় অতিক্রম করছে জঙ্গিরা। কেউ জানে না পরবর্তী অ্যাকশন কী হয়। নিত্য এক আতঙ্কে প্রতিটি মানুষ। কখন এই আক্রমণ হলো তা যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে তখনই হয়েছে যখন বাংলাদেশ উন্নয়ন মহাসড়কে তার দৃপ্ত পদচারণা ঘোষণা করেছে। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, বড় মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের সময় সামাজিক অগ্রগতির প্রতিটি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বাংলাদেশের অগ্রগতিকে টেনে ধরতেই এই আক্রমণ। এবং টার্গেট করা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ আর বিদেশি নাগরিক। লক্ষ্য একটাই, বিশ্বের কাছে এই বার্তাই দেয়া যে, বাংলাদেশে আসা যাবে না, এলে খুন হতে হবে।
রাজধানীর গুলশানে যাদের হত্যা করা হলো, তারা কেউ কি কারো কোনোদিন ক্ষতি করেছিল? শান্তিপ্রিয় কিছু মানুষ নিজস্ব সময় কাটাতে গিয়ে নৃশংসভাবে মারা গেলেন। জিম্মি ঘটনার পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় ঐক্য দরকার।
ঠিক এটাই এখন সর্বত্র উচ্চারিত শব্দ। বাংলাদেশকে বন্দী করতে উদ্যত অন্ধকারের শক্তি। সময় এখন সবটুকু শক্তি দিয়ে মুক্তির পথ তৈরি করা। একটির পর একটি ঘটনা, একের পর এক খুন। প্রতিটি হত্যা মানুষকে কাঁদায়। সর্বশেষ গুলশানের ঘটনায় স্তম্ভিত বাংলাদেশ।
কিছুদিন আগ পর্যন্ত দাবি ছিল মুক্তচিন্তার মানুষের নিরাপত্তার বিষয়। তারপর এলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রসঙ্গটি। এখন আসলে বোঝা যাচ্ছে কেউ বাদ নেই। বাংলাদেশই আজ আক্রান্ত। দক্ষিণ এশিয়া শুধু নয়, পৃথিবীর মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশসমূহের মধ্যে সবচয়ে উদার, অসাম্প্রদায়িক আমাদের বাংলাদেশকে আজ পাকিস্তান বানানোর জোর ষড়যন্ত্র। বুঝতে কি খুব কষ্ট হয় যে, এই প্রচেষ্টা তাদেরই যাদের রাজনীতিই পাকিস্তান আদর্শের?
এদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন দল ও আদর্শের প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে, আছে আদর্শের দ্বন্দ্বও। রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আর ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া হয়। কিন্তু সে অবস্থান টেকেনি। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে উল্টোপথে যাত্রা করে দেশ। হয়ে উঠতে থাকে এক নতুন পাকিস্তান। পাকিস্তানপন্থীদের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংশোধন করে ধর্মকেই করা হলো সবকিছুর অভিজ্ঞান। অথচ এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ অসাম্প্রদায়িক থেকেও প্রকৃত ধার্মিক থেকেছে যুগের পর যুগ। ঘোষিত হলো ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না, তবুও বাংলাদেশ নামের সেক্যুলার রাষ্ট্রটির ওপর একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে আরোপ করতে হয়েছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদশের্র চাপে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে রাজনীতির নামে দেশব্যাপী লক্ষাধিক শুধু মাদ্রাসা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। স্কুল হয়েছে বা হচ্ছে খুব কম। দীর্ঘ সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলো সরকারি ও বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায়, ধর্মভিত্তিক এক অসম শিক্ষাব্যবস্থার ডালপালাও বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া হলো দেশব্যাপী। ধর্মনিপেক্ষ মুক্তচিন্তার সব পথ দ্রুত রুদ্ধ করে এক পশ্চাৎপদ দেশ হলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের নতুন করে আবার উদারতার পথে যাত্রা তাই বারবার আক্রমণের শিকার। দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র যেমন, তেমনি তাদের সাথে পরিকল্পনামাফিক যোগ দিয়েছে সেইসব আন্তর্জাতিক শক্তি যারা ১৯৭১-এ আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, যারা এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশে থাকেন, তারা তাদের প্রভুদের মতোই জাবর কেটে বেড়ান যে, আইএস আছে, এটা সরকার স্বীকার না করায় এসব হামলা হচ্ছে। বিষয়টা এমন যে, আইএস আছে এটা মেনে নিলেই টার্গেট কিলিংসহ জঙ্গি হানা বন্ধ হয়ে যাবে। বিষয়টি কি সত্যি তাই?
আসলে এই কুতর্কের মধ্যে এক সত্য লুকায়িত। বাংলাদেশকে মানতে হবে যে আইএস আছে। আর তা মানলেই শুরু হবে তাদের আবদার যে তারা সাহায্য করতে দিতে হবে। তাদের গণতন্ত্র রপ্তানিতে আজ সিরিয়া গৃহযুদ্ধে নিপতিত, দেশটি বস্তুত এখন ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। নাগরিকদের জন্য এক অসাধারণ কল্যাণরাষ্ট্র লিবিয়ায় আজ কোনো সরকারই নেই। বিভিন্ন উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শুধু সন্ত্রাস করে বেড়ায়। ইরাক, ইয়েমেন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এদের সাহায্য নিয়ে আজ আতঙ্কের জনপদ।
বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশই সমাধান করবে। কারো সাহায্য নামক উৎপাতের প্রয়োজন নেই। অতীতে বাংলাদেশ এর চেয়ে বড় সমস্যা মোকাবেলা করে সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঐক্যের কথা বলেছেন। সত্যি তাই এখন বিভক্তি নয়, মহাশত্রু দমনে আদর্শিক রাজনীতির জাতীয় ঐক্য চাই। জনগণের শক্তিশালী প্রতিরোধ দরকার।
জঙ্গিবাদের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশে আজ ভাবতে হবে কেন আমাদের তারুণ্যের এমন মগজ ধোলাই কী করে হয় হয় যে, তারা এমন সহিংস হয়ে উঠে, তারা বিপথে চলে যায়? ধর্মান্ধ রাজনীতি যেমন সমস্যা, সমস্যা লুটেরা রাজনীতিও। এ নিয়ে আরা রাজনীতি করার সময় নেই দেশের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক রাজনীতির ঐক্যই বিশ্বমানবতাবিরোধী এমন উগ্র শক্তিকে জনগণের শক্তিতে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।