সুনামগঞ্জে এবার শশার উৎপাদন ভাল হয়েছে। এমন দাবি করেছেন শশা উৎপাদনকারী চাষীরা। তবে গতবছর প্রাকৃতির দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক চাষী এবার শশার চাষ করেননি। যারা করেছেন তারা লাভবান হয়েছেন। উৎপাদন হয়েছে বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতি বছর রমজান মাসে শশার কদর বাড়ে। প্রতিদিন ইফতারের সময় সালাদে শশার প্রয়োজন হয়। এজন্য এই মৌসুমে এবার সুনামগঞ্জের সুস্বাদু শশার কদর বেড়েছে। জেলার বিভিন্ন হাটবাজার ছাড়াও আশপাশের জেলার বাজারেও বিক্রি হচ্ছে এই শশা।
সুনামগঞ্জের সুরমার উত্তরপাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও সীমান্তবর্তী উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় শশা চাষ করেন কৃষকরা। দুই মৌসুমে তিন উপজেলার প্রায় ১৫০০ চাষী শশা চাষাবাদ করেছেন। রবি মৌসুমে শশা চাষাবাদ হয়েছে ১১৫ হেক্টর জমিতে। চলতি মৌসুমে (খরিপ-১ মৌসুমে) শশার চাষ হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমার উত্তর পাড়ের চাষীরা জানান, সারা বছরই শশা উৎপাদন করা সম্ভব। শশার চাষ লাভজনক। ২ কেয়ার জমিতে শশা উৎপাদন করলে খরচ হয় প্রায় ৫৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। যদি বৃষ্টি কম হয়, তবেই শশার উৎপাদন ভাল হয়। অতি বৃষ্টিতে শশার সামান্য ক্ষতি হয়।
গত তিন বছর ধরে শশার জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার বর্জন করে আসছেন সুরমার উত্তরপাড়ের বেশির ভাগ চাষী। এবার যারা ‘শীলা’ নামের শশা উৎপাদন করেছেন তারা বেশিরভাগ জমিতে জৈব সার ব্যবহার করেছেন। ‘শীলা’ শশার দাম বেশি এবং খেতে সুস্বাদু।
সুরমার উত্তরপাড়ের জাহাঙ্গীরনগর ও সুরমা ইউনিয়নের পশ্চিম বেরীগাঁও, কৃষ্ণনগর, ঢালাগাঁও, কোনাগাঁও, গোদীগাঁও, ঝরঝরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা শশা উৎপাদন করছেন। এসব এলাকার কৃষকরা এবার শীলা শশা উৎপাদন করেছেন বেশি। ‘শীলা’ শশা-সবুজ রঙের, সাইজে বড়, লম্বা আকৃতির, ওজনও বেশি এবং শশার গাঁয়ে ফুলের মতো ছড়িয়ে থাকে সাজানো দানা। এছাড়াও ‘আলবী’ জাতের শশা চাষাবাদ করেছেন তারা। এই শশা সাদা ও সবুজ রঙের হয়। এই অঞ্চলে চাষাবাদ করা অন্যান্য শশার মধ্যে ‘মেটাল’ শশা। এটি সবুজ রঙের। ‘ময়নামতি’ শশা, এই শশা লম্বা আকৃতির সবুজ রঙের। ‘এলিন’ শশা, এই শশার উৎপাদন হয় বেশি।
বেরীগাঁও পশ্চিমপাড়ার চাষী মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি গত তিন বছর ধরে শশার চাষ করে আসছি। এবার শশার উৎপাদন ভাল হয়েছে। কৃষক চাইলে সারা বছর শশার চাষ করতে পারেন। রমজান মাসে শশার ভাল দাম পাওয়া যায়। সিলেট অঞ্চলজুড়ে সুনামগঞ্জের শশার চাহিদা রয়েছে রমজান মাসে। আমি ২ কেয়ার জমিতে শশার চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। এবার কমপক্ষে পৌনে ২ লাখ টাকার শশা বিক্রি করতে পারবো। এখনও ক্ষেত ভর্তি শশা। এবার ‘শীলা’ শশা উৎপাদনে জৈবসার ব্যবহার করেছি। আগামী বছর সকল জাতের শশার জমিতে জৈবসার ব্যবহার করব।’
পাশের শশা ক্ষেতের মালিক মো. ইকবাল হোসেনও একই ধরনের মন্তব্য করলেন। তিনি বলেন, ‘দেড় কেয়ার জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ৪৬ হাজার টাকা। যে শশা উৎপাদন হয়েছে তা বিক্রি হবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ৬৫ হাজার টাকার বিক্রি করেছি।’ তিনি বলেন, ‘জৈব সার জমিতে স্থায়ী থাকে। এ সার দিয়ে ‘শীলা’ শশা উৎপাদন করব। এই শশা খুবই সুস্বাদু। দামও পাওয়া যায় বেশি।’
চাষী উবায়দুল্লাহ্ ও আব্দুল হামিদ বলেন,‘ময়নামতি’ শশা এবং ‘এলিন’ জাতের শশার উৎপাদন ভাল হয়। এই শশাও জৈবসারে উৎপাদন করলে ভাল হয়। রমজান মাসে বা ঈদের সময় শশা বেশি দামে বিক্রি করা যায়।’
ঢালাগাঁওয়ের চাষী হাফেজ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি গত তিন বছর ধরে ‘শীলা’ শশা উৎপাদন করছি। রাসায়নিক সার একবারও ব্যবহার করিনি। জৈবসারের স্থায়িত্ব বেশি। এই জন্য আমার এবার দেড় কেয়ার জমিতে মাত্র ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শশা বিক্রি শুরু হয়েছে রমজানের শুরু থেকেই। বিক্রি আসবে প্রায় ১ লাখ টাকা।’
ঢালাগাঁওয়ের আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও শশার চাহিদা তেমন ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে। এখন রমজানে, ঈদোৎসবে, বিবাহ উৎসবে বা খাবারের নানা উৎসবে ‘শশা’র চাহিদা ব্যাপক। তাই শশা উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে।’
কোনাগাঁওয়ের আমির হোসেন বলেন, ‘শশা উৎপাদনে লাভ বেশি। যারা উৎপাদন করেন আর যারা কিনে নিয়ে বিক্রি করেন উভয়ে লাভবান হন। প্রচার আছে শশা খেলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা যায়। জান ঠান্ডা হয়, হজম-শক্তি বাড়ে।’
ঝরঝরিয়ার গ্রামের চাষী রাসেল আহমদ বলেন,‘শশা লাভজনক ব্যবসা। সকল বয়সের মানুষের প্রিয় খাবার শশা। এ জন্য শশার চাহিদা বেশি।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বশির আহমদ সরকার বলেন,‘শশা উৎপাদনে এবার লাভবান হয়েছেন সুনামগঞ্জের চাষীরা। সুনামগঞ্জের চাষীরা এবার নিজের জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় শশা রফতানী করেছেন। আগামী মৌসুমে আরও বেশি শশা চাষ যাতে হয়, কৃষি বিভাগ সেই চেষ্টা করবে।