আমার বর্তমান বসবাসের স্থানে আসার পর জেনেছিলাম বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ বার হয়েছে বেশ অনেক বৎসর আগে। এখানে ধার্মিক মুসলমান সংখ্যায় বেশী। আর যাঁরা অনুষ্ঠান করতেন তাঁরা সংখ্যায় কম আবার ব্যস্ততার কারণে করে উঠতে পারেননি ইত্যাদি। আমার কাছাকাছি সময়ে এখানে আসা কিছু মানুষ মিলে অনেক বৎসর পর বাংলা অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।
সেই অনুষ্ঠানে কি শাড়ী পড়া হবে তা যখন ঠিক করার সময় হলো আমি প্রথমেই বলেছিলাম, সাদা শাড়ী লাল পাড়। প্রায় সবাই রাজী। একজন মনে হলো কিছুটা রাজী নয়। পরে জানলাম সে বেশ আপত্তি করেছিল। আমরা সবাই সাদা শাড়ী লাল পাড় পড়েছিলাম। সে অনুষ্ঠানে অন্য রঙ-এর শাড়ী পড়েছিল। আমি তখনো বুঝিনি কেন।
পরে বুঝেছি, সাদা শাড়ী লাল পাড় তার কাছে হিন্দুদের পোশাক! এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। সম্ভবত তার আগে আমি দেশ থেকে তার জন্য লাল শাড়ীতে কালো প্রিন্ট রাজশাহী সিল্ক উপহার দিয়েছিলাম। আগে জানলে লাল-সাদা শাড়ী আনতাম! আমি সারাজীবনই খুব কম সাজ গোজ করি। জীবনে ক’দিন মেইক আপ, লিপস্টিক দিয়েছি বলে দিতে পারবো। একটাই সাজ, কপালে গোল টিপ, লাল বা কালো। শাড়ী বা সালোয়ার কামিজ পড়লে।
এখানে আসার পর বুঝতাম না কেন সবাই আমার কপালের দিকে তাকায় নিমন্ত্রণে শাড়ী বা সালোয়ার কামিজ পড়ে গেলে! একদিন একজন জিজ্ঞাসা করলো, কোনো কারণ আছে কি না “লাল” টিপের পেছনে? আমি আশ্চর্য্য হয়ে উল্টো জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো কারণ লাগবে নাকি? শাড়ী পড়া নারীদের টিপ দেওয়া তখনো দেখিনি এখানে। ধীরে ধীরে এগুলো লক্ষ্য করতে শিখলাম!
দু’ একজন টিপ দিলেও লাল বা কালো নয়, সোনালী, রুপালী ধরণের এবং গোল টিপ নয়। এক নিমন্ত্রণে বেশ কিছু নারী গল্প করতে করতে আমাকে একজন বললেন, “কিছু মনে করো না। আমি অনেকদিন পর্যন্ত ভেবেছি তুমি মুসলমান নও।” অন্য আরেকজন বললেন, “আমিও তাই ভেবেছি।” আরেকজন বললেন, “বুঝেছি ও টিপ দেয় তাই!” আরেকজন বললেন, “ওর নামের জন্য ভেবেছেন?” (আমার ডাক নাম লোপা।) আমি প্রথমজনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ” কিছু মনে করবো কেন? আমাকে দেখে তো কিছু বোঝার কথাও নয়, আমি মুসলমান বা অন্য কিছু।”
আমি যাদের কথা বলছি তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত, চাকুরীজীবী।
আমি বুঝতে শিখলাম, বাংগালীর সাজ “মুসলমান”, “হিন্দু” ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত! অল্প বয়সে হাল্কা রং প্রিয় ছিল। এখন অনেক রং ভালো লাগে। আমার কাপড়ের রং সাদা, কালো আর লাল সবচেয়ে বেশী। আর লাল-সাদা কম্বিনেশন ভীষণ প্রিয়। এই কম্বিনেশনে বেশ কয়েকটি শাড়ী আছে। পহেলা বৈশাখে যে কোনও একটি পরলেই হয়।
মন যদিও ভালো নেই, দেশের-পৃথিবীর বিরতিহীন নেতিবাচক খবরে। বাংলাদেশের এত এত নেতিবাচক খবর প্রতিদিন জানতে হয় যে মন ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। তবুও পহেলা বৈশাখে মেলায় যাবো। এখানে কয়েক বৎসর ধরে মেলা হচ্ছে। বেশ কয়েক বৎসর আগে এক মিটিং-এ কি কি অনুষ্ঠান করা যায় বৎসরে এবং কখন, এসব আলোচনায় আমি বলেছিলাম, পহেলা বৈশাখে মেলা করলে কেমন হয়? সে বৎসর থেকে মেলার আয়োজন হচ্ছে এখানে।
এক সময় বাংলা অনুষ্ঠানে দর্শক ক’জন আসতে পারে তা নিয়ে চিন্তিত থাকতে হতো। কোনো ডকুমেন্টারি শো করলে কুড়ি জন আসলেই মনে হতো খারাপ নয়! কোনো রিহার্সেল ছাড়াই বিশেষ দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ধার্মিক মানুষরাও অনুষ্ঠান দেখা শুরু করেছেন ধীরে ধীরে। অল্প কয়েকটি পরিবার বাদে।
আর গত কয়েক বৎসরে অনেক নূতন মানুষ এসেছে। অনেক উৎসাহী মানুষ আছে তাদের মধ্যে। এখন নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখনো এখানে অন্য জায়গার থেকে ধার্মিক মানুষ বেশী। অবশ্য এখন প্রায় সব জায়গাতেই মানুষ বেশী বেশী করে ধার্মিক হচ্ছেন। যাই হোক এক কালে যেখানে কোনো অনুষ্ঠান হতো না এখানে, এখন নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে। এটা আশার কথা।
দেশে ওলামা লীগ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি করেছে! সবার উচিৎ পাড়ায় পাড়ায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান করা। সাদা শাড়ী লাল পাড় আর টিপ নিয়ে কথা হচ্ছে! সব নারীর উচিৎ শুধু একদিন নয়, যখন ইচ্ছে তখন এই সাজ দেওয়া।
আমি ঠিক করেছি এবার মেলায় গরদ শাড়ী পরবো। আর লাল টিপ তো থাকছেই।