বাজারদর নিয়ন্ত্রণে পরিবহন ব্যয় কমাতে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’ চালু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে পণ্য পরিবহনে কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সাড়া মেলেনি। ট্রেনে পণ্য ওঠানো-নামানোর খরচ, কাঁচা সবজির গুণগত মান নষ্টের সম্ভাবনা ও ট্রেন থেকে পণ্য খালাসের পর নির্ধারিত আড়ত বা মার্কেটে পৌঁছানোর জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষি পণ্য পরিবহনে আগ্রহ নেই।
জানা গেছে, গত ২২ থেকে ২৬ অক্টোবর চারদিনে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় তিনটি কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন চলাচল করেছে। যাতে পরিবহন হয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কেজি পণ্য। এতে রেলের আয় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৯৮ টাকা। রেলের ব্যয়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি রেল কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, রহনপুর থেকে ঢাকাগামী কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকা। এই হিসাবে খুলনা-ঢাকা ও পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে চলাচলকারী স্পেশাল ট্রেনে ব্যয় আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খুলনা-ঢাকা রুটে ২২ অক্টোবর প্রথম কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন চালু হয়। ট্রেনে বিশেষ সাতটি বগির (লাগেজ ভ্যান) মধ্যে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ফল-সবজি ছাড়াও এ ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যানে হিমায়িত মাছ, মাংস ও দুধ পরিবহনের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের বিনা ভাড়ায় ঢাকায় যাওয়ার জন্য রয়েছে ২০টি চেয়ার। বিশেষ এ ট্রেনে প্রতিকেজি সবজি ও কৃষিপণ্য বহনে ১ টাকা ৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ পড়ছে।
চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজারের (পশ্চিম) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২২ অক্টোবর খুলনা-ঢাকা রুটের কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেনে ১ হাজার ৮৬০ কেজি পণ্য বুকিং হয়। এতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৩২০ টাকা। ২৪ অক্টোবর পঞ্চগড়-ঢাকা রুটের ট্রেনে ৭৬০ কেজি পণ্য বুকিং হয়। আয় হয় ১ হাজার ২৯৬ টাকা। ২৬ অক্টোবর রহনপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)-ঢাকা রুটের ট্রেনে মাত্র ২৬০ কেজি পণ্য বুকিং এ আয় হয়েছে ৪৮২ টাকা। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা চলাচলকারী কৃষিপণ্যবাহী এ তিনটি ট্রেনে মোট ২ হাজার ৮৮২ কেজি পণ্য পরিবহন করা হয়। এতে রেলের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯৮ টাকা।
কৃষকরা বলছেন, সরকার পণ্য পরিবহনে ট্রেনের ব্যবস্থা করায় আমরা আনন্দিত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহন করতে রেলকে আরও কিছু সেবা সংযোজন করতে হবে। কৃষক ও কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা জমি থেকে পণ্য সরাসরি ট্রাক-পিকআপে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আড়ত ও কাঁচামালের বাজারে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ট্রেনে পণ্য পাঠাতে হলে যানবাহনে স্টেশনে নেওয়ার ভাড়া গুনতে হয়। কুলিদের দিয়ে ট্রেনে ওঠানো এবং নামাতে হয়। নির্ধারিত আড়ত ও মার্কেটে নিয়ে যেতে পরিবহন ভাড়া দিতে হয়। ট্রেনে পণ্য পাঠাতে চারবার পণ্য লোড-আনলোড করতে হয়। এতে কাঁচা সবজি জাতীয় পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্টেশনে কৃষিপণ্য পৌঁছে দেওয়ার পর সেটি যদি রেল কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে আড়ত বা মার্কেটে পৌঁছে দিতো, তাহলে হয়তো কৃষকরা এ ট্রেনে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হতেন।
বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ ওরফে কুল ময়েজ বলেন, কৃষিপণ্য পরিবহনে ট্রেন চালুর বিষয়টি শুনেছি। তবে এ ট্রেনে পণ্য পরিবহনে কৃষি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা খুব বেশি আগ্রহী হবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ যেখানে জমিতে বসে থেকে ফসল ঢাকায় পৌঁছানো যায়, সেখানে কৃষক বা ব্যবসায়ীরা ট্রেনে পণ্য নিয়ে কেন বারবার ওঠানামা করবেন? কৃষিপণ্য স্টেশনে বুকিং দেওয়ার পর সেটি রেল কর্তৃপক্ষ যদি নিজ উদ্যোগে ঢাকার আড়ত বা মার্কেটে পৌঁছে দেয়, তাহলে অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হতেন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ তা করেনি।
মুলাডুলির কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের কর্মকর্তারা আড়তে এসে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেনের বিষয়ে মতবিনিময় করেছেন। আড়ত থেকে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাঁচামাল পাঠানো হয়। ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে একই ট্রাকে ঢাকার কারওয়ান বাজার, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে কাঁচামাল নিয়ে যান। ট্রেনে কাঁচামাল গেলে তেজগাঁও স্টেশনে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে বিভিন্ন আড়তে নিয়ে যেতে হবে। এতে বাড়তি গাড়ি ভাড়া খরচ হবে। রেল কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা যদি স্টেশনে পণ্য বুকিং দেওয়ার পর নির্ধারিত আড়ত বা মার্কেটে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে ব্যবসায়ীরা ট্রেনে পণ্য পরিবহনে বেশি আগ্রহী হবেন।
পাকশী বিভাগীয় সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা একেএম নুরুল আলম জানান, পণ্য পরিবহনের সময় কৃষক-ব্যবসায়ীরা আরও কিছু সেবা আশা করছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, বিশেষ এ ট্রেনের বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ প্রচারণার ব্যবস্থা করলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনে আরও উদ্ধুদ্ধ হবেন। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকেও ট্রেনে কৃষিপণ্য ট্রেনে পরিবহনের জন্য কৃষকদের অবহিত করা হচ্ছে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহ সূফি নূর মোহাম্মদের বলেন, লাগামছাড়া বাজারদর হওয়ার কারণে তড়িঘড়ি করে কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ধরণের ট্রেন পরিচালনায় রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অভ্যস্ত নয় এবং ব্যবসায়ীদেরও ট্রেনটির বিষয়ে ধারণা নেই। প্রচারণার কাজ চলছে। আশা করি এ ট্রেনে পণ্য পরিবহন বাড়বে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (পশ্চিম) সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবির কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু এ মুহূর্তে রেলের পক্ষে এটি সম্ভব না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমরা জানাবো।