বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে জড়িতদের দেশত্যাগ রোধে কঠোর অবস্থানে সরকার। রিজার্ভ চুরির কাণ্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীদের ১৪ জনের পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে। তারা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সেজন্য ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দিয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে ড. আতিউর রহমান পাসপোর্ট ব্লকের আগেই দেশ ছেড়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ৯ বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সরিয়ে নেয় হ্যাকাররা। সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তাব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরসহ ১৪ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর দায় পেয়েছে সিআইডি। এসব ব্যক্তির কেউবা সার্ভার কক্ষ খোলা রেখে, অন্যরা ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে হ্যাকারদের সুযোগ করে দিয়েছেন। এরপর চুরির তথ্য মুছে ফেলতেও ছিলেন তৎপর।
এদিকে মামলার তদন্ত নিজের কব্জায় নিতে চলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সিআইডির টানাটানি। আইন অনুযায়ী মামলাটি তাদের কাছে হস্তান্তরে সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে দুদক। তবে দীর্ঘদিনের তদন্তের দায়িত্বে থাকায় সিআইডি মামলার চার্জশিট নিজেরাই দিতে চায়। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর দুদকের পরিচালক ঈষিতা বনি স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, দ-বিধির ২১ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ২ ধারা ও ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১১০ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ জড়িত কর্মকর্তারা পাবলিক সারভেন্ট। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২০ (১) ধারা অনুযায়ী কেবলমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তদন্তযোগ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অপরাধ ও আইন অনুযায়ী মামলাটির তদন্ত করবে দুদক। এখন সিআইডি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত দুদকের মাধ্যমে মামলার তদন্ত করতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় ইমিগ্রেশন পুলিশকে ১৪ ব্যক্তির পাসপোর্ট ব্লকের জন্য সিআইডি থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে যে কোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তদন্ত সংস্থা ও ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্রে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ১২ জনের নাম-পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছে আমাদের সময়। তারা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের তৎকালীন পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান ওরফে আনিস এ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন মেইন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দিপঙ্কর কুমার চৌধুরী, উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, তৎকালীন উপ-পরিচালক (সুইফট অপারেটর) জিএম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন, কর্মকর্তা একলাস উদ্দিন এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। এ ছাড়া পাসপোর্ট ব্লকের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও দুই কর্মকর্তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি আমাদের সময়।
ড. আতিউর রহমানের ঘনিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিনি কিছুদিন আগে দেশের বাইরে গেছেন, এখনও ফেরেননি। কবে নাগাদ ফিরবেন কিংবা দ্রুতই ফিরবেন কিনা, এটি নিশ্চিত করতে পারেনি ওই সূত্র।
সিআইডি প্রধান মো. মতিউর রহমান শেখ গতকাল বলেন, তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। আমরা প্রাথমিক তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছি, আদালতের নির্দেশ নিয়ে তাদের বিষয়ে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (এসবি) আমরা লিখেছি।
মামলার তদন্তের এখতিয়ার তাদের- এমনটি উল্লেখ করে মামলাটি হস্তান্তরে সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে দুদক। এ ব্যাপারে সিআইডি প্রধান বলেন, দুদক আইনের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে। এটা সত্যি কথা যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারে সেই আইন ঠিকই আছে। কিন্তু এখানে যেহেতু আরও বিদেশি লোকজন জড়িত আছে; হ্যাকার আছে; চীন, ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, উত্তর কোরিয়ার লোকজন আছে। কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে, ফরেনসিক বিষয়গুলো আছে। এসব কারণে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারিনি।
মামলার তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। আরটিজিএসের সার্ভিস দেওয়া সংক্রান্ত ফাইল গভর্নর আতিউর রহমান নিজে স্বাক্ষর করে অনুমোদন দেন। আরটিজিএস সংযোগের কারণে সুইফট সার্ভারের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘিœত হয়। তদন্ত সংস্থার ভাষ্য, হ্যাকারদের সুযোগ করে দিতেই এটা করা হয়েছে। এ ছাড়া অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি দ্বারা সুইফট সার্ভারের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রাইম সিনে (অপরাধ সংঘটনের স্থানে) এনে অপরাধস্থলের তথ্যপ্রমাণাদি পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ৪০ দিন পর্যন্ত গোপন রাখা- ইত্যাদি বিষয় অপরাধমূলক। সুইফট সার্ভারের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহার যোগসাজশের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডি সূত্র বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদেশি দুটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে ক্রাইম সিন থেকে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট হয়ে যায়।
আনিস এ খানের বিষয়ে তদন্ত সংস্থা বলছে, আনিস এ খান তৎকালীন সুইফট কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি সুইফট সার্ভারে আরটিজিএস সংযোগ দিতে সহযোগিতা করেছিলেন।