সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে নিষিদ্ধ করা জামায়াতে ইসলামী এখন প্রকাশ্যে৷ দলটির নেতারা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাচ্ছেন৷ এই বিষয় নিয়ে আইন বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তুলছেন৷ তবে তারা এও বলছেন, অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকার আগের আইন বা আদেশ নাও মানতে পারে৷
নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘বিষয়টি সরকার ও তার নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের ব্যাপার৷’
আর জামায়াত বলছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই আদেশের আর বাস্তবে কোনো কার্যকারিতা নেই৷
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে করণীয় নিয়ে বৈঠক করেন৷ তার মধ্যে ছিলেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান৷ এরপর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান যেসব রাজনৈতিক নেতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে সবার আগে জামায়াতের আমিরের কথা বলেন৷
বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানেও জামায়াতের আমিরসহ আরও কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন৷ জামায়াতের আমির এবং নেতারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরও পরিদর্শন করেছেন৷ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের সভা সমাবেশেরও খবর পাওয়া গেছে৷
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তার সকারের পতনের পাঁচ দিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জামায়াত, শিবির ও অঙ্গসংঠনগুলো নিষিদ্ধ করে৷ সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮৯(১) ধারার ক্ষমতা বলে নির্বাহী আদেশে তাদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়৷
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে৷
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা৷ এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা৷ ওই সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন৷
তবে এর আগে আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে৷ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিলও খারিজ করে দেয়৷ ফলে দলটির নিবন্ধন ছিল না৷
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়াও তৈরি হয়েছিল৷
সর্বশেষ নিষিদ্ধের পর সরকারের অনুষ্ঠানে জামায়াতের উপস্থিতি এবং প্রকাশ্যে আসা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে আগের সরকারের তো একটা গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে৷ আগের সরকারের পতনের পর যারা সরকার পরিচালনা করেন তারা যদি জামায়াতকে প্রয়োজন মনে করেন, কাজ করতে দিতে চান তাহলে ওই গেজেটটি বাতিল করতে পারতেন৷ এটা তো কয়েক ঘণ্টায়ই করা যায়৷ এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ৷ আগের সরকার নাই৷ কিন্তু মন্ত্রণালয় তো আছে৷ একই সময়ে তারা নিষিদ্ধ, আবার তাদের সঙ্গে সরকার বৈঠক করছে, এটা মানুষের চোখে লাগে৷ আইনের শাসন নিয়ে সন্দেহ হয়৷ এখানে সব কাজই তো হচ্ছে৷ এটা কেন তারা করেননি বুঝতে পারছি না৷ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবকে তো আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা থেকে খালাস দেয়া হলো৷’
তবে তিনি এও মনে করেন, ‘অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কোনো সরকার হলে তারা আগের আইন, সংবিধান সবই বদলাতে পারে৷ বিপ্লবী সরকার যেভাবে চায় সেভাবে হতে পারে৷ তবে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে আইনের শাসন নিয়ে কথা ওঠে৷’
একই ধরনের কথা বলেন ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন৷ তিনি মনে করেন, ‘সরকারের পতনের কারণে জামায়াত নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন, তা মূলত অকার্যকর৷ তারপরও সেটা বাতিল না করে জামায়াতকে এভাবে গুরুত্ব দেওয়া সবাই ভালো চোখে দেখছেন না৷ হয়তো সেনাপ্রধান, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে এটা করছেন৷’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে পর্যায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেটাকে আমি অগণতান্ত্রিক মনে করছি৷ আইনের চেয়ে বড় কথা হলো প্রয়োজন৷ এখন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সমাজে কোনো বিভক্তি রাখা যাবে না৷’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের এখন যে তৎপরতা, তা ইতিবাচক৷ তারা মন্দিরে যাচ্ছেন৷ মানুষকে আশ্বস্ত করছেন৷ ভয় দূর করছেন৷ এটা ভালো৷’
জামায়াতে ইসলমীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তিনটি কারণে জামায়াত নিষিদ্ধে পতিত সরকারের আদেশ এখন আর কার্যকর নেই৷ প্রথমত, সরকার বলেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে সহিংতা তার দায় জামায়াত শিবিরের৷ সেই আন্দোলনেই সরকারের পতন হয়েছে৷ শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন৷ দ্বিতীয়ত, সরকার পতনের পর সেনাপ্রধান বৈঠকে জামায়াতের আমিরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ ভাষণে তিনি জামায়াতের আমিরের নাম গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন৷ তৃতীয়ত, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের আমিরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ জামায়াতের নাম রেজুলেশনে আছে৷’
তার কথা, ‘এরপর জামায়াত নিষিদ্ধের ওই প্রজ্ঞাপনের বাস্তব কোনো কার্যকারিতা নেই৷ কাগজে থাকলেও সেটা বাতিলের আর কোনো প্রয়োজন আছে কী না তার আইনগত দিক আমরা খতিয়ে দেখব৷’
নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা সরকারের পলিসি ডিসিশন৷ নতুন সরকার গঠিত হয়েছে৷ তারা কী সিদ্ধান্ত নেন তা দেখতে হবে৷ আরো দুই-একদিন যাক৷ ওনারা এটাকে কীভাবে ডিল করেন তার ওপর নির্ভর করছে৷’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার বলার তখনই থাকবে যদি বিষয়টি আদালতে আসে, বা রাষ্ট্র থেকে যদি আমাকে কোনো অপিনিয়ন দেয়৷ তার আগে আমি কিছু দেখি নাই৷ আমি কিছু শুনি নাই৷’
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি এর আগে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল৷ পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত৷ দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘও নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে৷