অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও বিদেশি কূটনীতিক কারও আহ্বানেই কাজ হচ্ছে না। জামায়াতকে ছাড়ছে না বিএনপি। জোটের ঐক্য, ভোটের ঐক্য ধরে রাখছে দুই দলই। এমনকি জামায়াত ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারতের কূটনৈতিক চিন্তাও বিএনপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্পর্কটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। একইভাবে কয়েক বছর ধরে সারা দেশে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতা জামায়াতকে ঠাঁই দিয়েছেন তাদের দলে। ফুলের তোড়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দল শক্তিশালী করতে কেন্দ্রের নির্দেশ উপেক্ষা করে এ কাজ করেছেন আওয়াম লীগ নেতারা। এদিকে জামায়াতে ইসলামীও হামলা-মামলা ও গ্রেফতার এড়াতে নানামুখী কৌশল নিয়েছে। তারা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে পাড়ি জমানো, বিভিন্ন ছদ্মবেশে অবস্থান করছেন ঢাকাসহ সারা দেশে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘রাজনীতিতে এখন জামায়াত ইস্যু বড় আকার ধারণ করেছে। ’৭১-এ এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। শুধু তাই নয়, বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় তারা সহযোগিতা করেছিল। আরও দু-একটি ইসলামী দলও এ কাজে সহায়তা করে। সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, সরকারের এ দলটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া। একইভাবে সব ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিরও উচিত হবে জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া। এতে শুধু বিএনপিরই নয়, জামায়াতেরও লাভ। আমার ধারণা, জামায়াতকে ছাড়ার পথে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছে। তিনি কোনো মন্তব্য না করলেও জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে ইতিবাচকই মনে হয়েছে। আর জামায়াত যদি রাজনীতি করতে চায়, তাদের উচিত হবে ’৭১-এর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগে লোকের ও ভোটের এত অভাব পড়েনি যে, জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে দলে ভেড়াতে হবে। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীকে দলে ভেড়ানোর কোনো মানেই হয় না।’ তিনি বলেন, ‘ওলামা লীগ, প্রজন্ম লীগ, তরুণ লীগসহ বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াত-শিবির থেকে এসব লীগে যোগদান করে আওয়ামী লীগের বদনাম করছে।’
আড়াই বছরে ৫ হাজার জামায়াত নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে : গত আড়াই বছরে সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় ৫ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত মেয়াদের মহাজোট সরকার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে। আর এখন সেই দলটিরই নেতা-কর্মীদের ‘সাদরে গ্রহণ’ আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ বহু নেতা-কর্মীকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র চার দিন আগে কুষ্টিয়ায় জেলা জামায়াতের রুকন নওশের আলী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের হাত ধরে দল বদল করেন। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর যুবলীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি জামায়াত ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের দল বদলের হিড়িক পড়ে যায়। এরপর দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিন্ন দল থেকে দলে না ভেড়াতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘জামায়াত-বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে নয়, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক যথেষ্ট আছে।’ এ নির্দেশনা অমান্য করে জেলা-উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের নেতাদের দলে ভেড়ান কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি ও মন্ত্রীরা। চলতি বছরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ১৫ দিন আগে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের এমপি মাওলানা আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী জামায়াত নেতা নূর আহমেদকে সোনাকানিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করেন। এর আগে পৌরসভা নির্বাচনের সময় জামায়াত নেতা ওসমান গনি চৌধুরী ও সাতকানিয়া পৌর বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছেন এমপি নদভী। গত বছরের ১২ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা আফজাল হোসেন পিন্টু আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর কিছুদিন আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-বিএনপির সহস্রাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। একই বছর ৬ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্য আবদুস সালামের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতের ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সামছুল আলম দুদু উপস্থিত ছিলেন। গত বছর ১০ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে উপজেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি এবং ভবানীগঞ্জ মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম শতাধিক সমর্থক নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বাঙ্গগড্ডা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বেশ কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। গত বছর ২৪ মে নোয়াখালীতে বিএনপি ও জামায়াতের ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী জেলা নেতার হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ৯ মে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিএনপি নেত্রী ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর রিনা হালিম এবং স্থানীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শরীফ হোসাইনের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতের ২ শতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ৫ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ইউনিয়ন জামায়াতের সহ-সভাপতি সাব্বিরুল হক তালুকদার শামীমের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ইসমাইল হোসাইন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম এ নাসির আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দিনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
সরকারের দিকে তাকিয়ে বিএনপি : সরকার ‘নিষিদ্ধ’ না করলে আপাতত জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই বিএনপির। দলটি বলছে, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করছে সরকার। বিএনপি ছেড়ে দিলেই সরকার যে জামায়াতকে দলে টানবে না— তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের বক্তব্যের পর জামায়াতের বিবৃতি ও বিএনপি মহাসচিবের সংবাদ সম্মেলনে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। বাইরে যত চাপই থাকুক না কেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই সামনের পথ এগোবে বিএনপি। জাতীয় ঐক্য প্রশ্নেও জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সরকার জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে বিএনপি বিষয়টি ভেবে দেখবে। সরকার নিষিদ্ধ করার আগে জামায়াতকে ছাড়বে না বিএনপি। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করায় দলটি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারছে না। সেই হিসেবে জামায়াতকে নিয়ে আগামীতে নির্বাচনে গেলে তাদের ভোটব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হবে মনে করে বিএনপি।
কৌশলে পথচলা : সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতাসহ নানাভাবে কৌশল করে এগোচ্ছে জামায়াত। দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকেই হয় কারাগারে না হয় পলাতক অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যেও দলটির বড় অংশের নেতা-কর্মীরা টিকে আছেন ছদ্মবেশে। সারা দেশের জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন নিজেদের রক্ষার তাগিদে। কেউ ব্যস্ত রয়েছেন ব্যবসা-বাণিজ্যে। সাতক্ষীরা, রংপুর, গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, কক্সবাজার— প্রতিটি জেলা সদরে জামায়াত-শিবিরের নামিদামি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক জামায়াতসংশ্লিষ্টরা। যৌথ মূলধনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারদলীয়দের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছেন। সেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের নিয়োগ দিচ্ছেন। চিরচেনা স্বভাবে এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন। দলের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বিদেশে। ঢাকা মহানগরীর নামকরা একটি হাসপাতালের মালিক হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল এক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি আমার প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে এখন প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতাকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছি।’
১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে অংশ নিয়ে জামায়াত ২০টি আসনে বিজয়ী হয়। এর পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংসদে ছিল তাদের প্রতিনিধি। অনেক পৌরসভা ও উপজেলায় রয়েছেন দলটির প্রতিনিধি। বছরখানেক আগেও জামায়াত-শিবির কর্মীদের রাজপথে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা যেত। এখন প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না জামায়াত-শিবিরকে। এমনকি দলটির আমির, সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের পরও সরব হচ্ছে না। আত্মগোপনে থেকে দু-একটি ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে দলীয় কার্যক্রম। বিহ্বল পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন, ‘জামায়াত-শিবিরের এত নেতা-কর্মী গেল কোথায়!’