বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। জনসমর্থনও বিপুল। অথচ ছোট ছোট এবং ভোটের রাজনীতিতে পাত্তা না পাওয়া দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করতে গিয়ে রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বিএনপিকে। ছোট ছোট কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নেতারা বিএনপির কাছ থেকে সমঝোতার জন্য তিনশ আসনের মধ্যে ১৫০টিতে ছাড় চেয়ে বসে আছেন।
সাধারণ নির্বাচনে ভোটে কখনও না জেতা গণফোরাম নেতা কামাল হোসেনও বিএনপিকে এমন শর্ত দিয়ে বসে আছেন যেটা বিএনপি অগ্রাহ্য করে আসছে বহু বছর ধরে। তিনি বিএনপির সঙ্গে জোটে যেতে রাজি যদি বিএনপি তার পরীক্ষিত বন্ধু জামায়াতকে ত্যাগ করে।
স্পষ্টতই বিএনপি চাপে এবং এ কারণে ‘ছোট’ দলগুলোর নেতারা ‘বড় বড়’ দাবি করে বসছেন। তবে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে এসব নিয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। কারণ, তারা কাউকে বিরাগভাজন করতে চান না।
বিএনপির এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বিদেশে এক দশক ধরে। দুই মামলায় দণ্ডিত তিনিও। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় এখন সময়ের ব্যাপার, যেটা নিয়েও বিএনপিকে উদ্বেগ স্পষ্ট। কারণ এই মামলার শুনানিতে তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
এর আগে ক্ষমতায় থেকে বিএনপি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত। দেশে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট, জঙ্গি উত্থান, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের প্রভাবশালী হয়ে উঠা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেদের পছন্দের লোককে বসাতে বিচারপতির অবসরের বয়স সীমা বাড়ানোসহ নানা বিষয়ে এখনও বিএনপিকে আক্রমণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দলের নেতৃত্বে সংকট, তার ওপর আগামী জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে, কিন্তু দলের অবস্থান স্পষ্ট নয়-এমন পরিস্থিতিতেই বিএনপি আজ পালন করছে তার ৪০ বছর পূর্তি ও ৪১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
আর দলের প্রতিষ্ঠার মাস থেকেই ঘুরে চেষ্টার ঘোষণা আছে বিএনপিতে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ সাংবাদিককে বলেন, ‘এইটুকু বলি মাটির গভীরে যার শিকড় তাকে ধ্বংস করা যাবে না। বিএনপি অতীতের মতই ঘুরে দাঁড়াবে।’
বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিককে বলেন, ‘চার দশকের রাজনীতিতে বিএনপির সবচেয়ে বড় অবদান বাকশাল নামক একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফেরত আনা। সেই দল এক যুগের মত ক্ষমতার বাইরে। সরকারের দমন পীড়ন উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাময়িক অসুবিধা হলেও আশা করি আবারো গণতন্ত্র ফিরে আসবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে।’
বিএনপি নয়, দেশই এখন সংকটে বলে মনে করেন বিনেপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি এটা সত্যি। এটা দেশের জন্য ক্রান্তিকাল। গণতন্ত্রের ওপর হুমকি আসছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে, নৈতিকতার চরম অবক্ষয় হয়েছে। এরকম বাংলাদেশে আমি আগে কখনও দেখিনি।’
বিএপির জন্মকে ‘রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা’ বলা যেতে পারে। সেনাপ্রধান হয়েও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে প্রধানত দলছুট নেতাদেরকে নিয়ে বিএনপির জন্ম দেন জিয়াউর রহমান। ফলে বাংলাদেশ তথা এই অঞ্চলে একটি দলের শুরুতে যে ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, বিএনপিকে সেটা করতে হয়নি।
তবে এরশাদের নয় বছরে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিএনপিতে অবশ্য এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। আবার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে রাজপথে।
তবে প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি বিরূপ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে বর্তমানে কাটাতে হচ্ছে বিএনপিকে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর থেকেই শুরু হয় বিএনপির এই বিপাকে পড়া। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আসনে হেরে যাওয়া বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর নানা চেষ্টা করেছ। কিন্তু সফল হয়নি।
এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি ভোট ঠেকানো, সহিংস আন্দোলন, ২০১৫ সালের সরকার পতনের আন্দোলন-দুই বারই বিপুল বিক্রমে বিজয়ী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরেছে বিএনপি।
এই দুই দফায় দলের সাংগঠনিক শক্তি এবং মনোবলে কতটা টান পড়েছে তা গত ৮ ফেব্রুয়ারি স্পষ্ট হয়ে যায়। দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে আগুন জ্বালানোর ঘোষণা দিলেও রায়ের পর ‘নমনীয় কর্মসূচিতে’ যায় বিএনপি।
এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আলোচনা শুরু হয় গেছে। দুই মাসের মধ্যেই ঘোষণা হবে তফসিল। কিন্তু বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দরীয় সরকারের দাবিতে পাত্তাই দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ।
২০১৩ সালের এই সময়ে বিএনপি যখন এই দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তখন সমঝোতার চেষ্টায় দেশি-বিদেশি নানা উদ্যোগ ছিল। জাতিসংঘও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এবার এমন কোনো উদ্যোগও নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সাংবাদিককে বলেন, ‘বিএনপির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। দেশের এখন যে অবস্থা আমি মনে করি সব দলকে এসে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে।’
‘রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিএনপির ভূমিকা অনেক। দেশের অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে এই দলের সৃষ্টি হয়েছে এবং জিয়াউর রহমান সেই সময় এই দলের নেতৃত্ব দেন। তখন বাংলাদেশের একটা কঠিন সময় ছিল।’
‘আমি মনে করি উনি (জিয়া) অত্যন্ত সাহসী বিরল ব্যক্তিত্ব। সেই দলের আদর্শ নীতি উনি রেখে গেছেন। তিনি গত হয়ে গেছেন। আমরাও হয়তো তার আদর্শ ধরে রাখতে পারিনি।’
বিএনপি ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিককে বলেন, ‘সংকট বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও তারা সংকটে পড়েছে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এবার অনেক কিছুর ভেতরে সবশেষ চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ায় বড় ধরনের সংকটে পড়েছে দলটি। এ অবস্থায় দলীয় প্রধানের মুক্তি, সংগঠন গুছিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নেয়াটা সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়।’ বিএনপির সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে কর্মসূচি দেয়া, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
বিএনপি অবশ্য প্রতিষ্ঠার চার বছরের মধ্যেই নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে, আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে সে সময়ের রাষ্ট্রপ্রধান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হলে বিএনপি প্রথমবারের মতো নেতৃত্বের সংকটে পড়ে। তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাময়িক সময়ের জন্য সরকার ও দলের হাল ধরেন।
জিয়াউর রহমানের পথ ধরেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে দখল করেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। আর দলের সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া। আর এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটাররা বেছে নেয় বিএনপিকেই। দলটির আশা, ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে আবারও তাদেরকেই বেছে নেবে।