সাহেবে নিসাব বা সম্পদশালী হলেন যার কাছে ঋণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্রের অতিরিক্ত স্বর্ণ, রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসায়িক সম্পত্তির কোনো একটি বা সবক’টি রয়েছে, যার সমষ্টির মূল্য সাড়ে সাত তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম) স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) রুপার
সমান হয়
রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যধিক দান করতেন। নবীজির ঘোষণা অনুযায়ী, রমজানে একটি নফল ইবাদতে একটি ফরজের সমান পুরস্কার মেলে। আর একটি ফরজ ইবাদতে মেলে সত্তরগুণ সওয়াব। জাকাত যেহেতু ফরজ ইবাদত, তাই ১ হাজার টাকা জাকাত হিসেবে আদায় করা হলে ৭০ হাজার টাকা জাকাত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায় রমজানে। এ কারণে অনেকেই জাকাত আদায়ের জন্য, জাকাত হিসাব করার জন্য বেছে নেন পবিত্র রমজান মাস। তাই জাকাত ও রমজান যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। জাকাত মূলত সম্পদ ও মনের পরিশুদ্ধির জন্য। কোনো ব্যক্তি তার কাছে জমে থাকা সম্পদ একান্ত তারই যেন মনে না করে। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ জমানোর লোভ ত্যাগ করা হয়, আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায়। সেই সঙ্গে সম্পদ বৃদ্ধির ওয়াদার সুযোগ নেয়া হয়। কারণ জাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়।
জাকাতপ্রাপ্যদের তালিকা দেয়া হয়েছে কোরআনে। গরিব, নিঃস্ব ব্যক্তি, জাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যবস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথের পথিক এবং অভাবী মুসাফির জাকাতের অর্থ ও সম্পদ গ্রহণ করতে পারে।
নিকট আত্মীয়দের জাকাত দেয়া উত্তম। তবে নিজের সন্তান বা তার অধস্তনকে কিংবা মা-বাবা বা তাদের ঊর্ধ্বতনকে, স্বামী স্ত্রীকে জাকাত দেয়া যায় না। এভাবে রাসুলের বংশের কেউ জাকাত নিতে পারেন না। জাকাত দেয়ার সময় মনে মনে জাকাত দেয়ার নিয়ত বা ইচ্ছা করলেই জাকাত আদায় হয়ে যাবে। জাকাত গ্রহীতাকে ‘এটা জাকাতের সম্পদ’ জানানোর প্রয়োজন নেই।
জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে টাকা বা সম্পদের পূর্ণ মালিকানা জাকাত গ্রহীতাকে দিতে হবে। তাই যেসব ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিমালিকানা হয় না যেমনÑ মসজিদ, রাস্তাঘাট, মাদরাসার স্থাপনা, কবরস্থান, এতিমখানার বিল্ডিং এসব তৈরির কাজে জাকাতের টাকা ব্যয় করা যাবে না।
মাদরাসার গরিব-এতিম ছাত্রদের জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জাকাতের টাকা উঠিয়ে থাকেন। এসব টাকা সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের মালিকানায় দিতে হবে। পরে ছাত্ররা তাদের থাকা-খাওয়া বাবদ মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে দিতে পারবে।
জাকাতের টাকায় ব্যক্তিবিশেষকে স্বাবলম্বী করার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজিও দেয়া যায়। ব্যক্তিমালিকানায় নলকূপ, কৃষি সরঞ্জামাদি দেয়া যায়। গৃহনির্মাণ করে অভাবী ব্যক্তিকে মালিকও বানিয়ে দেয়া যায় জাকাতের টাকায়। বিধবা, এতিমের যতœ, তাদের চিকিৎসা, গরিব ছেলেমেয়ের বিয়ে, গরিবদের লেখাপড়া এমন যে কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ করা যাবে জাকাতের টাকায়, শর্ত একটাইÑ অভাবীকে মালিক করে দিতে হবে জাকাতের টাকার।
এসব জাকাত কারা দেবেন, এ ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা হলো স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন সম্পদশালী মুসলিম নর-নারী চন্দ্র বছরান্তে তার জাকাতযোগ্য সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ তথা ২.৫ শতাংশ টাকা বা সম্পদ গরিব বা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবেন। এটিই জাকাত।
ইসলামের দৃষ্টিতে সাহেবে নিসাব বা সম্পদশালী হলেন যার কাছে ঋণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্রের অতিরিক্ত স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা ও ব্যবসায়িক সম্পত্তির কোনো একটি বা সবক’টি রয়েছে, যার সমষ্টির মূল্য সাড়ে সাত তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম) স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) রুপার সমান হয়, তিনিই সম্পদশালী।
স্বর্ণ-রৌপ্যের মূল্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম মূল্য ধরা উচিত। কেননা বর্তমানে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাজারে ২১ ক্যারটের এক ভরি স্বর্ণ বিক্রি করেন ৪৫ হাজার টাকায়, তারা নিজেরা ক্রয় করেন ৪১ হাজার ৭০০ টাকায়, আপনি তাদের কাছে গহনা বিক্রি করতে গেলে মাত্র ৩৮ হাজার টাকা দেবে আপনাকে। একই অবস্থা রুপার মার্কেটের। এক ভরি রুপা বিক্রি হয় ১ হাজার ১০৮ টাকায়। তা কেনা পড়ে ৫৫০ টাকায়। আপনি রুপা বিক্রি করতে গেলে আপনাকে দেবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এসব ক্ষেত্রে আপনি যে কোনো রেটের মূল্য ধরে হিসাব করতে পারেন, আপনি সম্পদশালী কিনা? সাড়ে ৫২ তোলা রুপা ৫৫০ টাকা দরে হিসাব করলে ২৮ হাজার ৮৭৫ টাকার মালিক হলেই আপনি সম্পদশালী। সম্পদশালী ব্যক্তি জাকাত নিতে পারেন না, তার পক্ষ থেকে কোরবানি দিতে হয়, বছরান্তেও সম্পদশালী থাকলে জাকাত দিতে হয়।
জাকাতের টাকা হিসাব করার ক্ষেত্রেও যে কোনো রেটে হিসাব করতে পারেন। তবে মধ্যম রেটে হিসাব করা উত্তম। উচ্চ রেটে হিসাব করলে অবশ্য গরিবরা বেশি পাবে। স্বর্ণকারদের কাছে বিক্রি করলে তারা যে মূল্য দেবে তাও ধরা যায়। এতে গরিবরা কম পেলেও বাস্তবে বিক্রি করতে গেলে তো তা-ই পাবেন।
জাকাত প্রদান সহজ। অন্যদিকে আয়কর হয় অনেক বেশি। আয়কর হয় আয় করলেই। জাকাত হয় বছর শেষে উদ্বৃত্ত থাকলে। তাই কোনো চাকরিজীবী যদি বছরে ১৪ লাখ টাকা বেতন পান, তাহলে তাকে ১৪ লাখ টাকার আয়কর দিতে হয়। তা প্রায় ৭০ হাজার টাকা হতে পারে। অন্যদিকে ওই চাকরিজীবী যদি বছর শেষে ২ লাখ টাকার মালিক থাকেন, তাহলে তাকে মাত্র ৫ হাজার টাকা জাকাত দিতে হবে। মুসলিম নাগরিককে জাকাত ও আয়কর দুটোই দিতে হয়।
যেসব ক্ষেত্রে জাকাত দিতে হয়
জাকাত দিতে হয় স্বর্ণের, রুপার, নগদ সম্পদের, ব্যবসায়িক সম্পদের, জমাকৃত সম্পদের, উৎপাদিত কৃষি ফসলের। চারণভূমিতে চরে বেড়ায় এমন গরু, ছাগল, উট, দুম্বা যখন জাকাত ফরজ হওয়ার পরিমাণে হবে তখনও জাকাত দিতে হবে। ব্যাংকে জমাকৃত যে কোনো ধরনের টাকা জাকাতের সম্পদ হিসাবে গণনায় আসবে। এমনকি ফিক্সড ডিপোজিট হলেও মূল জমাকৃত টাকার জাকাত দিতে হবে।
হজের জন্য জমাকৃত টাকার জাকাত দিতে হবে। তবে হজ কর্তৃপক্ষ বা হজ এজেন্টের কাছে টাকা জমা দেয়া হয়ে গেলে অফেরতযোগ্য টাকার জাকাত লাগবে না। যারা শেয়ার ব্যবসা করেন তারা শেয়ারের মার্কেট ভ্যালুর ওপর জাকাত দেবেন। বীমা থেকে যখন অর্থ পাওয়া যাবে তখন বিগত বছরসহ জাকাত আদায় করতে হবে।
হারিয়ে যাওয়া, চুরি বা ছিনতাই হয়ে যাওয়া সম্পদে জাকাত নেই। ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন ঋণেরও জাকাত নেই। তবে এসব ফেরত পেলে শুধু সংশ্লিষ্ট বছরের জাকাত দিতে হবে। বিগত বছরের জাকাত দিতে হবে না।
বাড়িওয়ালার কাছে অগ্রিম ভাড়া হিসেবে জমাকৃত টাকা, দোকানের জন্য জামানতের টাকার জাকাত দিতে হবে।
ব্যবসার সম্পদের ক্ষেত্রে জাকাত গণনায় কারখানা বা দোকানের মেশিনারিজের মূল্য ধরা হয় না। এভাবে দোকান বা অফিস ডেকোরেশনের জিনিসপত্রের মূল্য জাকাতের হিসাবে আসে না। এসব ক্ষেত্রে শুধু কোম্পানি, কারখানা বা দোকানের আয় জাকাতের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। কারখানার কাঁচামাল যেমন প্রেসের কালি, বস্ত্রকলের তুলা-সুতার মূল্যের জাকাত দিতে হবে।
বাড়ি ভাড়া দিলে শুধু ভাড়া থেকে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হবে। বাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত নেই। গাড়ি ভাড়ার ব্যবসায়ীরা গাড়ি থেকে আয়ের ওপর জাকাত দেবেন। গাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত নেই। তবে যারা গাড়ি বিক্রির ব্যবসা করেন তারা গাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত দেবেন। এভাবে ফ্ল্যাট ও প্লট ব্যবসায়ীরাও ফ্ল্যাট ও প্লটের মূল্যের ওপর জাকাত দেবেন।
মুরগির ফার্ম থেকে ডিম উৎপাদন উদ্দেশ্য হলে ডিমের মূল্যের জাকাত দিতে হবে। মুরগির মূল্যের জাকাত দিতে হবে না। মুরগি এ ক্ষেত্রে কারখানার মেশিনারিজের মতো গণ্য হবে। তবে বয়লার ফার্ম হলে যাতে মুরগির বাচ্চা বড় করা হয় তাতে উৎপাদিত বা পালিত মুরগির বাচ্চার মূল্যের জাকাত দিতে হবে। ফিশারিজের জন্য ভাড়াকৃত বা ক্রয়কৃত জমি বা পুকুরের মূল্যের জাকাত দিতে হবে না। তবে বিক্রীত মাছের মূল্যের ওপর জাকাত আসবে।
যেসব ক্ষেত্রে জাকাত দিতে হয় না
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, ব্যবহৃত কাপড়, ঘরোয়া ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেমন ফ্রিজ, এসি, ফ্যান, কম্পিউটার, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি, থাকার জন্য বাড়ি, আগামী এক বছরের খাবারের জন্য জমাকৃত ধান, গম, চাল, লেখাপড়ার জন্য বইপত্র এবং কৃষি সরঞ্জাম যেমন ট্রাক্টর, মাড়াই মেশিন ইত্যাদিতে জাকাত ফরজ হয় না।
ঋণের টাকায় জাকাত ওয়াজিব হয় না। বরং জাকাতের হিসাব করার সময় জাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাব থেকে ঋণের টাকা বা সম্পদ বিয়োগ হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হলে শুধু আগামী এক বছরে প্রদেয় ঋণের টাকা বিয়োগ হবে। ব্যবসার সম্পদে জাকাত হিসাব করার সময় মহাজন বা মাল সরবরাহকারীকে প্রদেয় টাকা বা সম্পদ বাদ যাবে।
ডায়মন্ডের অলংকার ব্যবহার করলে জাকাত দিতে হয় না। তবে ডায়মন্ডের ব্যবসায়ীরা ডায়মন্ডের মূল্যের জাকাত দেবেন।
ব্যবসায়িক সম্পদে ২.৫ শতাংশ জাকাত দিতে হয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে কোনো বস্তু ক্রয় করার পর তা ব্যক্তিগত ব্যবহারে নিলে তার জাকাত দিতে হবে না। আবার ব্যক্তিগত ব্যবহারের ইচ্ছায় ক্রয়কৃত কোনো বস্তু নিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছা করলেই তা ব্যবসায়িক বস্তু হবে না। যখন তা বিক্রি করবে তখনই তা ব্যবসায়িক বস্তু হিসেবে গণ্য হবে।
কোনো বস্তু বা অলঙ্কার বন্ধক রেখে টাকা উঠালে বন্ধকি বস্তু জাকাতের হিসাবে আসবে না।
প্রভিডেন্ট ফান্ডে যা বাধ্যতামূলকভাবে কেটে নেয়া হয়, এর জাকাত দিতে হয় না। যদি নিজের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত টাকা কাটানো হয় বা জমা রাখা হয় তাহলে অতিরিক্তের ওপর জাকাত আসবে।
রমজানে জাকাত আদায়
জাকাত বছরের যে কোনো সময় আদায় করা যায়। প্রয়োজনীয় সময়ে সহযোগিতা বরং উত্তম। তবে জাকাত আদায়ের জন্য আমরা সাধারণত রমজান মাসকেই বেছে নিয়ে থাকি। এ সময়ে হাতে নগদ টাকাও বেশি আসে, তাই জাকাত দেয়া সহজ হয়। অন্যদিকে সামনে ঈদ থাকে, গরিবরাও যেন তাদের প্রাপ্য জাকাতের টাকায় সুন্দরভাবে ঈদ করতে পারে, এসব বিষয় আমাদের মাথায় থাকে। এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে জাকাত আদায়ে যেন মানুষের কষ্ট না হয়। জাকাত প্রদানের প্রদর্শনীর কারণে স্থানে স্থানে দুর্ঘটনা, হতাহতের কথা শোনা যায়। এসব এড়িয়ে চলতে হবে। শুধু ঈদের কয়েকটা দিন তারা আনন্দে থাকুক, এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হলে চলবে না, তারা যেন সারা বছর নিজেদের আয়ে চলতে পারে এ জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসার কিছু ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হয়। যদি জাকাতের একটা অংশ থেকে প্রতি বছর দু-একজনকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা যায়, তাহলেই এক সময় জাকাতের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে।