বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আমাদের নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ মহাবিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। যা মানুষসহ ছোট বড় প্রতিটি প্রাণীকে ফেলে দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জে। পরিবেশ সুরক্ষায় কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও আজকাল সেগুলোর চর্চা খুব একটা হয় না।
কিতাবুত তাহারাতের পাঠ নেওয়া মাদ্রাসা পড়ুয়ারা নগর-গঞ্জে পরিচ্ছন্নতার দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন না। পরিবেশ আন্দোলনের মহৎ ট্রেনে চেপে অন্যরা যখন অনেক দূর চলে গিয়েছেন, আমরা তখনো প্ল্যাটফর্মেই প্রবেশ করতে পারিনি। সময় এসেছে পরিবেশ সুরক্ষার দাওয়াতে আলেমদের এগিয়ে আসার।
এ জন্য মসজিদ-মাদ্রাসা থেকেই পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন শুরু করতে হবে। এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন দেশ বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও পরিবেশ গবেষকরা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূর আহমাদ ও মো. আবু তালহা তারীফ
ড. মোহাম্মদ আহসানুল হাদী
সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পবিত্র কুরআন থেকে জানতে পারি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, মহামারিসহ যত দুর্যোগ আমাদের ওপর নেমে আসে এগুলো সবই আমাদের হাতের কামাই। আমাদের কর্মযজ্ঞের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য রাসূল (সা.) বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।
বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে তিনি জোর দিয়েছেন। বৃক্ষ নিধন নিরুৎসাহিত করেছেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো পবিত্রতা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। আমরা যেন সমাজটাকে পরিচ্ছন্ন রাখি এটাকে ইমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। যেমন-আমরা যদি যত্রতত্র ময়লা না ফেলি বা পলিথিন ফেলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না করি তাহলে কিন্তু আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। একজন সাহাবি জানতে চেয়েছেন, হে নবি (সা.)! উত্তম কাজ সম্পর্কে আমাকে বলুন। রাসূল (সা.) বললেন, মানুষকে কষ্ট দেয় এমন যে কোনো বস্তু রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেল। এ হাদিসের ওপর যদি আমরা আমল করতে পারি তাহলে তো আমাদের রাস্তাগুলো ঝকঝক করত।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো সামগ্রিকভাবেই আমাদের মূল্যবোধটা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে আমাদের এ অঞ্চলে পরিবেশ সুরক্ষা বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটি সেভাবে চর্চা হচ্ছে না। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় বা উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরব বিশ্বের মাদ্রাসাগুলোতে।
কিন্তু এ চর্চাগুলো রয়েছে। আমাদের এখানে যে চিত্র দেখা যায় সেটা আসলে সচেতনতার অভাব। সেটা ধর্মীয় অঙ্গনে যেমন, সাধারণ অঙ্গনেও একই রকম। এমন না যে, শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পচ্ছিন্নতার চর্চা কম আর সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঝকঝক করে-দুই জায়গাতেই একই দৃশ্য। এবং সেটা কোনোভাবেই মানসম্মত নয়। এক্ষেত্রে আলেমদের উদ্যোগী হওয়ার সময় এসেছে। আলেমরা উদ্যোগ নিলে সব মহলেই সচেতনতা বাড়বে এবং পরিবেশ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
মোহাম্মদ এজাজ
চেয়ারম্যান, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)
ইসলামের আহ্বান শুধু মুসলমান কিংবা মানুষের সুরক্ষার আহ্বান নয়। ইসলামের আহ্বান প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবন সুরক্ষার আহ্বান। আমাদের নবিজির (সা.)-এর বড় পরিচয় হলো তিনি রাহমাতাল্লিল আলামিন বা সমগ্র বিশ্বের যত প্রাণ-প্রকৃতি আছে সবার জন্য তিনি রহমত। একজন সাহাবি মা পাখি ধরে আনলেন। রাসূল (সা.) বললেন, পাখিটি ছেড়ে দাও তার বাচ্ছাগুলো কাঁদছে। এক শিকারি মা হরিণ শিকার করে আনলেন। বাচ্চাগুলোকে দুধ পান করানোর শর্তে নবিজি হরিণের জিম্মাদার হয়ে শিকারির কাছে বন্দি হয়ে গেলেন।
তিনি গাছ কাটতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যদি বুঝতে পার আর অল্প সময় পরই কেয়ামত হয়ে যাবে আর তোমার হাতে তখন একটি গাছের চারা রয়েছে, তুমি সেটি রোপণ করে দাও।’ হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু পর কেয়ামত এটা জানার পর একজন মানুষের প্রধান কাজ কী হবে? সে তওবা করবে, নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে, কান্নাকাটি করবে। এটাই তো স্বাভাবিক কথা।
কিন্তু নজিবি (সা.) বললেন, না, তুমি গাছের চারা রোপণ করো। প্রকৃতি সুরক্ষার ব্যাপারে কতটা গভীর উপলব্ধি থাকলে একজন মানুষের পক্ষে এমনটি বলা সম্ভব। একটি হাদিসে এসে রাসূল মদিনায় গিয়ে দেখলেন, সাহাবিরা খেজুরগাছে কলম দিচ্ছেন ফলন বাড়ানোর জন্য। নবিজি বললেন, কলম দেওয়ার কী প্রয়োজন, বরং এটাকে এটার মতোই বাড়তে দাও। যদিও পরবর্তী বছর ভালো ফলন হয়নি, কিন্তু প্রকৃতি তার নিজের গতিতে চলার যে ব্যাপার-আসলিয়াত বা ফিতরাত যেটাকে বলা হয়, তার বিপরীত করার পক্ষে তিনি কখনো ছিলেন না। আজকের আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানও এদিকেই জোর দিচ্ছে।
প্রকৃতির ফিতরাতের বিপরীত কোনো কর্মযজ্ঞ করা যাবে না। কুরআনেও একই দৃশ্য দেখা যায়। কুরআনে শুধু আল্লাহতায়ালা নামাজ-রোজার কথাই বলেননি-তিনি পানি, মেঘ, উট, গরু, মশা, মাছি, ব্যাঙসহ প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষুদ্র ও বড় সব উদাহরণই নিয়ে এসেছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণগুলো প্রকৃতিতে কত বড় ভূমিকা রাখছে সেটা এখন আমরা বুঝতে পারছি। ইসলামের এ সর্বজনীন আহ্বানকে এখনকার আলেমদের বুঝতে হবে।
আমরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি, মসজিদের মিম্বর ও ওয়াজের ময়দান থেকেও যদি পরিবেশ সচেতনতার কথা বলা হয়, তাহলে আগামী দিনের যে চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবিলা করা সহজ হবে। আমরা শান্তি পাব। প্রতিটি প্রাণ শান্তি পাবে। আর এ শান্তির আহ্বানই ইসলামের চূড়ান্ত আহ্বান।
মুফতি মুহাম্মদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী
খতিব, মনিপুর বায়তুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর-২, ঢাকা
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের মোট বনভূমির আয়তন প্রায় ১৫ ভাগ। একদিকে জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের বনভূমি খুবই কম। অন্যদিকে দিন দিন কমে যাচ্ছে বনভূমির আয়তন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছ কেটে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
মানুষের কাঠ ও জ্বালানি কাঠের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ধ্বংস করা হচ্ছে বনভূমি। নগরায়ণ ও শহরায়নের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেও ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি। বিলুপ্ত হচ্ছে জীবজন্তু ও বন্যপ্রাণী। এতে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণবৈচিত্র্য। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কুরআনি নির্দেশনা ও নূর নবিজি (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর এ কাজের নেতৃত্ব ওলামা হজরতদের থেকে আসাই বেশি যুক্তিযুক্ত। পরিবেশ সুরক্ষার দুনিয়াবি ফায়দার পাশাপাশি আখেরাতের যে অনন্ত লাভ রয়েছে সেটা আমরা ওলামা হজরতরা জানি।
যেমন বৃক্ষরোপণের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা ফসল উৎপন্ন করে আর তা থেকে মানুষ ও পশুপাখি খায়, তাহলে উৎপন্নকারীর আমলনামায় তা সদকার সওয়াব হিসাবে গণ্য হবে’ (বুখারি)। এমনিভাবে কুরআন-সুন্নাহয় পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে অনেক নির্দেশনা ও এসব আমলের অফুরান সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। ওলামা হজরতরা লোভনীয় সব সওয়াবের কথা যদি ওয়াজ-নসিহত ও জুমার খুতবায় অনবরত বলতে থাকেন তাহলে আশা করা যায় আমাদের জাতীয় জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য পরিবেশ সুরক্ষায় আলেমদের এগিয়ে আসা জরুরি।
মুফতি মানজুর হোসাইন খন্দকার
প্রিন্সিপাল, আন-নূর মাদ্রাসা, ঢাকা
পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনে আলেমরাই নেতৃত্বের আসনে থাকার কথা ছিল। দুঃখজনকভাবে এক্ষেত্রে আমরা এতটাই পিছিয়ে যে, পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে মসজিদ-মাদ্রাসা বা আলেম সমাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিতাবে পড়ছি পরিষ্কার পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। বাস্তবে মাদ্রাসার পাশের খালই নোংরায় ভরা। অথবা আমরা আঙিনা পরিষ্কারের হাদিস পড়ি। বাস্তবে আমাদের আঙিনাগুলো ডেঙ্গুর কারখানা হয়ে থাকে। মাদ্রাসা থেকে বা মসজিদ থেকে যদি সপ্তাহে বা মাসে একটি সেচ্ছাসেবী টিম ইমামের নেতৃত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে নামতে পারত, তাহলে এটা দেশে একটা আলোড়নসৃষ্টিকারী উদাহরণ হতো।
আমরা যদি মসজিদ বা মাদ্রাসা থেকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করতে পারতাম সেটাও পরিবেশ সুরক্ষার অনেক বড় উদ্যোগ হতো। আফসোস! এসব আমাদের মাথায় আসে না। ফলে আমরা শুধু থিওরি শিখছি, বাস্তবে তার প্রয়োগ করতে পারছি না। অতীতে চিত্র কিন্তু ভিন্ন ছিল। বড় বড় আলেমরা দারসে যেমন সক্রিয় ছিলেন একইভাবে সমাজেও তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। আসলে এখন সবার ভেতরই দুনিয়ার শান-শওকতের চিন্তা ঢুকে গেছে। ফলে দুনিয়া গড়ার চেয়ে ভাঙার কাজই হচ্ছে আমাদের হাতে বেশি। একটা সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খানকাহভিত্তিক। তখন পির সাহেবরা নিজ নিজ এলাকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে মুরিদদের সবক দিতেন।
দেশের বিভিন্ন দরগায় গেলে দেখবেন মসজিদের পাশে বিশাল বনভূমি, বড় মাঠ, খোলা জায়গা, দিঘি আছে। এখন মসজিদ হচ্ছে কিন্তু মসজিদের পাশে বনায়ন নেই, পুকুর নেই, মাঠ নেই। অর্থাৎ আমাদের মসজিদগুলো কার্যতই পরিবেশ সুরক্ষার মারকাজ ছিল, কিন্তু সেটা এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর দায়ভার আলেমদের পাশাপাশি মসজিদ কমিটি, এলাকাবাসী সবার। এ দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসব ততই আমাদের কল্যাণ।