ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাসাউফের গুরুত্ব ও হকিকত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘তাসাউফ’ বিষয়টি একটি জরুরি
বাস্তবতার নাম। কেননা বাতেনি বা আধ্যাত্মিক রোগব্যাধি যেখানে খোদ শরয়ি দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত, বাস্তবভিত্তিক ও অনুমিত, সেখানে এটি অবশ্যই মানতে হবে, মহান আল্লাহ এসবের সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও নিশ্চিত বর্ণনা করেছেন

তাসাউফের মাধ্যমে একজন মোমিনের দুনিয়াবিমুখতা, আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরকালীন সফলতা অর্জিত হয়ে থাকে, যা ইলম বা জ্ঞানার্জনের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু দুনিয়াপ্রেমিক আলেম বা লোকজন যেহেতু তাসাউফ বিষয়টিকে তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত দুনিয়ার মাল-সম্পদ, যশ-খ্যাতি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকরূপে দেখে থাকে, তাই তারা এটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এটির উদাহরণ হচ্ছে ঠিক তেমন, যেমন ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন লোক যারা স্বাধীন ও মুক্তভাবে দুনিয়াকে ভোগ করতে চায়, তারা আলেমদের হেয় চোখে দেখে থাকে এবং নিজেদের মাঝে আলেমদের সমালোচনা, তাচ্ছিল্য করে থাকে। নতুবা ‘তাসাউফবিদ্যা’ বা বিষয়টি তো খোদ কোরআন, সহি হাদিস ও ফিকহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রের দ্বারাই প্রমাণিত। যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখেও বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত।
শরিয়তের বিধান দ্বিবিধ : ক. ‘জাহির’ বা বাহ্যিক অবস্থাসম্পর্কিত; খ. ‘বাতিন’ বা অদৃশ্য অবস্থাসম্পর্কিত। বাতেনি আমল বা কর্মকা-ের অস্তিত্ব বা কথা পবিত্র কোরআন-হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত হওয়া ছাড়াও তা সবার কাছে একটি স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব ব্যাপার। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য পাপ বর্জন কর।’ (০৬ : ১২০)। এছাড়া ‘হিংসা’, ‘অহংকার’, ‘লোক দেখানো’, ‘সম্পদের মোহ’, ‘সম্মানের মোহ’, ‘কৃপণতা’ ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ আচরণ এবং এসবের বিপরীত ‘ভালো স্বভাব’ ও ‘প্রশংসিত গুণ’ এর উল্লেখের পাশাপাশি প্রথমোক্ত মন্দ আচরণগুলো ত্যাগ, ‘উত্তম আচরণ’ দ্বারা নিজেদের সজ্জিতকরণ এবং প্রথম শ্রেণীর রিপুগুলোর চিকিৎসা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গুণ অর্জনের বিভিন্ন পন্থা কোরআন-হাদিসে বারবার বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। সুতরং এসব ‘বাতেনি’ বা অদৃশ্য আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ তথা মন্দ স্বভাবগুলোকে দূরীভূত করা এবং প্রশংসনীয় স্বভাব-আচরণ অর্জনবিষয়ক জ্ঞান বা বিদ্যার নামই হচ্ছে ‘তাসাউফ’।
যুক্তি-বুদ্ধির বিবেচনায়ও ‘তাসাউফ’ বিষয়টি একটি জরুরি বাস্তবতার নাম। কেননা বাতেনি বা আধ্যাত্মিক রোগব্যাধি যেখানে খোদ শরয়ি দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত, বাস্তবভিত্তিক ও অনুমিত, সেখানে এটি অবশ্যই মানতে হবে, মহান আল্লাহ এসবের সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও নিশ্চিত বর্ণনা করেছেন। তা না হলে মহান আল্লাহর প্রতি অবিচারের অভিযোগ উঠবে, তিনি সেসব রোগব্যাধি, মন্দ স্বভাব সৃষ্টি করেছেন অথচ এসবের চিকিৎসা বলে দেননি। গবেষক ইমামদের পথিকৃৎ হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহবিদ্যার সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘ফিকহবিদ্যা মানে, নফ্স বা মন বা আত্মার ভালো-মন্দ, করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে সম্যক অবগত হওয়া।’ (আততাওদ্বীহ : পৃ-১০)।
সংজ্ঞাটি ‘তাসাউফে’রও অন্যতম একটি সংজ্ঞা হিসেবে পরিচিত। উপরন্তু বাতেনি আমলগুলো যেহেতু অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ বাহ্যিক আমলগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়া না-হওয়া অভ্যন্তরীণ আমলগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায়, ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী তাসাউফবিদ্যাও ফিকহ্রই একটি শাখাবিশেষ। এমনকি ‘তাসাউফ’ অভ্যন্তরীণ বুনিয়াদ বা ভিত্তিমূল হওয়ায় বিবেচনায় ‘ফিকহ’র জাহেরি বা বাহ্যিক বিধিবিধান যেন দ্বিতীয় পর্যায়ের শাখাতুল্য। ‘বাতেনি ইলম’ বা আধ্যাত্মিকবিদ্যার ওই মৌলিক গুরুত্বের কারণে ‘ফিকহ’র এ শাখাটির পৃথক নামকরণ করা হয়েছে ‘তাসাউফ’ শিরোনামে। অথচ বেআমল ও পরকালবিমুখ কিছুসংখ্যক নামধারী মৌলভি ‘তাসাউফ’বিদ্যাকে ‘ফিকহ’বিদ্যা থেকে এমনভাবে পৃথক জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেছেন, যেমন কিনা ফিকহ বা শরিয়ত অন্যকিছু আর ‘তাসাউফ’ ভিন্ন কিছু। (মুফতি রশীদ আহমদ : আহসানুল ফাতাওয়া : খ-১, পৃ. ৫৪৬, এডুকেশনাল প্রেস, করাচি)।
পীর তথা চিকিৎসক বা সংশোধনকারীর কাজ হচ্ছে, তিনি কার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিক রোগ বিদ্যমান, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন মাত্র। রোগ ও চিকিৎসা উভয়ই শরিয়তের মৌলিক দলিল-প্রমাণে বিদ্যমান। রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্র যথাযথ নির্ধারণ করা পীর বা শায়খের কাজ। এক্ষেত্রে পীর-মাশায়েখরা নিজ নিজ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়েও কিছু কিছু ব্যবস্থাপত্র ও পথ্যাপথ্য দিয়ে থাকেন। তা যেহেতু মুখ্য নয়, বরং মুখ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি, তাই তাঁদের এসব প্রক্রিয়া-পদ্ধতি হুবহু কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণের প্রশ্ন অবান্তর।
উপরোল্লিখিত প্রকৃতির পরকালবিমুখ তাসাউফ-বিরোধীদের যদি কেউ কখনও রুহানি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা পরামর্শস্বরূপ বলে, তখন তারা প্রতি উত্তরে বলে থাকে, ‘আজকাল যথাযোগ্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন মনীষীর অস্তিত্ব নেই বা বাস্তবে পাওয়া যায় না।’ তাদের এমন প্রকৃতির যথাযোগ্য চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগটি প্রমাণ বহন করে যে, তাদের চিকিৎসার চিন্তাই নেই এবং তারা রোগকে রোগ মনে করে না। অথচ শারীরিক বা বাহ্যিক রোগব্যাধির চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, সামান্য পেট ব্যথার সমস্যা হলে তখন যে যা-ই বলে সবার কথাই শোনা হয়, সবাইকেই যেন ডাক্তারের মতো হিতাকাক্সক্ষী ভাবা হয়। আর পরকালীন মুক্তির ভাবনা না থাকায় সে ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসকই না পাওয়ার অভিযোগ! এ ক্ষেত্রে একটু গভীরে লক্ষ করলে প্রকারান্তরে কি এমনটি বলা হচ্ছে না যে, মহান প্রভু রাব্বুল আলামিন আধ্যাত্মিক রোগ তো সৃষ্টি করেছেন অনেক; কিন্তু আধ্যাত্মিক চিকিৎসক সৃষ্টি করেননি কাউকে ? তিনি অবিচার করেছেন বান্দাদের প্রতি ? (নাউজুবিল্লাহ!)। অন্য কথায়, তিনি পরকাল বিনষ্টকারী অনেক রিপু বা কারণ সৃষ্টি করে রেখেছেন অথচ সেসব থেকে মুক্তির যথাযথ ব্যবস্থা করেননি ?
এক্ষেত্রে কেউ এমন প্রশ্নও করতে পারে যে, যেহেতু কোরআন-হাদিসে ওইসব আধ্যাত্মিক রোগের চিকিৎসার বর্ণনা রয়েছে, তাই আলেমরা নিজেদের চিকিৎসা নিজেরা করতে পারেন, কোনো শায়খ বা পীর-মুরিদির প্রয়োজন নেই ? এমন ধারণা সঠিক না হওয়ার কারণ হচ্ছে প্রথমত, আধ্যাত্মিক বা রুহানি রোগ নির্ণয় এবং তার যথাযথ ব্যবস্থাপত্র বা চিকিৎসা করতে সক্ষম হবেন তাঁরা, যারা তাসাউফ বিদ্যায় পারদর্শী। অন্য সাধারণ আলেমরা সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দৈহিক বা শারীরিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন চিকিৎসাবিদ্যায় কতকগুলো বই পড়েই কেবল কেউ ডাক্তার হয়ে যান না; বরং বাস্তব চিকিৎসার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হয়; হাতে-কলমে শিখতে হয়। ঠিক তেমন রুহানি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কামিল ওলি বা পীর বা শায়খের শিষ্যত্ব গ্রহণের বিকল্প নেই। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৭)।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

তাসাউফের গুরুত্ব ও হকিকত

আপডেট টাইম : ০৬:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ নভেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘তাসাউফ’ বিষয়টি একটি জরুরি
বাস্তবতার নাম। কেননা বাতেনি বা আধ্যাত্মিক রোগব্যাধি যেখানে খোদ শরয়ি দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত, বাস্তবভিত্তিক ও অনুমিত, সেখানে এটি অবশ্যই মানতে হবে, মহান আল্লাহ এসবের সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও নিশ্চিত বর্ণনা করেছেন

তাসাউফের মাধ্যমে একজন মোমিনের দুনিয়াবিমুখতা, আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরকালীন সফলতা অর্জিত হয়ে থাকে, যা ইলম বা জ্ঞানার্জনের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু দুনিয়াপ্রেমিক আলেম বা লোকজন যেহেতু তাসাউফ বিষয়টিকে তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত দুনিয়ার মাল-সম্পদ, যশ-খ্যাতি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকরূপে দেখে থাকে, তাই তারা এটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এটির উদাহরণ হচ্ছে ঠিক তেমন, যেমন ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন লোক যারা স্বাধীন ও মুক্তভাবে দুনিয়াকে ভোগ করতে চায়, তারা আলেমদের হেয় চোখে দেখে থাকে এবং নিজেদের মাঝে আলেমদের সমালোচনা, তাচ্ছিল্য করে থাকে। নতুবা ‘তাসাউফবিদ্যা’ বা বিষয়টি তো খোদ কোরআন, সহি হাদিস ও ফিকহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রের দ্বারাই প্রমাণিত। যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখেও বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত।
শরিয়তের বিধান দ্বিবিধ : ক. ‘জাহির’ বা বাহ্যিক অবস্থাসম্পর্কিত; খ. ‘বাতিন’ বা অদৃশ্য অবস্থাসম্পর্কিত। বাতেনি আমল বা কর্মকা-ের অস্তিত্ব বা কথা পবিত্র কোরআন-হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত হওয়া ছাড়াও তা সবার কাছে একটি স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব ব্যাপার। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য পাপ বর্জন কর।’ (০৬ : ১২০)। এছাড়া ‘হিংসা’, ‘অহংকার’, ‘লোক দেখানো’, ‘সম্পদের মোহ’, ‘সম্মানের মোহ’, ‘কৃপণতা’ ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ আচরণ এবং এসবের বিপরীত ‘ভালো স্বভাব’ ও ‘প্রশংসিত গুণ’ এর উল্লেখের পাশাপাশি প্রথমোক্ত মন্দ আচরণগুলো ত্যাগ, ‘উত্তম আচরণ’ দ্বারা নিজেদের সজ্জিতকরণ এবং প্রথম শ্রেণীর রিপুগুলোর চিকিৎসা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গুণ অর্জনের বিভিন্ন পন্থা কোরআন-হাদিসে বারবার বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। সুতরং এসব ‘বাতেনি’ বা অদৃশ্য আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ তথা মন্দ স্বভাবগুলোকে দূরীভূত করা এবং প্রশংসনীয় স্বভাব-আচরণ অর্জনবিষয়ক জ্ঞান বা বিদ্যার নামই হচ্ছে ‘তাসাউফ’।
যুক্তি-বুদ্ধির বিবেচনায়ও ‘তাসাউফ’ বিষয়টি একটি জরুরি বাস্তবতার নাম। কেননা বাতেনি বা আধ্যাত্মিক রোগব্যাধি যেখানে খোদ শরয়ি দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত, বাস্তবভিত্তিক ও অনুমিত, সেখানে এটি অবশ্যই মানতে হবে, মহান আল্লাহ এসবের সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও নিশ্চিত বর্ণনা করেছেন। তা না হলে মহান আল্লাহর প্রতি অবিচারের অভিযোগ উঠবে, তিনি সেসব রোগব্যাধি, মন্দ স্বভাব সৃষ্টি করেছেন অথচ এসবের চিকিৎসা বলে দেননি। গবেষক ইমামদের পথিকৃৎ হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহবিদ্যার সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘ফিকহবিদ্যা মানে, নফ্স বা মন বা আত্মার ভালো-মন্দ, করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে সম্যক অবগত হওয়া।’ (আততাওদ্বীহ : পৃ-১০)।
সংজ্ঞাটি ‘তাসাউফে’রও অন্যতম একটি সংজ্ঞা হিসেবে পরিচিত। উপরন্তু বাতেনি আমলগুলো যেহেতু অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ বাহ্যিক আমলগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়া না-হওয়া অভ্যন্তরীণ আমলগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায়, ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী তাসাউফবিদ্যাও ফিকহ্রই একটি শাখাবিশেষ। এমনকি ‘তাসাউফ’ অভ্যন্তরীণ বুনিয়াদ বা ভিত্তিমূল হওয়ায় বিবেচনায় ‘ফিকহ’র জাহেরি বা বাহ্যিক বিধিবিধান যেন দ্বিতীয় পর্যায়ের শাখাতুল্য। ‘বাতেনি ইলম’ বা আধ্যাত্মিকবিদ্যার ওই মৌলিক গুরুত্বের কারণে ‘ফিকহ’র এ শাখাটির পৃথক নামকরণ করা হয়েছে ‘তাসাউফ’ শিরোনামে। অথচ বেআমল ও পরকালবিমুখ কিছুসংখ্যক নামধারী মৌলভি ‘তাসাউফ’বিদ্যাকে ‘ফিকহ’বিদ্যা থেকে এমনভাবে পৃথক জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেছেন, যেমন কিনা ফিকহ বা শরিয়ত অন্যকিছু আর ‘তাসাউফ’ ভিন্ন কিছু। (মুফতি রশীদ আহমদ : আহসানুল ফাতাওয়া : খ-১, পৃ. ৫৪৬, এডুকেশনাল প্রেস, করাচি)।
পীর তথা চিকিৎসক বা সংশোধনকারীর কাজ হচ্ছে, তিনি কার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিক রোগ বিদ্যমান, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন মাত্র। রোগ ও চিকিৎসা উভয়ই শরিয়তের মৌলিক দলিল-প্রমাণে বিদ্যমান। রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্র যথাযথ নির্ধারণ করা পীর বা শায়খের কাজ। এক্ষেত্রে পীর-মাশায়েখরা নিজ নিজ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়েও কিছু কিছু ব্যবস্থাপত্র ও পথ্যাপথ্য দিয়ে থাকেন। তা যেহেতু মুখ্য নয়, বরং মুখ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধি, তাই তাঁদের এসব প্রক্রিয়া-পদ্ধতি হুবহু কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণের প্রশ্ন অবান্তর।
উপরোল্লিখিত প্রকৃতির পরকালবিমুখ তাসাউফ-বিরোধীদের যদি কেউ কখনও রুহানি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা পরামর্শস্বরূপ বলে, তখন তারা প্রতি উত্তরে বলে থাকে, ‘আজকাল যথাযোগ্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন মনীষীর অস্তিত্ব নেই বা বাস্তবে পাওয়া যায় না।’ তাদের এমন প্রকৃতির যথাযোগ্য চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগটি প্রমাণ বহন করে যে, তাদের চিকিৎসার চিন্তাই নেই এবং তারা রোগকে রোগ মনে করে না। অথচ শারীরিক বা বাহ্যিক রোগব্যাধির চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, সামান্য পেট ব্যথার সমস্যা হলে তখন যে যা-ই বলে সবার কথাই শোনা হয়, সবাইকেই যেন ডাক্তারের মতো হিতাকাক্সক্ষী ভাবা হয়। আর পরকালীন মুক্তির ভাবনা না থাকায় সে ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসকই না পাওয়ার অভিযোগ! এ ক্ষেত্রে একটু গভীরে লক্ষ করলে প্রকারান্তরে কি এমনটি বলা হচ্ছে না যে, মহান প্রভু রাব্বুল আলামিন আধ্যাত্মিক রোগ তো সৃষ্টি করেছেন অনেক; কিন্তু আধ্যাত্মিক চিকিৎসক সৃষ্টি করেননি কাউকে ? তিনি অবিচার করেছেন বান্দাদের প্রতি ? (নাউজুবিল্লাহ!)। অন্য কথায়, তিনি পরকাল বিনষ্টকারী অনেক রিপু বা কারণ সৃষ্টি করে রেখেছেন অথচ সেসব থেকে মুক্তির যথাযথ ব্যবস্থা করেননি ?
এক্ষেত্রে কেউ এমন প্রশ্নও করতে পারে যে, যেহেতু কোরআন-হাদিসে ওইসব আধ্যাত্মিক রোগের চিকিৎসার বর্ণনা রয়েছে, তাই আলেমরা নিজেদের চিকিৎসা নিজেরা করতে পারেন, কোনো শায়খ বা পীর-মুরিদির প্রয়োজন নেই ? এমন ধারণা সঠিক না হওয়ার কারণ হচ্ছে প্রথমত, আধ্যাত্মিক বা রুহানি রোগ নির্ণয় এবং তার যথাযথ ব্যবস্থাপত্র বা চিকিৎসা করতে সক্ষম হবেন তাঁরা, যারা তাসাউফ বিদ্যায় পারদর্শী। অন্য সাধারণ আলেমরা সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দৈহিক বা শারীরিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন চিকিৎসাবিদ্যায় কতকগুলো বই পড়েই কেবল কেউ ডাক্তার হয়ে যান না; বরং বাস্তব চিকিৎসার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হয়; হাতে-কলমে শিখতে হয়। ঠিক তেমন রুহানি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কামিল ওলি বা পীর বা শায়খের শিষ্যত্ব গ্রহণের বিকল্প নেই। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৭)।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ