বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের মদিনায় হিজরতের অনুমতি দিলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দ্রুত মদিনায় হিজরত করতে লাগলেন। আবু সালামার পথ ধরে লোকেরা একের পর এক মদিনায় হিজরত করতে থাকল। এক পর্যায়ে মক্কায় রাসুল (সা.), আবু বকর (রা.) এবং আলী (রা.) ব্যতীত অন্য কোনো মুসলিম অবশিষ্ট রইল না। আবু বকর (রা.) ও আলী রাসুল (সা.) এর আদেশেই মক্কায় রয়ে গেলেন। এ ছাড়া যেসব মুসলমানকে কোরাইশরা আটকে রেখেছিল, তারাও রয়ে গেলেন। রাসুল (সা.) হিজরতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। আবু বকরও প্রস্তুত।
এদিকে জিবরাঈল ফেরেশতা আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে ওহির মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের কথা রাসুল (সা.) কে জানিয়ে দিলেন এবং সে রাতে তাকে নিজ বিছানায় শয়ন করতে নিষেধ করলেন। পরদিন রাসুল (সা.) স্বীয় চেহারা মোবারক আবৃত করে দিবসের মধ্যভাগে আবু বকরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। অথচ তিনি এরকম সময়ে এর আগে কখনোই আবু বকরের বাড়িতে আসতেন না। তিনি সেখানে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে যারা আছে তাদের সবাইকে বের করে দাও।
আবু বকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল ! এরা তো আপনারই পরিবার। তিনি তখন বললেন, আল্লাহ আমাকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বকর তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল ! আমিও আপনার সঙ্গে যেতে চাই। তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাই হবে। তাঁরা উভয়েই রাতের অন্ধকারে ঘরের পেছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে পড়লেন। এ সময় কাফেরদের ব্যর্থ পরিকল্পনা নস্যাত হয়ে যাওয়া এবং হজরত আলী (রা.) এর সঙ্গে বাকবিত-াসহ অনেক দীর্ঘ কাহিনী রয়েছে। এই পরিসরে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করব না। আমাদের আজকের আলোচ্য প্রিয়নবীর হিজরতকালের অনিন্দ্য স্মৃতিবাহী একটি ঘটনা যার প্রত্যক্ষদর্শী উম্মে মা’বাদ আল খাজাইয়া (রা.)।
তাঁরা চলতে লাগলেন। চলার পথে উম্মে মাবাদের তাঁবুর পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। উম্মে মাবাদ ছিলেন একজন সদাচরণকারী মহিলা। তাঁবুর পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী লোকদের তিনি পানাহার করাতেন। রাসুল (সা.) এবং আবু বকর (রা.) তার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে খাবার কিছু আছে কি ? সে বলল, আল্লাহর শপথ! আমার কাছে খাবার কিছু থাকলে আমি আপনাদের মেহমানদারি করতে মোটেই কার্পণ্য করতাম না।
সেটি ছিল অভাবের বছর।
খাদ্যাভাবে উম্মে মাবাদের বকরিগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল। রাসুল (সা.) তাঁবুর এক পাশে একটি বকরি দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, ওহে উম্মে মাবাদ ! এ বকরিটি এখানে কেন ? উম্মে মাবাদ বলল, দুর্বলতার কারণে এটি অন্যান্য বকরির সঙ্গে চলতে পারে না। তাই এটি পেছনে রয়ে গেছে। নবী (সা.) বললেন, বকরিটি কি দুধ দেয় ? উম্মে মাবাদ বলল, এটি দুর্বলতার কারণে চলতেই পারছে না। দুধ আসবে কোথা থেকে ? তিনি বললেন, তুমি কি আমাকে এটি দোহন করার অনুমতি দেবে ? সে বলল, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক! আপনি যদি তাতে কোনো দুধ দেখেন তাহলে দোহন করতে পারেন। রাসুল (সা.) বকরির স্তনে হাত লাগালেন,
বিসমিল্লাহ পাঠ করলেন এবং বরকতের দোয়া করলেন। দুধে বকরির স্তন ভর্তি হয়ে গেল। তিনি পাত্র আনতে বললেন। পাত্র আনা হলে তাতে দুধ দোহন করলেন। পাত্র ভর্তি হয়ে দুধের ফেনা ওপরে উঠতে লাগল। রাসুল (সা.) তৃপ্তি সহকারে দুধ পান করলেন এবং তাঁর সাহাবিদেরও পান করালেন। তিনি পুনরায় পান করলেন। দ্বিতীয়বারও তিনি পাত্র ভর্তি করে দুধ দোহন করে উম্মে মাবাদের তাঁবু ত্যাগ করলেন।
কিছুক্ষণ পর উম্মে মাবাদের স্বামী আবু মাবাদ বকরিগুলো চরিয়ে ফেরত এলো। তাঁবুতে দুধ দেখে আবু মাবাদ আশ্চার্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি দুধ কোথায় পেলে ? বকরিগুলো খাদ্যাভাবে শুকিয়ে রয়েছে। বাড়িতে কোনো দুধেল ছাগলও নেই। সে বলল, আল্লাহর শপথ ! আমাদের কাছ দিয়ে একজন বরকতময় লোক অতিক্রম করেছেন। তার অবস্থা ছিল এরকম এরকম। আবু মাবাদ বলল, আল্লাহর শপথ ! আমার ধারণা, এ লোকটিকেই কোরাইশরা খুঁজছে। হে উম্মে মা’বাদ আমার কাছে তার গুণাগুণ বর্ণনা করো। উম্মে মাবাদ আবু মাবাদের কাছে অত্যন্ত চমৎকার ও সুন্দরভাবে এবং হৃদয়গ্রাহী করে রাসুলের গুণাগুণ ও পরিচয় তুলে ধরলেন।
উম্মে মাবাদ মহানবীর কাফেলার আগমন, শীর্ণকায় বকরি থেকে দুধ দোহনসহ সব ঘটনা খুলে বললেন। কাফেলার লোকদেরও বর্ণনা দিলেন উম্মে মাবাদ। বেদুইন জীবনের মুক্ত মন নিয়ে সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে মহানবীর যে বর্ণনা উম্মে মা’বাদ দিয়েছিলেন তা হলো ‘তাঁর উজ্জ্বল বদনকান্তি, প্রফুল্ল মুখশ্রী, অতি ভদ্র ও নম্র ব্যবহার। তাঁর উদরে স্ফীতি নেই, মস্তকে খালিত্য নেই। সুন্দর, সুদর্শন। সুবিস্তৃত কৃষ্ণবর্ণ নয়নযুগল, কেশ দীর্ঘ ঘনসন্নিবেশিত। তাঁর স্বর গম্ভীর। গ্রিবা উচ্চ। নয়নযুগলে যেন প্রকৃতি নিজেই কাজল দিয়ে রেখেছে। চোখের পুতুলি দুইটি সদা উজ্জ্বল, ঢলঢল। ভ্রযুগল নাতিসূক্ষ্ম, পরস্পর সংযোজিত।
স্বতঃকুঞ্চিত ঘন কেশদাম। মৌনাবলম্বন করলে তাঁর বদনম-ল থেকে গুরুগম্ভীর ভাবের অভিব্যক্তি হতে থাকে। আবার কথা বললে মনপ্রাণ মোহিত হয়ে যায়। দূর থেকে দেখলে কেমন মোহন কেমন মনোমুগ্ধকর সে রূপরাশি, কাছে এলে কত মধুর, কত সুন্দর তাঁর প্রকৃতি। ভাষা অতি মিষ্ট ও প্রাঞ্জল, তাতে ত্রুটি নেই, অতিরিক্ততা নেই, বাক্যগুলো যেন মুক্তার হার। তাঁর দেহ এত খর্ব নয় যা দর্শনে ক্ষুদ্রত্বের ভাব মনে আসে বা এমন দীর্ঘ নয় যা দেখতে বিরক্তি বোধ করে, তিনি নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব। পুষ্টি ও পুলকে সে দেহ যেন কুসুমিত নববিটপীর সদ্য পল্লবিত নবিন প্রশাখা।
সে মুখশ্রী বড় সুন্দর, বড় সুদর্শন ও সুমহান। তাঁর সঙ্গীরা সর্বদাই তাঁকে বেষ্টন করে থাকে। তাঁরা তাঁর কথা আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করে এবং তাঁর আদেশ উৎফুল্লচিত্তে পালন করে।’
স্ত্রীর মুখে এই বর্ণনা শুনে আবু মাবাদ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর শপথ, ইনি নিশ্চয়ই কোরাইশদের সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আমরা সত্য-মিথ্যা অনেক কিছু শ্রবণ করেছি। হায় আমার অদৃষ্ট, আমি অনুপস্থিত ছিলাম। উপস্থিত থাকলে আমি তাঁর আশ্রয় নিতাম, আমি বলছি, সুযোগ পেলে এখনও তা করব।’
ওইদিকে মক্কায় উঁচু কণ্ঠে একটি কবিতা আবৃত্তির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কে তা আবৃত্তি করছে, তাকে দেখা যাচ্ছিল না, যার প্রথম লাইন হচ্ছে, ‘আরশের প্রভু আল্লাহ তায়ালা ওই দুইজন বন্ধুকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন, যারা উভয়েই উম্মে মাবাদের তাঁবুতে অবতরণ করেছেন।’
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা জানতাম না যে, রাসুল (সা.) কোন দিকে গেছেন। কিন্তু মক্কার নিচু ভূমিতে একটি জিন এসে কবিতার এ লাইনগুলো আবৃত্তি করতে লাগল। লোকেরা সে আওয়াজ শুনে পিছে পিছে চলা শুরু করল। তবে তারা সে জিনকে দেখতে পাচ্ছিল না। পরিশেষে জিন মক্কার উঁচু ভূমি দিয়ে বের হয়ে গেল। আসমা বলেন, এ কবিতা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম, মুহাম্মাদ (সা.) মদিনার দিকে চলে গেছেন।
হজরত উম্মে মা’বাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহানবী (সা.) সাথীদের নিয়ে সোজা চলতে লাগলেন মদিনার দিকে। এখন তার মনে শুধু মদিনা, শুধুই মদিনা। এদিকে মদিনার লোকেরাও তাঁরই জন্য অধীর অপেক্ষা করছেন।