বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ভোরের প্রকৃতিতে হাত বাড়ালেই ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। উত্তর থেকে আসছে শিরশিরে বাতাস। সকাল-সন্ধ্যা ঘাসের ওপর মুক্তোর মতো দেখা যাচ্ছে শিশিরের কণা। গাছ থেকে ঝরছে পাতা, ঝরছে শিউলি ফুল। শেষ রাতে গায়ে চাদর চাপাচ্ছেন অনেকেই। তার মানে শীত আমাদের দোরগোড়ায়।
শীত অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় ঋতু। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাছে এ মৌসুম আরও প্রিয়। কেননা অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে ইবাদত বেশি করা যায় এবং সহজভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সে জন্য সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মোমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১১৬৫৬)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মোমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি : ৩৯৪০)।
কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে শীতকালে খুব সহজে আদায় করা যায় এমন কতকগুলো আমল নিম্নরূপÑ
এক. রোজা রাখা
আগের উদ্ধৃত হাদিস থেকে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। শীতকালে দিন থাকে খুবই ছোট এবং ঠা-া। ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে যেমন থাকতে হয় না, তেমনি তৃষ্ণার্ত হওয়ারও ভয় নেই। সুতরাং কারও যদি কাজা রোজা বাকি থাকে, তবে এটাই হলো সেগুলো আদায় করে নেয়ার মোক্ষম সুযোগ। তাছাড়া বেশি বেশি নফল রোজা রাখারও এটি সুবর্ণ সময়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে যে ব্যক্তি একদিন রোজা রাখল, আল্লাহ তায়ালা প্রতিদানস্বরূপ জাহান্নাম এবং ওই ব্যক্তির মাঝখানে ৭০ বছরের দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ (বোখারি : ২৮৪০, মুসলিম : ১১৫৩)।
অতএব শীতের এ মৌসুমে বেশি বেশি রোজা রাখা উচিত। বিশেষত ক. আইয়ামে বিজ তথা হিজরি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমার বন্ধু প্রিয় নবী (সা.) আমাকে তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেনÑ প্রত্যেক মাসে তিনটি রোজা রাখতে, চাশতের দুই রাকাত নামাজ পড়তে এবং ঘুমানোর আগে বেতর নামাজ আদায় করে নিতে।’ (বোখারি : ১১২৪)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য মত হলো, এখানে তিনটি রোজা বলে আইয়ামে বিজের তিন রোজাই বোঝানো হয়েছে।’ (ফাতহুল বারি)।
খ. প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের রোজা। এই ২ দিন রোজা রাখা প্রিয় নবী (সা.) এর নিয়মিত রুটিন ছিল। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘সোম ও বৃহস্পতিবারে রোজা রাখার ব্যাপারে নবী (সা.) খুবই যতবান ছিলেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ৭৪৫)। আবু হুরায়রা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত যে, নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘মানুষের আমলগুলো প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারে আল্লাহ তায়ালার কাছে পেশ করা হয়। আর আমি চাই, আমি রোজাদার অবস্থায় আমার আমলগুলো পেশ করা হোক।’ (সুনানে তিরমিজি : ৭৪৭)।
গ. সাওমে দাউদ (আ.)। সামর্থ্য ও সক্ষমতা থাকলে রোজা রাখার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো সওমে দাউদ (আ.); তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন রাখতেন না। এটাই ছিল তার নফল রোজা রাখার নিয়ম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) কে সংবাদ প্রদান করা হলো যে, ‘আমি বলেছি, আল্লাহর শপথ! আমি (প্রত্যহ) দিনে রোজা রাখব এবং রাতে নফল নামাজে দাঁড়িয়ে থাকব।’ তিনি জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম, ‘জি আমি এমনটা বলেছি।’ তখন নবীজি আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘তুমি তা পারবে না। (দিনে) রোজা রাখ এবং খাও (রাতে), ঘুমাও এবং নামাজে দাঁড়াও, প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখ; কেননা এক নেকির বদলে দশগুণ সওয়াব আর এটা পুরো বছর রোজা পালনের সমান।’ আমি বললাম, ‘নবীজি! আমি এর চেয়ে বেশি রোজা রাখতে সক্ষম।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে একদিন রোজা রাখবে এবং দুই দিন খাবে।’ বললাম, ‘আমি তার চেয়ে বেশি রাখতেও সক্ষম।’ তিনি বললেন, ‘তবে একদিন রোজা রাখবে এবং একদিন খাবে। এটি নবী দাউদ (আ.) এর রোজা এবং এটি সর্বোত্তম রোজা।’ বললাম, ‘আমি তার চেয়ে অধিক রাখতেও সক্ষম।’ নবীজি (সা.) বলে দিলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম কোনো রোজা নেই।’ (বোখারি : ১৮৭৫)।
দুই. তাহাজ্জুদ পড়া
শীতকালে রাত অনেক লম্বা হয়। কেউ চাইলে পূর্ণরূপে ঘুমিয়ে আবার শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে সক্ষম হবে। একদিকে ঘুমের যেমন কোনো কমতি হবে না, অন্যদিকে মহান একটি ইবাদত আদায়ের পবিত্র অভ্যাস গড়ে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা মোমিনদের সম্বন্ধে বলেন, ‘তাদের পার্শ্বশয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা সেজদাহ : ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত।’ (সূরা জারিয়াত : ১৭)।
তিন. পূর্ণরূপে ওজু এবং নামাজের অপেক্ষা
মানুষ শীতকালে ওজু করা কষ্টকর মনে করে। অথচ ওই ঠাণ্ডার সময়ও পরিপূর্ণভাবে ওজু করা কত যে সওয়াবের কাজ। এমনকি শীতের মৌসুমে গরম পানি দিয়ে ওজু করলেও সে পুণ্যের প্রতিদান পাবে। অন্যদিকে দিন ছোট হওয়ায় ফরজ নামাজগুলো খুব কাছাকাছি সময়ে আদায় করা হয়। ফলে এক নামাজ আদায় করে পরবর্তী নামাজের জন্য মসজিদে বসে অপেক্ষা করা খুব কঠিন কাজ নয়। উপরন্তু এর আকর্ষণীয় প্রতিদান রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেব না; যার কারণে আল্লাহ তায়ালা পাপ মোচন করবেন এবং জান্নাতে তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন?’ সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর রাসুল! নবীজি বললেন, ‘মন না চাইলেও ভালোভাবে ওজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’ (মুসলিম : ২৫১)।
চার. কাপড় দান করা
আজ আমরা সবাই অবগত যে, দুনিয়ার বহু অঞ্চলে নির্যাতিত মুসলমানরা শরণার্থী শিবিরে কিংবা নিজ দেশে আর্থিক অসচ্ছলতা হেতু মানবেতর জীবনযাপন করছে ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত কাপড়ের ব্যবস্থা নেই। শীতের আমেজে আমরা উষ্ণ পোশাক পরে যখন শীতকে ‘উপভোগ’ করি, তখন লাখো মানুষ একটু উষ্ণতার জন্য জবুথবু হয়ে খড়কুটো জ্বালিয়ে জীবনটাকে টেনে নিয়ে যায়। মানবিক এবং ইসলামিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওইসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো বিত্তবানদের ওপর জরুরি। শুধু বিত্তবান নয়, সাধারণ মানুষও সাধ্যমতো এগিয়ে আসতে পারেন। একজন মুসলমানকে কাপড় দান করার কী ফজিলত সে বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মোমিন অপর বিবস্ত্র মোমিনকে কাপড় পরিয়ে দিল, আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিয়ে দেবেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ২৪৪৯, মুসনাদে আহমাদ : ১১১১৬)। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহ তাকে জান্নাতি পোশাক পরিয়ে দেবেন।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, ২/৯২)।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী আলেম