ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামে নেতৃত্ব নির্বাচন

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ খেলাফতের সুবর্ণযুগখ্যাত খেলাফতে রাশেদার খলিফারা মনোনীত হয়েছেন ভিন্ন তিন-তিনটি পদ্ধতিতে। খলিফা নির্বাচনে পদ্ধতিগত এ বিভিন্নতা দ্বারা বোঝা যায় যে, এসব পদ্ধতি স্থায়ী নয়, চূড়ান্তও নয় এবং এ তিন পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচন সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ নয়। এ তিনের বাইরে বা সমন্বয়ে উন্নততর অবকাঠামো উদ্ভাবন, অবলম্বন ও ব্যবহার করার মধ্যে দোষের কিছু নেই।

দ্বীন ও নীতি-আদর্শের প্রশ্নে ইসলাম অত্যন্ত রক্ষণশীল, ইসলামের নীতি-আদর্শ কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তনীয় নয়, নীতি-আদর্শের দিক থেকে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত। পক্ষান্তরে দুনিয়া, লোকপ্রশাসন ও অবকাঠামোর প্রশ্নে ইসলাম ততটাই উদার। ইসলাম সর্বাধুনিক ব্যবস্থা, উন্নত প্রযুক্তি এবং কল্যাণকর অবকাঠামোর পক্ষে। উদাহরণত জ্ঞানার্জন। এ ব্যাপারে ইসলামের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ‘জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, ১/৮১, হাদিস : ২২৪)।

নীতিগত এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে ইসলামের পাঠ্যক্রম, শিক্ষাস্তর ও বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো রূপরেখা দেয়নি। আহলে সুফফা থেকে শুরু হয়ে মসজিদের আঙিনা পেরিয়ে এখন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটি। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাকাঠামো বিবর্তিত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে এটি একটি উন্নততর অবকাঠামোর পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সাংগঠনিক পরিকাঠামো, প্রশাসনিক অবকাঠামো ও গঠনতান্ত্রিক বিন্যাসের উন্নয়নকল্পে অমুসলিমদের অভিজ্ঞতা অবলম্বনও এক্ষেত্রে দোষণীয় নয়। এসব অমুসলিমের উদ্ভাবিত এ দাবি তুলে তা প্রত্যাখ্যান করাও যুক্তিসংগত নয়। এ প্রসঙ্গে যুগসচেতন ফকিহ ড. ইউসুফ আল-কারাযাওয়ি বলেন, ‘অমুসলিমদের থেকে উন্নততর কোনো কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার মধ্যে দোষের কিছু নেই এবং (অমুসলিমদের উদ্ভাবিত বলে) মুসলিমদের এটি অবলম্বনে কোনো বিধি-নিষেধও নেই। কারণ হিকমত বা প্রজ্ঞা হচ্ছে মোমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই তা পাবে সে-ই তার অধিক হকদার।

এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) (খন্দকের যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য) মদিনার চর্তুপার্শ্বে পরিখা খনন করেছিলেন। অথচ আরবরা এ কৌশলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এটি ছিল মূলত পারসিকদের কৌশল। বলা হয়ে থাকে, সালমান আল-ফারসি (রা.) এ বিষয়ে নবীজির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। নবীজিকে যখন বলা হয় যে, রাজা-বাদশাহরা সিলমোহর ব্যতীত কোনো চিঠিপত্র গ্রহণ করেন না, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নামাঙ্কিত একটি আংটি ব্যবহার করতে শুরু করেন, যা দিয়ে তিনি তাঁর চিঠিপত্র সিলমোহর করতেন।

‘ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খারাজের ব্যবস্থাপনা ও দেওয়ানি প্রথার অভিজ্ঞতা অমুসিলমদের থেকে গ্রহণ করেছিলেন। মুয়াবিয়া (রা.) ডাক বিভাগ পদ্ধতির অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেছিলেন অমুসলিমদের থেকে। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।’ (ইউসুফ আল-কারযাওয়ি, অনুবাদ : মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামি রাষ্ট্র : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ২০৮)। অবশ্য অমুসলিমদের উদ্ভাবিত বা অনুসৃত কোনো পদ্ধতি বা ধারা-অভিজ্ঞতা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে। ফকিহ ড. ইউসুফ আল-কারযাওয়ি লিখেছেন

এক. এতে অবশ্যই আমাদের (মুসলমানদের) জন্য সত্যিকার কল্যাণ থাকতে হবে। যদিও এর ফলে আমাদের (মুসলমানদের) জন্য কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে ক্ষতির চেয়ে কল্যাণের পরিমাণ অবশ্যই বেশি হতে হবে। কারণ শরিয়তের নীতিগত ভিত্তি হচ্ছে, নিরেট বা সম্ভাব্য ক্ষতিকে এড়িয়ে নিরেট বা সম্ভাব্য কল্যাণ অর্জন করা। মদ ও জুয়া বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আপনি বলে দিন, এসবের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ, যদিও মানুষের জন্য কিছু উপকারিতাও আছে। তবে এসবের পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।’ (সূরা বাকারা : ২১৯)। এক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে মৌলিক দলিল।

দুই. ‘আমরা যা গ্রহণ করব তাতে এমনভাবে সংস্কার সাধন করব এবং সংশোধন করে নেব, যাতে তা আমাধের ধর্মীয় মূল্যবোধ, চারিত্রিক মাপকাঠি, শরিয়তের বিধি-বিধান ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়।’ (ইউসুফ আল-কারযাওয়ি, অনুবাদ : মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামি রাষ্ট্র : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ২০৮-২০৯)।

খেলাফত ইতিহসের প্রথম খলিফা আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.) মনোনীত হয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের একটি পরিষদ কর্তৃক, যেটি ইসলামি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে ‘আহুল হাল ওয়াল আকদ’ নামে পরিচিত করেছেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মনোনীত হয়েছিলেন পূর্ববর্তী খলিফা আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.) কর্তৃক তার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শক্রমে। এখানে নির্দিষ্ট পরিষদের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ বিদ্যমান না থাকলেও এ মনোনয়ন যে একাধিক সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতেই হয়েছিল সেটি প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করেছিলেন এবং এই কাউন্সিল পরামর্শভিত্তিক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ওসমান ইবনুল আফফান (রা.) কে মনোনীত করেন।

উল্লিখিত পদ্ধতির প্রত্যেকটি কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন। প্রশ্ন হচ্ছে, উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলো কি একটি অপরটির বিকল্প, না পরিপূরক? যে কোনো একটি হুবহু গ্রহণ করতে হবে, না এসব পদ্ধতির মৌলিক নীতিগুলোর সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা, স্থায়ী ব্যবস্থা ও শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করা যাবে? বস্তুত উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলো একটি অপরটির বিকল্পও নয় এবং যে কোনো একটি হুবহু অবলম্বনও করতে হবে না বরং বর্ণিত পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে মৌলিক নীতিগুলোর সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা, স্থায়ী ব্যবস্থা ও শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরিতে শরিয়তের কোনো বাধা-নিষেধ নেই। যদি উম্মাহর জন্য কল্যাণকর হয় (অন্তত ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণ বেশি হয়) এবং ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় তাহলে উপর্যুক্ত নির্বাচনী পরিকাঠামো গঠন করতে অমুসলিমদের ধারা-অভিজ্ঞতা অবলম্বনেও কোনো অসুবিধা নেই।

উল্লিখিত পদ্ধতিগুলোতে কয়েকটি মৌলিক নীতির উপস্থিতি রয়েছে। ১. মনোনয়ন (কাউন্সিল কর্তৃক বা খলিফা কর্তৃক), ২. শূরা-ব্যবস্থা এবং ৩. বায়াত, যা মনোনীত খলিফার প্রতি জনগণের আনুগত্যের শপথ বা তার নেতৃত্বের প্রতি সম্মতিজ্ঞাপনসূচক গ্রহণ করা হয়ে থাকে। খলিফার প্রতি আনুগত্যের এ বায়াত সাধারণত খলিফার মনোনয়নের পরই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওসমান ইবনুল আফফান (রা.) যখন খলিফা মনোনয়ন করে যাননি এবং কোনো কাউন্সিলও গঠন করেননি বরং তিনি এটি জনগণের ওপর ছেড়ে দেন, যার কারণে বায়াতের মাধ্যমেই চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব রাষ্ট্রের ‘আহুল হাল ওয়াল আকদ’ হিসেবে একটি সর্বোচ্চ ফোরম সেটি অভিভাবক পরিষদ বা সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল যে-নামেই হোক, থাকবে। এ ফোরাম রাষ্ট্রপতির জন্য একটি খসড়া তালিকা তৈরি করবে।

রাষ্ট্রের শূরা-কাউন্সিল হিসেবে একটি সংসদ বা পার্লামেন্ট থাকবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পরিষদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতির জন্য প্রস্তাবিত তালিকা থেকে যে কোনো একজনকে শূরা-কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে চূড়ান্ত করবেন। রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত হলে নির্বাচন কমিশন তার পক্ষে গণভোটের আয়োজন করবে। যদি শূরা-কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রস্তাবিত কোনো এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে তাহলে একাধিক ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার জন্য সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এটি অধিকতর কল্যাণকর ফর্মুলা হতে পারে, অন্তত একটি আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য। এ ধরনের ফর্মুলার ক্ষতিকর দিক (যদি পরিলক্ষিত হয়) তাহলে অবশ্যই পর্যালোচনাযোগ্য, তবে ক্ষতির চেয়ে উম্মাহর প্রকৃত কল্যাণই বেশি এ ফর্মুলায়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ইসলামে নেতৃত্ব নির্বাচন

আপডেট টাইম : ০৯:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ খেলাফতের সুবর্ণযুগখ্যাত খেলাফতে রাশেদার খলিফারা মনোনীত হয়েছেন ভিন্ন তিন-তিনটি পদ্ধতিতে। খলিফা নির্বাচনে পদ্ধতিগত এ বিভিন্নতা দ্বারা বোঝা যায় যে, এসব পদ্ধতি স্থায়ী নয়, চূড়ান্তও নয় এবং এ তিন পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচন সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ নয়। এ তিনের বাইরে বা সমন্বয়ে উন্নততর অবকাঠামো উদ্ভাবন, অবলম্বন ও ব্যবহার করার মধ্যে দোষের কিছু নেই।

দ্বীন ও নীতি-আদর্শের প্রশ্নে ইসলাম অত্যন্ত রক্ষণশীল, ইসলামের নীতি-আদর্শ কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তনীয় নয়, নীতি-আদর্শের দিক থেকে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত। পক্ষান্তরে দুনিয়া, লোকপ্রশাসন ও অবকাঠামোর প্রশ্নে ইসলাম ততটাই উদার। ইসলাম সর্বাধুনিক ব্যবস্থা, উন্নত প্রযুক্তি এবং কল্যাণকর অবকাঠামোর পক্ষে। উদাহরণত জ্ঞানার্জন। এ ব্যাপারে ইসলামের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ‘জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, ১/৮১, হাদিস : ২২৪)।

নীতিগত এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে ইসলামের পাঠ্যক্রম, শিক্ষাস্তর ও বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো রূপরেখা দেয়নি। আহলে সুফফা থেকে শুরু হয়ে মসজিদের আঙিনা পেরিয়ে এখন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটি। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাকাঠামো বিবর্তিত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে এটি একটি উন্নততর অবকাঠামোর পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সাংগঠনিক পরিকাঠামো, প্রশাসনিক অবকাঠামো ও গঠনতান্ত্রিক বিন্যাসের উন্নয়নকল্পে অমুসলিমদের অভিজ্ঞতা অবলম্বনও এক্ষেত্রে দোষণীয় নয়। এসব অমুসলিমের উদ্ভাবিত এ দাবি তুলে তা প্রত্যাখ্যান করাও যুক্তিসংগত নয়। এ প্রসঙ্গে যুগসচেতন ফকিহ ড. ইউসুফ আল-কারাযাওয়ি বলেন, ‘অমুসলিমদের থেকে উন্নততর কোনো কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার মধ্যে দোষের কিছু নেই এবং (অমুসলিমদের উদ্ভাবিত বলে) মুসলিমদের এটি অবলম্বনে কোনো বিধি-নিষেধও নেই। কারণ হিকমত বা প্রজ্ঞা হচ্ছে মোমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই তা পাবে সে-ই তার অধিক হকদার।

এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) (খন্দকের যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য) মদিনার চর্তুপার্শ্বে পরিখা খনন করেছিলেন। অথচ আরবরা এ কৌশলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এটি ছিল মূলত পারসিকদের কৌশল। বলা হয়ে থাকে, সালমান আল-ফারসি (রা.) এ বিষয়ে নবীজির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। নবীজিকে যখন বলা হয় যে, রাজা-বাদশাহরা সিলমোহর ব্যতীত কোনো চিঠিপত্র গ্রহণ করেন না, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নামাঙ্কিত একটি আংটি ব্যবহার করতে শুরু করেন, যা দিয়ে তিনি তাঁর চিঠিপত্র সিলমোহর করতেন।

‘ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খারাজের ব্যবস্থাপনা ও দেওয়ানি প্রথার অভিজ্ঞতা অমুসিলমদের থেকে গ্রহণ করেছিলেন। মুয়াবিয়া (রা.) ডাক বিভাগ পদ্ধতির অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেছিলেন অমুসলিমদের থেকে। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর জীবনাচরণ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।’ (ইউসুফ আল-কারযাওয়ি, অনুবাদ : মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামি রাষ্ট্র : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ২০৮)। অবশ্য অমুসলিমদের উদ্ভাবিত বা অনুসৃত কোনো পদ্ধতি বা ধারা-অভিজ্ঞতা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে। ফকিহ ড. ইউসুফ আল-কারযাওয়ি লিখেছেন

এক. এতে অবশ্যই আমাদের (মুসলমানদের) জন্য সত্যিকার কল্যাণ থাকতে হবে। যদিও এর ফলে আমাদের (মুসলমানদের) জন্য কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে ক্ষতির চেয়ে কল্যাণের পরিমাণ অবশ্যই বেশি হতে হবে। কারণ শরিয়তের নীতিগত ভিত্তি হচ্ছে, নিরেট বা সম্ভাব্য ক্ষতিকে এড়িয়ে নিরেট বা সম্ভাব্য কল্যাণ অর্জন করা। মদ ও জুয়া বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আপনি বলে দিন, এসবের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ, যদিও মানুষের জন্য কিছু উপকারিতাও আছে। তবে এসবের পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।’ (সূরা বাকারা : ২১৯)। এক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে মৌলিক দলিল।

দুই. ‘আমরা যা গ্রহণ করব তাতে এমনভাবে সংস্কার সাধন করব এবং সংশোধন করে নেব, যাতে তা আমাধের ধর্মীয় মূল্যবোধ, চারিত্রিক মাপকাঠি, শরিয়তের বিধি-বিধান ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়।’ (ইউসুফ আল-কারযাওয়ি, অনুবাদ : মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামি রাষ্ট্র : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ২০৮-২০৯)।

খেলাফত ইতিহসের প্রথম খলিফা আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.) মনোনীত হয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের একটি পরিষদ কর্তৃক, যেটি ইসলামি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে ‘আহুল হাল ওয়াল আকদ’ নামে পরিচিত করেছেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মনোনীত হয়েছিলেন পূর্ববর্তী খলিফা আবু বকর আস-সিদ্দিক (রা.) কর্তৃক তার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শক্রমে। এখানে নির্দিষ্ট পরিষদের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ বিদ্যমান না থাকলেও এ মনোনয়ন যে একাধিক সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতেই হয়েছিল সেটি প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করেছিলেন এবং এই কাউন্সিল পরামর্শভিত্তিক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ওসমান ইবনুল আফফান (রা.) কে মনোনীত করেন।

উল্লিখিত পদ্ধতির প্রত্যেকটি কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন। প্রশ্ন হচ্ছে, উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলো কি একটি অপরটির বিকল্প, না পরিপূরক? যে কোনো একটি হুবহু গ্রহণ করতে হবে, না এসব পদ্ধতির মৌলিক নীতিগুলোর সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা, স্থায়ী ব্যবস্থা ও শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করা যাবে? বস্তুত উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলো একটি অপরটির বিকল্পও নয় এবং যে কোনো একটি হুবহু অবলম্বনও করতে হবে না বরং বর্ণিত পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে মৌলিক নীতিগুলোর সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা, স্থায়ী ব্যবস্থা ও শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরিতে শরিয়তের কোনো বাধা-নিষেধ নেই। যদি উম্মাহর জন্য কল্যাণকর হয় (অন্তত ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণ বেশি হয়) এবং ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় তাহলে উপর্যুক্ত নির্বাচনী পরিকাঠামো গঠন করতে অমুসলিমদের ধারা-অভিজ্ঞতা অবলম্বনেও কোনো অসুবিধা নেই।

উল্লিখিত পদ্ধতিগুলোতে কয়েকটি মৌলিক নীতির উপস্থিতি রয়েছে। ১. মনোনয়ন (কাউন্সিল কর্তৃক বা খলিফা কর্তৃক), ২. শূরা-ব্যবস্থা এবং ৩. বায়াত, যা মনোনীত খলিফার প্রতি জনগণের আনুগত্যের শপথ বা তার নেতৃত্বের প্রতি সম্মতিজ্ঞাপনসূচক গ্রহণ করা হয়ে থাকে। খলিফার প্রতি আনুগত্যের এ বায়াত সাধারণত খলিফার মনোনয়নের পরই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওসমান ইবনুল আফফান (রা.) যখন খলিফা মনোনয়ন করে যাননি এবং কোনো কাউন্সিলও গঠন করেননি বরং তিনি এটি জনগণের ওপর ছেড়ে দেন, যার কারণে বায়াতের মাধ্যমেই চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব রাষ্ট্রের ‘আহুল হাল ওয়াল আকদ’ হিসেবে একটি সর্বোচ্চ ফোরম সেটি অভিভাবক পরিষদ বা সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল যে-নামেই হোক, থাকবে। এ ফোরাম রাষ্ট্রপতির জন্য একটি খসড়া তালিকা তৈরি করবে।

রাষ্ট্রের শূরা-কাউন্সিল হিসেবে একটি সংসদ বা পার্লামেন্ট থাকবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পরিষদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতির জন্য প্রস্তাবিত তালিকা থেকে যে কোনো একজনকে শূরা-কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে চূড়ান্ত করবেন। রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত হলে নির্বাচন কমিশন তার পক্ষে গণভোটের আয়োজন করবে। যদি শূরা-কাউন্সিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রস্তাবিত কোনো এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে তাহলে একাধিক ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার জন্য সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এটি অধিকতর কল্যাণকর ফর্মুলা হতে পারে, অন্তত একটি আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য। এ ধরনের ফর্মুলার ক্ষতিকর দিক (যদি পরিলক্ষিত হয়) তাহলে অবশ্যই পর্যালোচনাযোগ্য, তবে ক্ষতির চেয়ে উম্মাহর প্রকৃত কল্যাণই বেশি এ ফর্মুলায়।