বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ইবনুল কায়্যিম (রহ.) তদীয় শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) সম্পর্কে বলেন, তিনি একদা ফজর পড়ে প্রায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহ তায়ালার জিকির-আজকার করলেন। তারপর আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘এটাই আমার প্রাতরাশ। আমি যদি এই প্রাতরাশ গ্রহণ না করি, আমার শক্তি পড়ে যাবে।’
নীরবতা ও সরবতায়, আগমন ও প্রস্থানে এবং তাবৎ কর্মকা- ও সব অবস্থায় একজন মোমিন কখনও তার প্রভু ও স্রষ্টা থেকে অমুখাপেক্ষী হয় না। কারণ তিনিই তার সাহায্যকারী, ভরসাস্থল ও অভীষ্ট। রবমুখী বান্দা ইবাদতগুজার ও মিনতিকারী এবং আল্লাহর বড়ত্বের সামনে বিনীত ও বিগলিত। তাই মনিবের সঙ্গে গোলামের সম্পর্ক যত মজবুত হয় আর সে হয় আল্লাহর অনুগত্যে সদাতৎপর, তার পথ হয় সরল, তাকে সুপথে তোলা হয়, তার আস্থা মজবুত হয়, শক্তির সঙ্গে যোগ হয় আরও শক্তি এবং বৃদ্ধি পায় দ্বীনের ওপর তার মজবুতি। দেখুন আল্লাহর নবী হুদ (আ.) স্বজাতির হেদায়েত প্রত্যাশায় বলছেন, ‘আর হে আমার কওম!
তোমাদের পালন কর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ করো; তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির ওপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মতো বিমুখ হয়ো না।’ (সূরা হুদ : ৫২)। আল্লাহর বাণী ‘তোমাদের শক্তির ওপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’ বলার কারণ তারা ছিল খুব শক্তিশালী মানুষ। এ জন্যই তারা বলেছিল, ‘আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর কে?’ (সূরা ফুসসিলাত : ১৫)। সেহেতু আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন, যদি তারা ঈমান আনে, তাদের শক্তির সঙ্গে আরও শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া হবে। আয়াত থেকে জানা গেল, গোনাহ নির্মূলসহ তাওবা করা সমৃদ্ধি-উন্নতি, রিজিক ও ইজ্জত-সম্মান বৃদ্ধির কারণ।
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি ইস্তেগফারের গুণে গুণান্বিত, আল্লাহ তার রিজিক প্রশস্ত, কাজ সহজ ও সম্মান-শক্তি সুরক্ষিত করে দেন। ফাতেমা (রা.) যখন নবী (সা.) এর কাছে একজন খাদেম প্রার্থনা করেন, তাকে ও তার স্বামী আলীকে তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল বলে দেব না; যা তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও অনেক বেশি উত্তম? (তিনি বলেন) ‘যখন তোমরা (রাতে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে) বিছানায় যাবে, তখন তোমরা ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়বে। এটা তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়েও অনেক বেশি মঙ্গলজনক।’ (বোখারি)। দেখুন, নবী (সা.) নিজ কন্যা ফাতেমাকে বুঝিয়ে দিলেন আল্লাহর জিকির শরীরকে শক্তিশালী করে।
তাঁর শেখানো এ জিকিরের মাধ্যমে শক্তি অর্জন হবে। এতে করে তিনি একজন সেবকের চেয়েও বেশি সেবার সামর্থ্য লাভ করবেন। ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, নবীজি (সা.) এর বাণী, ‘তোমাদের কি যা তোমরা চেয়েছ তার চেয়ে শ্রেয় কিছু দেখিয়ে দেব’ এ কথা থেকে প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকিরে সদা তৎপর থাকে, সেবক যা কাজ করে তার চেয়ে বেশি শক্তি তাকে দান করা হয়। অথবা তার কাজ সহজ করে দেওয়া হয়। ফলে খাদেম কর্মসম্পাদনের চেয়ে সহজে সে কাজ আঞ্জাম দিতে পারে। আল্লাহর অলিরা জানতেন ও বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহর জিকিরই তাদের শক্তি। আর তাদের রুহের খাদ্যের প্রয়োজন তাদের দেহের খোরাকের চেয়েও বেশি। বরং যে উপাদান বলে তাদের দেহ টিকে থাকত তা হলো তাদের রুহের খোরাক। তাদের কলব আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের জিহ্বা সদা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত।
সহিহ মুসলিমে জাবের বিন সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘নবী (সা.) ফজর নামাজ পড়ে নামাজের স্থানে ভালোমতো সূর্যোদয় হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতেন।’ আবুল আব্বাস কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘নবী (সা.) এর আমল থেকে সকালের নামাজের পর সেখানে জিকির ও দোয়ার মধ্যে সূর্যোদয় পর্যন্ত মশগুল থাকা উত্তম প্রমাণিত হয়। কারণ এটি এমন সময় যখন কোনো নামাজ নেই। তেমনি এমন নামাজের পর যাতে (কোরআনের ভাষায়) ফেরেশতাদের উপস্থিতি ঘটে। আর দিনের ব্যস্ততা তখনও শুরু হয় না। তাই এ সময়ের জিকির ও দোয়া একেবারে পূর্ণ মনোযোগ পায়। এতে করে দোয়া কবুল ও জিকির বরণীয় হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়।’ অলিদ বিন মুসলিম (রহ.) বলেন, ‘আমি ইমাম আওজায়িকে দেখেছি তিনি সূর্যোদয় পর্যন্ত জায়নামাজে আল্লাহর জিকিরে নিরত থাকতেন। তিনি আমাদের বলতেন, এটা পূর্বসূরিদের আমল।
সূর্যোদয়ের পর তারা একে অপরের সঙ্গে (জ্ঞান আহরণের জন্য) মিলিত হতেন। এভাবে তারা আল্লাহর জিকির ও দ্বীনের জ্ঞানে প্রাজ্ঞতা অর্জন উভয় পুণ্যে প্লাবিত হতেন।’ ইবনুল কায়্যিম (রহ.) তদীয় শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি একদা ফজর পড়ে প্রায় মধ্যাহ্ন পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহ তায়ালার জিকির-আজকার করলেন। তারপর আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘এটাই আমার প্রাতরাশ। আমি যদি এই প্রাতরাশ গ্রহণ না করি, আমার শক্তি পড়ে যাবে।’ যিনি এ আমলে অভ্যস্ত, তিনি তার দিবসের সূচনা করেন আল্লাহর জিকির দিয়ে। প্রভুর সামনে বিগলন ও বিনয় দিয়ে। মালিকের কাছে প্রত্যাশা ও প্রার্থনা দিয়ে। ভাবতে পারেন, এ লোকটির সারাদিন কেমন কাটবে? কেমন হবে উদ্যম ও অবস্থা?
এটা তো জানাই গেল যে, জিকির দেহ ও মনকে শক্তিশালী করে। আর বান্দার সে জিকির যদি হয় মৌখিক ও দৈহিক জিকিরের সমন্বয়ে। যেমন রাতের নামাজ দুই জিকিরের সমন্বয় ঘটায়। বরং অনেক জিকিরের সমাবেশ করে। কোরআন কারিম তেলাওয়াত, দোয়া, আল্লাহর ভক্তি এসবই সন্দেহাতীতভাবে বান্দার শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে। নবী (সা.) এর সাগ্রহ অভ্যাস ছিল এই কিয়ামুল লাইল তথা রাতের তাহাজ্জুদ। উম্মুল মোমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) রাতে এত (দীর্ঘ) নামাজ পড়তেন যে, তাঁর দুই পা ফেটে যেত। আয়েশা তাকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন এরূপ করেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘আমি কি আল্লাহর শোকর গুজার বান্দা থেকে পছন্দ করব না!’ (বোখারি ও মুসলিম)। এসব ইবাদত আত্মার খোরাক জোগায়, দেহকে শক্তিশালী করে এবং সংকল্প দৃঢ় করে।
তাই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, নবী (সা.) আল্লাহর পথে কষ্ট-যাতনা মোকাবিলা করেন। বিপদ-বিসম্বাদ সহ্য করেন। শত্রুর চক্রান্ত নস্যাৎ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি জানি যে আপনি তাদের কথাবার্তায় হতোদ্যম হয়ে পড়েন। অতএব আপনি পালনকর্তার সৌন্দর্য স্মরণ করুন এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।’ (সূরা হিজর : ৯৭-৯৮)। অর্থাৎ আপনার স্রষ্টার ওপর ভরসা করুন। কেননা তিনিই আপনার জন্য যথেষ্ট এবং শত্রু মোকাবেলায় আপনার সাহায্যকারী। অতএব আপনি আল্লাহর জিকির, তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতার বর্ণনা ও ইবাদতে তথা নামাজে মশগুল হোন।
এ জন্যই তিনি বলেছেন, ‘অতএব আপনি পালনকর্তার সৌন্দর্য স্মরণ করুন এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।’ (সূরা হিজর : ৯৮)। তাই তো আমরা দেখি, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো সংকটে পড়লেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামাজই যে কোনো ব্যাপারে দৃঢ়তা রক্ষায় সবচেয়ে সহায়ক। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামাজ কায়েম করুন। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)। ১১ মহররম ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব