বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধ ইসলামের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখানে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে কোনো না কোনো ব্যাপারে দায়িত্বশীল। (বোখারি)। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে এমনি এমনিই সৃষ্টি করেনি; বরং কতিপয় উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ তায়ালা তাই জানিয়েছিলেন ফেরেশতাদের। আল্লাহ বলেন ‘স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন আপনার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ (সূরা বাকারা : ৩০)। ‘খলিফা’ শব্দটিও কিছু দায়িত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। এ দায়িত্বকে আমরা প্রাথমিকভাবে দুইভাগে প্রকাশ করতে পারি।
১. সৃষ্টিকর্তার প্রতি দায়িত্ব এবং ২. সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব। প্রথমত, সৃষ্টিকর্তা তথা আল্লাহর প্রতি মানবজাতির প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর উপাসনায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করা। কোরআন ও হাদিসে মানব সৃষ্টির বিভিন্ন উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত থাকলেও সরাসরি এ বিষয়টিকেই উল্লেখ করা হয়েছে। (সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬)। তবে ইবাদত সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। আর তা হলো, সালাত, সাওম, জাকাত ইত্যাদি ফরজ বিষয়গুলোকেই শুধু ইবাদত মনে করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি মোটেও তা নয়। বরং মানবজীবনের প্রত্যেকটি কাজ যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত, সেগুলো পালন করাও ইবাদত।
প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহকে স্মরণ রেখে এবং তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য করলেই তা ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি তার সংসার পরিচালনার জন্য বাজার-সওদা এ উদ্দেশ্যে করে যে, এটি শরিয়ত কর্তৃক দেওয়া কর্তব্য, তাহলে এটিও সদকা হিসেবে গণ্য হবে এবং পরকালে তার প্রতিদান পাবে। অবসর সময়ে যদি কেউ কক্সবাজারে কিংবা নীলগিরিতে বেড়াতে যায় এবং সেখানের সৌন্দর্য উপভোগ করে বলে ‘সুবহানআল্লাহ’ এবং আল্লাহ সৃষ্টির সৌন্দর্য বোঝার চেষ্টা করে, তাহলে তার এ ভ্রমণও ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এ কথা জেনে রাখা দরকার, ইবাদতের চূড়ান্ত অবস্থান হলো ফরজ কাজগুলো এবং সাধারণ অবস্থান হলো বৈধ কাজগুলো। আবার হারাম বা নিষিদ্ধগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখাও একটা ইবাদত। এরশাদ হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) তাদের জন্য যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন, তা ছেড়ে দাও। (সূরা হাশর : ৭)।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়িত্বকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। ১. ব্যক্তির নিজের প্রতি দায়িত্ব, ২. অন্যান্য মানুষের প্রতি দায়িত্ব এবং ৩. অন্যান্য সব সৃষ্টি যথা পশুপাখি, প্রাণী, জীব-জড় ও সব প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব।
১. ব্যক্তির নিজের প্রতিও দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমত, তার নিজের জীবন, শরীর-স্বাস্থ্য একটা আমানত। এটিকে সুস্থ ও সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার। ইচ্ছে করে এসব দায়িত্বের অবহেলা করলে তার জবাবদিহিতা করতে হবে। নিজের জীবনকে সে শেষ করতে পাবেন না। আত্মহত্যা করতে কোরআন নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয়, শরীরের জন্য ক্ষতিকারক বিষয়গুলোকেও তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
২. অন্যান্য মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করাও ব্যক্তির ওপর কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ভর করবে ব্যক্তির সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য অবস্থার ওপর। রাসুল (সা.) হাদিসে বিশ্বমানবতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে মোমিন-মুসলিমদের বোঝাতে তাদের একটি শরীরের সঙ্গে তুলনা করেন। যেখানে একটি অঙ্গও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে পুরো শরীরটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। (বোখারি)।
৩. মানুষের সর্বশেষ দায়িত্ব হলো, সৃষ্টি জগতের প্রতি। পশুপাখি থেকে শুরু করে গাছপালাসহ প্রকৃতির প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতি তাদের দায়িত্ব হলো সেগুলোকে বিনা কারণে নষ্ট করবে না। প্রয়োজানুযায়ী ব্যবহার করবে। তাদের সংরক্ষণ করার চেষ্টা করবে, যাতে পরবর্তীরা সেসব থেকে বঞ্চিত না হয়ে উপকার লাভ করতে পারে। বোখারির এক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন মহিলাকে এজন্য জাহান্নামে দেওয়া হয়েছে, সে একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল, তাকে খেতে দেয়নি এবং শেষ পর্যন্ত বিড়ালটি মারা গিয়েছিল।’ অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা যদি সাগরের মাঝেও থাকো তবু পানির অপচয় করো না।’ এভাবে প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি আমাদের দায়িত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
একজন ব্যক্তি যদি এসব দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করে, তবেই সে তা যথার্থভাবে পালন করতে সক্ষম হবে। এভাবে একজন ব্যক্তি প্রকৃতভাবে অন্যের জন্য কল্যাণকামী হয়ে উঠতে পারে। মোমিন-মুসলিমের তাই প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, এসব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করা। কোরআন ও হাদিসভিত্তিক সঠিক জ্ঞানই তাকে দায়িত্ববান করে তুলতে পারবে। সফলতা এনে দিতে পারবে দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় জীবনে। এটিই আমাদের ইহজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত।