বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। ‘রহমত’ আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলোর প্রতিশব্দ নেই। এ কারণে এসব শব্দকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদ করলে তা যথার্থ হয় না। যেমন শহীদ, শাহাদত, বরকত। রহমতও এ ধরনের একটি শব্দ বাংলায় তার যথার্থ অর্থ করা যায় না। রহমত বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি আল্লাহর অনুগ্রহ। পরম শান্তি অর্থেও রহমত পরিভাষা ব্যবহৃত হয়।
মহব্বত, আল্লাহর ভালোবাসা অর্থেও হাদিস শরিফে রহমত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মোটকথা সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পেয়ারা আমাদের প্রিয়নবী (সা.) ছিলেন সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি আল্লাহর অফুরান রহমত। মানব সমাজে এই রহমতের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে বিভিন্নভাবে। বিশেষ করে বিরোধ মীমাংসা, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে দেওয়া, সমাজ থেকে অশান্তি দূর করা, শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির মধ্যে আমরা সেই রহমতের ছোঁয়া পাই।
দুনিয়ায় অনেক মহাপুরুষ এসেছেন, তাদের শিক্ষা ও মিশন স্থায়ী হয়নি। এমনকি আল্লাহর অনেক নবী-রাসুল দুনিয়ায় এসেছেন মানব সমাজে শান্তি সুখের সওগাত বিলানোর জন্য। কিন্তু তাদের শিক্ষা ও আদর্শের অধিকাংশই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। কারণ, তারা ছিলেন তাদের সময়ের নবী বা রাসুল। অভিজ্ঞতা প্রমাণ দেয়, কোরআন ও হাদিসে বা ইসলামের সূত্রে আগেকার নবী-রাসুলদের যে ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, তা বাদ দিয়ে চিন্তা করা হলে ইতিহাসের পাতায় আগেকার নবী-রাসুলদের সম্পর্কে বেশি কিছু পাওয়া যায় না।
আল্লাহর খাস রহমত হলো, আগেকার যুগের মুহাদ্দেসিন ও ইতিহাস বেত্তাদের চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর গোটা জীবনচিত্র জগতবাসীর সামনে উদ্ভাসিত রয়েছে। তার জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ঘটনা, উম্মাহুতুল মুমেনিনের সঙ্গে মান-অভিমানের ছোটখাটো বর্ণনাও হাদিস শাস্ত্রে সংরক্ষিত আছে। যুগে যুগে যারা হাদিস, তাফসির ও ইতিহাস শাস্ত্র চর্চা করেছেন তাদের বদান্যতায় মানব জাতির সামনে নবী জীবনের আদর্শ ও শিক্ষাগুলো বর্তমান আছে। যদিও তার সঠিক চর্চার অভাবে তা মানব জাতির সামনে উপস্থাপন করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি না।
তবে এ কথা সত্য যে, নবীজির এসব শিক্ষা না হলে পৃথিবীতে ভালো বা মন্দ, ন্যায় কিংবা অন্যায় হালাল বা হারাম চেনার কিংবা নির্ণয় করার কোনো মানদ-থাকত না। সবকিছুকে ডারউইনের মতবাদে বিশ্লেষণের ফলে মানুষ আর অন্যান্য জন্তুর মাঝখানের তফাৎ উঠে যেত। মা-বোন, মেয়ে-স্ত্রীর মাঝে পার্থক্য নির্ণিত হতো না। হালাল-হারামের বাছবিচার হতো না। এই দিকটি বিবেচনা করলে স্বীকার করতে হবে যে, আল্লাহর নবী মানব সভ্যতার জন্য আল্লাহর খাস রহমত এবং তার শিক্ষা ও আদর্শ চিরন্তন ও স্থায়ী হওয়ার কারণে সেই রহমত দুনিয়াবাসীর প্রতি অবারিত রয়েছে।
নবী করিম (সা.) নবুয়ত লাভ করেছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। তবে শৈশব থেকেই এমনকি জন্মের আগে থেকেই তিনি নবী ছিলেন এবং তখন তার নাম ছিল আহমদ। চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্তিকে আধুনিক পরিভাষায় বলা হবে নবুয়তের অভিষেক বা দায়িত্ব গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের সূচনা। ছোটবেলা থেকেই সমাজের অশান্তি দূর করা, পারস্পরিক শত্রুতার অবসান ঘটানো, শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি বহুমুখী অবদান রাখেন এবং তা সব যুগের সব মানুষের জন্য আদর্শ ও অনুকরণীয়।
নবীজি (সা.) এর যৌবনকালের যে ঘটনাটি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত, তা হলো, হিলফুল ফুজুল নামক সেবাসংঘ প্রতিষ্ঠায় তার অংশগ্রহণ। ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আরব সমাজে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল হারবুল ফিজার। রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এ চারটি মাস ইসলামের দৃষ্টিতে অতি সম্মানিত এবং তাতে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম (নিষিদ্ধ)। জাহেলি যুগেও এই মাস চারটিকে সম্মানিত মনে করা হতো এবং তাতে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম বলে গণ্য হতো। কিন্তু ফিজার যুদ্ধ এত ভয়াবহ ছিল যে, তা এই হারাম মাসেও অব্যাহত ছিল। এ কারণে এই যুদ্ধের নাম হয় পাপিষ্ঠ যুদ্ধ বা হারবুল ফিজার। এই যুদ্ধের ফলে আরবের সামাজিক নিরাপত্তার চরম অবনতি ঘটে। তাতে কোরাইশদের মনে যুদ্ধ, রক্তপাত ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে গণচেতনা তীব্রতর হয়। এক পর্যায়ে যুদ্ধে বিবদমান দুই পক্ষের নিহত লোকদের সংখ্যার তুলনা করে প্রতিপক্ষে নিহতের সংখ্যা যতজন অতিরিক্ত হয়, সে অনুপাতে রক্তপণ আদায় করে কোরাইশরা যুদ্ধের অবসান ঘটায়।
যুদ্ধ সমাপ্ত হয় শাওয়াল মাসে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজে জননিরাপত্তা চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল শুরু থেকে। বিশেষভাবে দুর্বল ও মজলুম মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল চরম দুর্বিষহ। যারা বাইরে থেকে কাবাঘর জিয়ারতে আসত, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। সেই চিন্তা ও চেতনা থেকে হিলফুল ফুজুল গঠিত হয়েছিল ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে। তখন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ছিল ২০ বছর। হিলফুল ফুজুল গঠনের সময় কোরাইশ নেতারা একটি অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই অঙ্গীকারের সময় নবী করিম (সা.) চাচাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আর জীবনভর তার মধুর স্মৃতি লালন করতেন।
নবী করিম (সা.) এই চুক্তির স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি আমার চাচাদের সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে জুদ’আনের বাড়িতে একটি অঙ্গীকারের সময় উপস্থিত ছিলাম। এ চুক্তির বিনিময়ে আমাকে লালবর্ণের উষ্ট্র দেওয়া হলেও আমি তা পছন্দ করব না। যদি ইসলামের যুগেও এই চুক্তির বরাতে আমাকে কোনো আহ্বান জানানো হয়, আমি অবশ্যই তাতে সাড়া দেব।’
ইবনে হিশাম বলেন, কোরাইশ নেতারা এ মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিবদ্ধ হয় যে, মক্কার অধিবাসী বা অন্য জায়গার কোনো মজলুম মানুষ যদি মক্কায় প্রবেশ করে, তাকে তারা সহায়তা দেবে এবং যে ব্যক্তি তার ওপর জুলুম করবে, তার বিরুদ্ধে তারা লড়াই করবে, যতক্ষণ না মজলুমের হক উদ্ধার হয়। (ইবনে হিশাম : ১/১৪১)।