ঢাকা , শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর শামীম ওসমানের দাঁড়ি-গোফ যুক্ত ছবি ভাইরাল, যা বলছে ফ্যাক্টচেক ঢাকায় যানজট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপের নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা চার-ছক্কা হাঁকানো ভুলে যাননি সাব্বির হজযাত্রীর সর্বনিম্ন কোটা নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই : ধর্ম উপদেষ্টা একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে জামায়াত উল্টো জাস্টিফাই করছে: মেজর হাফিজ ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ’ পিএইচডি করে ১৯ সন্তানের মা আগামী মাসের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক সবাই হাতে পাবে : প্রেস সচিব নিক্কেই এশিয়াকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মেয়াদে ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা ৪২২ উপজেলায় মিলবে ওএমএসের চাল

নতুন বছরে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির ত্রিমুখী বিপর্যয়ে ইয়েমেনবাসী

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শুধু এক ক্ষুধাই যে ইয়েমেনিদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা নয়। আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলো বলছে, ক্ষুধার্ত ইয়েমেনিদের অনেকেই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে যুদ্ধ ও শরণার্থী বাড়ার ফলে দিন দিন বিভিন্ন রোগ ও মহামারিতে আক্রান্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে এসে বাস্তুচ্যুত ইয়েমেনির সংখ্যা তিন মিলিয়নেরও অধিক দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ, ক্ষুধা, মহামারি, বাস্তুচ্যুতি ও অর্থনৈতিক মন্দা এসব এমন কিছু শিরোনাম যা ইয়েমেন নামটির সঙ্গে লেগেই থাকছে এবং নতুন বছর ২০১৯ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি। হুথি বিদ্রোহী ও সৌদি রাষ্ট্রের মাঝে চলমান যুদ্ধ পঞ্চম বছরে প্রবেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামও জাতিসংঘের রিপোর্টগুলোতে ইয়েমেনবাসীর দুর্ভোগের এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট যে দুর্ভিক্ষ ইয়েমেনবাসীকে হত্যা করছে, যে মহামারি তাদের বিলুপ্ত করে দিচ্ছে, সে দুর্ভোগ হ্রাস করতে ও তাদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে ২০১৯ সালের মধ্যে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন জাতিংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মহাসচিব মার্ক লোকোক। জীবনের জন্য ধমনি যেমন, ইয়েমেনের জন্য তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি যে শহরে অবস্থিত, সে হুদায়দায় বিরোধ থামাতে ও পরিস্থিতি শান্ত করতে একের পর এক শান্তি আলোচনার আহ্বানের মধ্য দিয়েই তিনি এ ঘোষণা করেন।
ভয় ও আশা

বিগত ২০১৮ সালকে ‘ইয়েমেনবাসীর ওপর মানবিক বিপর্যয় ও দুর্ভোগের মন্দ বছর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ইয়েমেনে জাতিসংঘের দূত মার্টিনগ্রিফিথের কার্যালয়ের যোগাযোগ ও গণমাধ্যম কর্মকর্তা হানান আল-বাদাউই।
তবে তিনি নতুন বছর ২০১৯ সালের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে এক বিশেষ বিবৃতিতে আলজাজিরাকে বলেন, ইয়েমেনের জনসাধারণের কাছে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছাতে সম্প্রতি সুইডিশ চুক্তি ও বিশেষভাবে হুদায়দা ও ইয়েমেনের শাহরগ হিসেবে গণ্য হুদায়দার বন্দরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। একই বিষয়ে নিশ্চিত করে ইয়েমেনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিনগ্রিফিথ বলেন, তিনি আশা করছেন ২০১৮ সালই হবে সংঘাতের শেষ বছর।

পাশাপাশি তিনি ইয়েমেনের বর্তমান অবস্থাকে ‘ভীতিকর’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু এ আশাবাদ পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের বিবরণের ওপর প্রতিফলিত হয় না। তারা মনে করছেন, ভবিষ্যৎ ইয়েমেনিদের সামনে এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তারা দেখছেন, যথাক্রমে পঞ্চম বছরেও তাদের পিছু না ছাড়া চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও তাদের রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করতে সেখানে এমন অনেক বাধা আছে, ইয়েমেনবাসী যেসবের সম্মুখীন হতে থাকবে। ২৪ মিলিয়ন ইয়েমেনি ক্ষুধার্ত বর্তমান অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী ২০১৯ সালে চরমভাবে মানবিক সহায়তার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ইয়েমেনি, যা দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত শাখা ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ সতর্ক করে বলেছে, এ চার বছরেই যুদ্ধ সমাপ্ত না হলে আসন্নকালে ইয়েমেন একটি ‘জীবন্ত কঙ্কালের দেশে’ পরিণত হবে।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, নতুন বছরেও মানবিক সংকট অব্যাহত থাকার ফলে সবচেয়ে বড় যে কারণটি ইয়েমেনিদের ভয়কে বাড়িয়ে তুলছে তা হলো, দেশটির ওপর চলমান সংযুক্ত আরব আমিরাত জোটের আরোপিত অবরোধের ধারাবাহিকতা এবং এর অধীনে বিমানবন্দর, নৌ-বন্দরসহ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব বন্দরে পণ্য আমদানিসংক্রান্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। এছাড়া, প্রায় এক মিলিয়ন ইয়েমেনি চাকরিজীবীর বেতন-ভাতা বন্ধ, যা তাদের জীবনের ভারকে তীব্র করে তুলছে এবং তাদের দারিদ্র্যের গহ্বরে নিক্ষেপ করছে।

২০১৮-এর শেষ নাগাদ জাতিসংঘের তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইয়েমেনের অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রায় ১৪ মিলিয়ন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে আরও আট মিলিয়ন তো এমন, যারা জানে না তাদের পরবর্তী বেলার খাবার কোত্থেকে আনা সম্ভব হবে। এভাবে ইয়েমেনের মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশেরও (২২ মিলিয়ন) বেশি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তন্মধ্যে ১১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের অন্তত বেঁচে থাকতে সাহায্যের প্রতি ‘চূড়ান্ত প্রয়োজনগ্রস্ত’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

গাছের পাতা খাচ্ছে তারা শুধু এক ক্ষুধাই যে ইয়েমেনিদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা নয়। আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলো বলছে, ক্ষুধার্ত ইয়েমেনিদের অনেকেই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে যুদ্ধ ও শরণার্থী বাড়ার ফলে দিন দিন বিভিন্ন রোগ ও মহামারিতে আক্রান্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে এসে বাস্তুচ্যুত ইয়েমেনির সংখ্যা তিন মিলিয়নেরও অধিক দাঁড়িয়েছে।

২০১৮ সালে ভয়াবহ আকারে ইয়েমেনের বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। একে ইয়েমেনের ইতিহাসে কালোতম ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুদ্ধের এ বছরগুলোতে আরও ছড়িয়ে পড়ে ডিফথেরিয়া, হাম, বসন্ত, ডেঙ্গুজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ নানা রোগ। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, নতুন বছরে এসব রোগ ও মহামারি আরও বিস্তার লাভ করবে। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও দেশে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতির ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

রেডক্রস আন্তর্জাতিক কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় যে কারণটি আরও অধিক ইয়েমেনিকে এসব অসুস্থতা ও মহামারিতে আক্রান্ত করবে তা হলো, এসব আক্রান্তকে এমন নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত করা হচ্ছে, যেখানে বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী ক্যাম্পে যুদ্ধের জাহান্নাম থেকে পলায়নকারীদের অধিকাংশ এসে থাকছে। তাদের মধ্য থেকে হাজার হাজার মেজবান-পরিবারের সঙ্গে অথবা গণবাসস্থানে অবস্থান নিচ্ছে। এভাবেই সংক্রামক রোগ ও মহামারি দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়ছে।

নতুন শত্রু কলেরা জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইয়েমেনে কলেরা আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তন্মধ্যে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত কলেরা আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ২২৭ জন মৃত্যুবরণ করেছে। আরেক রোগ ডিফথেরিয়া। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে, দেশটিতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এটি প্রতি ১০ জন আক্রান্তের একজনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিগত বছর এ রোগ ৭০ জন ইয়েমেনির মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

এ পর্যন্তই রোগ-বালাইয়ের যুদ্ধ থেমে যায়নি, বরং কিডনি রোগ, ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগছে আরও হাজার হাজার ইয়েমেনি। যুদ্ধের জাহান্নামে এসব রোগ-যন্ত্রণা নিশ্চয়ই দুর্ভোগকে চরম মাত্রা দিচ্ছে। বিশেষ করে, রাজধানী সানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ থাকার ফলে তাদের অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য বাইরে কোথাও সফরের সুযোগটুকু পাচ্ছে না। উপরন্তু চিকিৎসার ব্যয় বহনে অক্ষমতা তো আছেই।

খাদ্যমূল্য ইয়েমেনের অর্থনৈতিক গবেষক আবদুল ওয়াহিদ আল-উবালির মতে, ইয়েমেনে তেল-উৎপাদিত পণ্যের তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্য ৩০০ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালের শেষ কয়েক মাসে ইয়েমেনি রিয়েলের দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়ার পর এ দরপতন মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়ার পরের ফল এটি। তাই নতুন বছরের শুরুতে ইয়েমেনের জাতীয় অর্থনীতি রক্ষার জন্য দেশটির বৈধ সরকার আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছেন ইয়েমেনবাসী।

আলজাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আল-উবালি বলেন, বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত জনগণের ওপর বাড়তি খাদ্যমূল্য একটি অতিরিক্ত বোঝার রূপ নিয়েছে। যদিও ২০১৮ সালে ইয়েমেনি মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সরকারের সব পদক্ষেপই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে রিয়াল পতনের দিকে ফিরে গেছে।

উবালির মতে, ইয়েমেনি মুদ্রার দরপতনের সবচেয়ে মন্দ ফল হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও মৌলিক সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া। যেমন নাকি অন্যান্য মূল্যের ওপর রিয়ালের মূল্যের উন্নতি কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং বিপরীতে রিয়ালের বিনিময় মূল্যের আনুষ্ঠানিক উন্নতির অবনতি ঘটিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

অনেক অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরে প্রবেশ করেছে ইয়েমেনের জনগণ। তারা আশা করছেন এ বছরটিই হবে দেশটিতে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির শেষ বছর একসময় যে দেশের নামের অংশ হয়ে ছিল শান্তি, সৌভাগ্য। তবে তাদের বড় একটি অংশ ভয় করছে, এ বছরটি হবে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক যুদ্ধে তাদের দেশ পঞ্চম বছরে প্রবেশের শুরু যে যুদ্ধে ইয়েমেনের মানুষ স্রেফ জ্বালানি ছাড়া কিছু নয়।

আলজাজিরা অবলম্বনে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার

নতুন বছরে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির ত্রিমুখী বিপর্যয়ে ইয়েমেনবাসী

আপডেট টাইম : ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারী ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শুধু এক ক্ষুধাই যে ইয়েমেনিদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা নয়। আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলো বলছে, ক্ষুধার্ত ইয়েমেনিদের অনেকেই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে যুদ্ধ ও শরণার্থী বাড়ার ফলে দিন দিন বিভিন্ন রোগ ও মহামারিতে আক্রান্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে এসে বাস্তুচ্যুত ইয়েমেনির সংখ্যা তিন মিলিয়নেরও অধিক দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ, ক্ষুধা, মহামারি, বাস্তুচ্যুতি ও অর্থনৈতিক মন্দা এসব এমন কিছু শিরোনাম যা ইয়েমেন নামটির সঙ্গে লেগেই থাকছে এবং নতুন বছর ২০১৯ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি। হুথি বিদ্রোহী ও সৌদি রাষ্ট্রের মাঝে চলমান যুদ্ধ পঞ্চম বছরে প্রবেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামও জাতিসংঘের রিপোর্টগুলোতে ইয়েমেনবাসীর দুর্ভোগের এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট যে দুর্ভিক্ষ ইয়েমেনবাসীকে হত্যা করছে, যে মহামারি তাদের বিলুপ্ত করে দিচ্ছে, সে দুর্ভোগ হ্রাস করতে ও তাদের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে ২০১৯ সালের মধ্যে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন জাতিংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মহাসচিব মার্ক লোকোক। জীবনের জন্য ধমনি যেমন, ইয়েমেনের জন্য তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি যে শহরে অবস্থিত, সে হুদায়দায় বিরোধ থামাতে ও পরিস্থিতি শান্ত করতে একের পর এক শান্তি আলোচনার আহ্বানের মধ্য দিয়েই তিনি এ ঘোষণা করেন।
ভয় ও আশা

বিগত ২০১৮ সালকে ‘ইয়েমেনবাসীর ওপর মানবিক বিপর্যয় ও দুর্ভোগের মন্দ বছর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ইয়েমেনে জাতিসংঘের দূত মার্টিনগ্রিফিথের কার্যালয়ের যোগাযোগ ও গণমাধ্যম কর্মকর্তা হানান আল-বাদাউই।
তবে তিনি নতুন বছর ২০১৯ সালের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে এক বিশেষ বিবৃতিতে আলজাজিরাকে বলেন, ইয়েমেনের জনসাধারণের কাছে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছাতে সম্প্রতি সুইডিশ চুক্তি ও বিশেষভাবে হুদায়দা ও ইয়েমেনের শাহরগ হিসেবে গণ্য হুদায়দার বন্দরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। একই বিষয়ে নিশ্চিত করে ইয়েমেনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিনগ্রিফিথ বলেন, তিনি আশা করছেন ২০১৮ সালই হবে সংঘাতের শেষ বছর।

পাশাপাশি তিনি ইয়েমেনের বর্তমান অবস্থাকে ‘ভীতিকর’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু এ আশাবাদ পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের বিবরণের ওপর প্রতিফলিত হয় না। তারা মনে করছেন, ভবিষ্যৎ ইয়েমেনিদের সামনে এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তারা দেখছেন, যথাক্রমে পঞ্চম বছরেও তাদের পিছু না ছাড়া চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও তাদের রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করতে সেখানে এমন অনেক বাধা আছে, ইয়েমেনবাসী যেসবের সম্মুখীন হতে থাকবে। ২৪ মিলিয়ন ইয়েমেনি ক্ষুধার্ত বর্তমান অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী ২০১৯ সালে চরমভাবে মানবিক সহায়তার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ইয়েমেনি, যা দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত শাখা ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’ সতর্ক করে বলেছে, এ চার বছরেই যুদ্ধ সমাপ্ত না হলে আসন্নকালে ইয়েমেন একটি ‘জীবন্ত কঙ্কালের দেশে’ পরিণত হবে।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, নতুন বছরেও মানবিক সংকট অব্যাহত থাকার ফলে সবচেয়ে বড় যে কারণটি ইয়েমেনিদের ভয়কে বাড়িয়ে তুলছে তা হলো, দেশটির ওপর চলমান সংযুক্ত আরব আমিরাত জোটের আরোপিত অবরোধের ধারাবাহিকতা এবং এর অধীনে বিমানবন্দর, নৌ-বন্দরসহ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব বন্দরে পণ্য আমদানিসংক্রান্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। এছাড়া, প্রায় এক মিলিয়ন ইয়েমেনি চাকরিজীবীর বেতন-ভাতা বন্ধ, যা তাদের জীবনের ভারকে তীব্র করে তুলছে এবং তাদের দারিদ্র্যের গহ্বরে নিক্ষেপ করছে।

২০১৮-এর শেষ নাগাদ জাতিসংঘের তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইয়েমেনের অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রায় ১৪ মিলিয়ন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে আরও আট মিলিয়ন তো এমন, যারা জানে না তাদের পরবর্তী বেলার খাবার কোত্থেকে আনা সম্ভব হবে। এভাবে ইয়েমেনের মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশেরও (২২ মিলিয়ন) বেশি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তন্মধ্যে ১১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের অন্তত বেঁচে থাকতে সাহায্যের প্রতি ‘চূড়ান্ত প্রয়োজনগ্রস্ত’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

গাছের পাতা খাচ্ছে তারা শুধু এক ক্ষুধাই যে ইয়েমেনিদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা নয়। আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলো বলছে, ক্ষুধার্ত ইয়েমেনিদের অনেকেই গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে যুদ্ধ ও শরণার্থী বাড়ার ফলে দিন দিন বিভিন্ন রোগ ও মহামারিতে আক্রান্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে এসে বাস্তুচ্যুত ইয়েমেনির সংখ্যা তিন মিলিয়নেরও অধিক দাঁড়িয়েছে।

২০১৮ সালে ভয়াবহ আকারে ইয়েমেনের বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। একে ইয়েমেনের ইতিহাসে কালোতম ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুদ্ধের এ বছরগুলোতে আরও ছড়িয়ে পড়ে ডিফথেরিয়া, হাম, বসন্ত, ডেঙ্গুজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ নানা রোগ। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, নতুন বছরে এসব রোগ ও মহামারি আরও বিস্তার লাভ করবে। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও দেশে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতির ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা আরও বাড়বে।

রেডক্রস আন্তর্জাতিক কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় যে কারণটি আরও অধিক ইয়েমেনিকে এসব অসুস্থতা ও মহামারিতে আক্রান্ত করবে তা হলো, এসব আক্রান্তকে এমন নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত করা হচ্ছে, যেখানে বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী ক্যাম্পে যুদ্ধের জাহান্নাম থেকে পলায়নকারীদের অধিকাংশ এসে থাকছে। তাদের মধ্য থেকে হাজার হাজার মেজবান-পরিবারের সঙ্গে অথবা গণবাসস্থানে অবস্থান নিচ্ছে। এভাবেই সংক্রামক রোগ ও মহামারি দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়ছে।

নতুন শত্রু কলেরা জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইয়েমেনে কলেরা আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তন্মধ্যে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত কলেরা আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ২২৭ জন মৃত্যুবরণ করেছে। আরেক রোগ ডিফথেরিয়া। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে, দেশটিতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এটি প্রতি ১০ জন আক্রান্তের একজনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিগত বছর এ রোগ ৭০ জন ইয়েমেনির মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

এ পর্যন্তই রোগ-বালাইয়ের যুদ্ধ থেমে যায়নি, বরং কিডনি রোগ, ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগছে আরও হাজার হাজার ইয়েমেনি। যুদ্ধের জাহান্নামে এসব রোগ-যন্ত্রণা নিশ্চয়ই দুর্ভোগকে চরম মাত্রা দিচ্ছে। বিশেষ করে, রাজধানী সানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ থাকার ফলে তাদের অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য বাইরে কোথাও সফরের সুযোগটুকু পাচ্ছে না। উপরন্তু চিকিৎসার ব্যয় বহনে অক্ষমতা তো আছেই।

খাদ্যমূল্য ইয়েমেনের অর্থনৈতিক গবেষক আবদুল ওয়াহিদ আল-উবালির মতে, ইয়েমেনে তেল-উৎপাদিত পণ্যের তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্য ৩০০ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালের শেষ কয়েক মাসে ইয়েমেনি রিয়েলের দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়ার পর এ দরপতন মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়ার পরের ফল এটি। তাই নতুন বছরের শুরুতে ইয়েমেনের জাতীয় অর্থনীতি রক্ষার জন্য দেশটির বৈধ সরকার আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছেন ইয়েমেনবাসী।

আলজাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আল-উবালি বলেন, বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত জনগণের ওপর বাড়তি খাদ্যমূল্য একটি অতিরিক্ত বোঝার রূপ নিয়েছে। যদিও ২০১৮ সালে ইয়েমেনি মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সরকারের সব পদক্ষেপই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে রিয়াল পতনের দিকে ফিরে গেছে।

উবালির মতে, ইয়েমেনি মুদ্রার দরপতনের সবচেয়ে মন্দ ফল হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও মৌলিক সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া। যেমন নাকি অন্যান্য মূল্যের ওপর রিয়ালের মূল্যের উন্নতি কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং বিপরীতে রিয়ালের বিনিময় মূল্যের আনুষ্ঠানিক উন্নতির অবনতি ঘটিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

অনেক অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছরে প্রবেশ করেছে ইয়েমেনের জনগণ। তারা আশা করছেন এ বছরটিই হবে দেশটিতে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির শেষ বছর একসময় যে দেশের নামের অংশ হয়ে ছিল শান্তি, সৌভাগ্য। তবে তাদের বড় একটি অংশ ভয় করছে, এ বছরটি হবে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক যুদ্ধে তাদের দেশ পঞ্চম বছরে প্রবেশের শুরু যে যুদ্ধে ইয়েমেনের মানুষ স্রেফ জ্বালানি ছাড়া কিছু নয়।

আলজাজিরা অবলম্বনে।