ঢাকা , শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর শামীম ওসমানের দাঁড়ি-গোফ যুক্ত ছবি ভাইরাল, যা বলছে ফ্যাক্টচেক ঢাকায় যানজট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপের নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা চার-ছক্কা হাঁকানো ভুলে যাননি সাব্বির হজযাত্রীর সর্বনিম্ন কোটা নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই : ধর্ম উপদেষ্টা একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে জামায়াত উল্টো জাস্টিফাই করছে: মেজর হাফিজ ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ’ পিএইচডি করে ১৯ সন্তানের মা আগামী মাসের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক সবাই হাতে পাবে : প্রেস সচিব নিক্কেই এশিয়াকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মেয়াদে ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা ৪২২ উপজেলায় মিলবে ওএমএসের চাল

প্রেমের পরীক্ষা দুঃখ-বেদনার মাঝে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এমন স্তরে পৌঁছার পর আমি তার রহমত চাই না। চাই তার যাহমত, দুঃখ-বেদনা। মহামহিম বাদশাহ ছাড়া কারও সাহায্য চাই না, সুপারিশ চাই না। কারও কাছে আশ্রয় পেতে চাই না। আমি বাদশাহর মোকাবিলায় সমগ্র দুনিয়াকে ‘লা’ করেছি, বলেছি ‘না’। জগতের মায়া ত্যাগ করেছি এক বাদশাহ তার নদীমের ওপর ভীষণ রাগান্বিত হন। বাদশাহর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সভাসদ ছিলেন নদীম। নদীমের অপরাধ ছিল অমার্জনীয়। তার প্রাপ্য শাস্তি মৃত্যুদ- এবং তাও দেবেন বাদশাহ নিজ হাতে। কোমরের তরবারি কোষমুক্ত করে এগিয়ে গেলেন বাদশাহ, রাগে টগবগ। তবে নদিম একেবারে নির্বিকার। লোকেরা বিস্ময়ে হতবাক। বাদশাহ আজ তার আপনজনকে নিজ হাতে বধ করবেন! কারও বুকের পাটা নেই বাদশাহ সমীপে কোনো কথা বলার। এমন শক্তিধর বাদশাহর সম্মুখে নিঃশ্বাস ফেলার সাহস কার।

সবাই তাকিয়ে আছে আরেক নদীমের দিকে। নাম তার ইমাদুল মুলক, মানে রাজত্বের খুঁটি। বাদশাহর কাছে তিনি সম্মানীয়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে একমাত্র তিনিই সুপারিশ করতে পারেন। তার কথা বাদশাহ ফেলবেন না। কোথাও থেকে তিনি অনেকটা লাফ দিয়ে হাজির হলেন। সরাসরি বাদশাহর পায়ে পড়ে গেলেন, মাফ চাইলেন। তুমি এসেছ! আমি তো এখনই এ অপরাধীর গর্দান উড়িয়ে দিতাম। দুনিয়ার কেউ আমার ক্রোধের আগুন থেকে একে রক্ষা করতে পারত না। কিন্তু তুমি এসে গেছ। তাই অপরাধী শয়তান দৈত্য হলেও আমি তাকে মাফ করে দিলাম। আমার রাগ হজম করলাম। তোমার সুপারিশ আমি অবজ্ঞা করতে পারি না।

ইমাদুল মুলকের বিরাট মর্যাদা বাদশাহর দরবারে। তিনি সুপারিশ করলে মৃত্যুদের অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। তার কারণে বাদশাহর রাগ মুহূর্তে প্রশমিত হয়। কারণ, তিনি নিজের ইচ্ছাকে বাদশাহর ইচ্ছার মাঝে বিলীন করেছেন। ফলে তিনি একান্তভাবে বাদশাহর হয়ে গেছেন। বাদশাহর সন্তুষ্টির দিকে চেয়ে তিনি সব কাজ করেন। তাই তিনি বাদশাহর প্রিয়জনের মর্যাদায় বরিত, অতিশয় সম্মানিত। আদম (আ.) ও এমন মর্যাদা পেয়েছিলেন মহান বাদশাহর দরবারে। মহামহিম বাদশাহ তার প্রিয় বান্দাদের সুপারিশে জঘন্য অপরাধীকেও মাফ করে দেন। তিনি আজ মাফ করে দিলেন নদীমের অপরাধ। নদীম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেন।

ওয়ান নদীমে রাস্তে আয যখমো বলা’ যীন শফী আযোর্দ ও বরগাশত আয ওলা’ সেই নদীমের কেটে গেল বিপদ মৃত্যুর অভিঘাত কিন্তু সুপারিশকারীর প্রতি সে রুষ্ট ক্ষিপ্ত অকস্মাৎ। ইমাদুল মুলকের সুপারিশে নদীমের মহাবিপদ কেটে গেল। নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তিনি রক্ষা পেলেন। কথা ছিল নদীম সুপারিশকারী ইমাদুল মুলকের প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন। কিন্তু হয়ে গেল উল্টো। নদীম দারুণ অসন্তুষ্ট হলেন সুপারিশকারীর প্রতি। তার সঙ্গে এতদিন যেটুকু পরিচয় ছিল, জানাশোনা সম্পর্ক ছিল তাও যেন এখন থেকে ভুলে গেলেন। সামনে পড়লেও কথা বলেন না, এড়িয়ে চলেন। রাজদরবারের লোকজন নদীমের এমন আচরণ দেখে হতবাক। সবখানে সবাই বলাবলি করে কে ন মজনূন আস্ত ইয়ারী চোন বুরীদ আয কেসী কে জানে উ রা’ ওয়া খরীদ এই লোক কি পাগল? যে তার প্রাণ রক্ষা করল তাকে শত্রু ভাবে, এতদিনের বন্ধুত্ব ছিন্ন করল?

নদীমের তো উচিত ছিল মহান বাদশাহ যাকে সম্মান করেন তাকে সম্মান করা। যে তার প্রাণ বাঁচাল তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। অথচ এই দরদি মানুষটির সঙ্গে কেমন আচরণ। লোকটি পাগল হয়ে গেল নাকি? সবার মুখে সমালোচনা, তিরস্কার, ভর্ৎসনা। নদীমের একান্ত ঘনিষ্ঠ এক লোক এগিয়ে গেলেন। নদীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলেন। তিরস্কারের সুরে বললেন, এমন শুভাকাক্সক্ষীর সঙ্গে তুমি কীভাবে এমন অন্যায় আচরণ করছ?

তিনি তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেও তো সমীহ করা উচিত। কারণ, রাজ দরবারে তিনি সম্মানিত। আর তিনি তোমার জান রক্ষার মতো উপকার করেছেন। এর পরও তার প্রতি অবহেলা দেখাচ্ছ, কারণ কী? বন্ধুর ভর্ৎসনা মন দিয়ে শুনলেন নদীম। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বাদশাহ আমাকে প্রাণে বধ করতে চাইলেন, তিনি কেন বাদ সাধলেন। এটা তো আমার আর বাদশাহর ব্যাপার। বাদশাহর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গিত হোক, এটিই তো আমার জীবনের সাধনা ছিল। দরদি সেজে স্বয়ং বাদশাহর হাতে প্রাণটা তুলে দিতে পারব এমন সুযোগ কেন কেড়ে নিলেন তিনি?

গোফত বাহরে শাহ মবযুল আস্ত জা’ন উ চেরা’ আয়দ শফী আন্দর মিয়া’ন বলল, বাদশাহর জন্য উৎসর্গিত আমার প্রাণ কেন সুপারিশকারী সেজে দাঁড়ালেন মাঝখান। আমার জীবন তো বাদশাহর জন্য উৎসর্গিত। আমি চাই তার সন্তুষ্টি। তিনি যদি আমাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পান, যদি আমার প্রাণটা নিয়ে আমার ওপর সন্তুষ্ট হন, তাহলে তো আমার জীবন সার্থক। আমি তো জীবন ভর তার সন্তুষ্টিই চেয়েছি। আমার চাওয়া-পাওয়া তো একমাত্র মহামহিমের রেজামন্দি। বাদশাহ যখন উন্মুক্ত তরবারি হাতে আমার গর্দান নিতে এসেছিলেন তখন তো আমি সান্নিধ্যের চরম উষ্ণতায় পরিতৃপ্ত ছিলাম।

লী মাআল্লাহ ওয়াক্ত বুদ আ’ন দম মরা’ লা ইয়াসা ফীহে নবীয়ুন মুজতবা সে মুহূর্তে আল্লাহর সঙ্গে ছিল আমার একান্ত সান্নিধ্য কোনো নবী-রাসুল উচ্চমর্যাদার ফেরেশতাও সেথা নিষিদ্ধ। সুুফিয়ায়ে কেরামের মহলে হাদিস হিসেবে প্রচলিত একটি রেওয়ায়াতকে মওলানা রুমি এখানে কাব্যরূপ দিয়েছেন। যার মর্মবাণী হচ্ছে, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে আমার এমন একটি মুহূর্ত আছে যে মুহূর্তে কোনো রেসালতধারী নবী কিংবা একান্ত সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।’ তাসাউফের ভাবধারায় এটি ফানা ফিল্লাহর মাকাম। এ গল্পেও নদীম ফানাফিল্লাহর স্তরে উপনীত। তিনি মনে করেন, আমার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। সবদিকে লা, লা, নাই নাই। আছে শুধু ইল্লাল্লাহ, একমাত্র আল্লাহ। আমার অস্তিত্ব বলতে আলাদা কিছু নেই। আমি তার মাঝে, তার ইচ্ছার কাছে সমাহিত।

এমন স্তরে পৌঁছার পর আমি তার রহমত চাই না। চাই তার যাহমত, দুঃখ-বেদনা। মহামহিম বাদশাহ ছাড়া কারও সাহায্য চাই না, সুপারিশ চাই না। কারও কাছে আশ্রয় পেতে চাই না। আমি বাদশাহর মোকাবিলায় সমগ্র দুনিয়াকে ‘লা’ করেছি, বলেছি ‘না’। জগতের মায়া ত্যাগ করেছি। একমাত্র তার ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে হৃদয়-কুটির আলোকিত রেখেছি। তার নেয়ামত পেলেও খুশি, না পেলেও রাজি। দুনিয়ার জীবনে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হলেও তার মাঝে তারই সন্তুষ্টি খুঁজি। আমি জানি, আমার দোষে তিনি যদি একটি প্রাণ নিয়ে নেন তাহলে দয়ার বশে ১০০টি প্রাণ তিনি দান করবেন। আমার কাজ মহামহিমের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা, তার রাহে আত্মহারা হওয়া, নিজেকে সঁপে দেওয়া, ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে তার হাতে তুলে দেওয়া। বাদশাহর কাজ হবে তখন আমার মাথার বদলা দেওয়া।

ফখরে আ’ন সর কে কফে শাহাশ বোরাদ নঙ্গে অ’ন সার কূ বে গাইরী সার বারাদ সেই শিরের জন্য গর্ব, যা বাদশাহর হাতে উৎসর্গিত সেই শির কলঙ্কিত, যা ধরনা দেয়, অন্যের কাছে বিনীত। এখানেই শহীদের অতুলনীয় মর্যাদার রহস্য লুকায়িত। এটি এমন স্তর যা রহস্য আর রহস্যে ঘেরা। কোনো ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না সাধনার পথের এ স্তরের মহিমা মর্যাদা। নদীম চরিত্রে মওলানা সাধকের ভাষায় আরও বলেন, ইবরাহিম (আ.) যখন নমরুদ বাদশাহর অগ্নিকু নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তখন আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেতে কারও সাহায্য চাননি। আমি তো সেই ইবরাহিমের অনুসারী।

আমার সুপারিশকারী ইমাদুল মুলক আদব শিখেননি জিবরাইলের কাছ থেকে। অগ্নিকু জিবরাইল (আ.) প্রথমে ইবরাহিমের কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কি আপনার কোনো সাহায্য করতে পারি? আপনি চাইলে আমার পাখার এক ঝাপ্টায় নমরুদের অগ্নিকু- মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারি? ইবরাহিম (আ.) সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। ইমদাদুল মুলকও প্রথমে আমার পরামর্শ চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। প্রেমিক বান্দা বিশ্বাস করে, এ জগতে যত দুঃখ-কষ্ট মাওলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা। ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এ পরীক্ষায় পাস করতে হবে। তাহলেই মওলার সন্তুষ্টি নসিব হবে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ২৯৩৩-২৯৭৭)

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার

প্রেমের পরীক্ষা দুঃখ-বেদনার মাঝে

আপডেট টাইম : ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ জানুয়ারী ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এমন স্তরে পৌঁছার পর আমি তার রহমত চাই না। চাই তার যাহমত, দুঃখ-বেদনা। মহামহিম বাদশাহ ছাড়া কারও সাহায্য চাই না, সুপারিশ চাই না। কারও কাছে আশ্রয় পেতে চাই না। আমি বাদশাহর মোকাবিলায় সমগ্র দুনিয়াকে ‘লা’ করেছি, বলেছি ‘না’। জগতের মায়া ত্যাগ করেছি এক বাদশাহ তার নদীমের ওপর ভীষণ রাগান্বিত হন। বাদশাহর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সভাসদ ছিলেন নদীম। নদীমের অপরাধ ছিল অমার্জনীয়। তার প্রাপ্য শাস্তি মৃত্যুদ- এবং তাও দেবেন বাদশাহ নিজ হাতে। কোমরের তরবারি কোষমুক্ত করে এগিয়ে গেলেন বাদশাহ, রাগে টগবগ। তবে নদিম একেবারে নির্বিকার। লোকেরা বিস্ময়ে হতবাক। বাদশাহ আজ তার আপনজনকে নিজ হাতে বধ করবেন! কারও বুকের পাটা নেই বাদশাহ সমীপে কোনো কথা বলার। এমন শক্তিধর বাদশাহর সম্মুখে নিঃশ্বাস ফেলার সাহস কার।

সবাই তাকিয়ে আছে আরেক নদীমের দিকে। নাম তার ইমাদুল মুলক, মানে রাজত্বের খুঁটি। বাদশাহর কাছে তিনি সম্মানীয়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে একমাত্র তিনিই সুপারিশ করতে পারেন। তার কথা বাদশাহ ফেলবেন না। কোথাও থেকে তিনি অনেকটা লাফ দিয়ে হাজির হলেন। সরাসরি বাদশাহর পায়ে পড়ে গেলেন, মাফ চাইলেন। তুমি এসেছ! আমি তো এখনই এ অপরাধীর গর্দান উড়িয়ে দিতাম। দুনিয়ার কেউ আমার ক্রোধের আগুন থেকে একে রক্ষা করতে পারত না। কিন্তু তুমি এসে গেছ। তাই অপরাধী শয়তান দৈত্য হলেও আমি তাকে মাফ করে দিলাম। আমার রাগ হজম করলাম। তোমার সুপারিশ আমি অবজ্ঞা করতে পারি না।

ইমাদুল মুলকের বিরাট মর্যাদা বাদশাহর দরবারে। তিনি সুপারিশ করলে মৃত্যুদের অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। তার কারণে বাদশাহর রাগ মুহূর্তে প্রশমিত হয়। কারণ, তিনি নিজের ইচ্ছাকে বাদশাহর ইচ্ছার মাঝে বিলীন করেছেন। ফলে তিনি একান্তভাবে বাদশাহর হয়ে গেছেন। বাদশাহর সন্তুষ্টির দিকে চেয়ে তিনি সব কাজ করেন। তাই তিনি বাদশাহর প্রিয়জনের মর্যাদায় বরিত, অতিশয় সম্মানিত। আদম (আ.) ও এমন মর্যাদা পেয়েছিলেন মহান বাদশাহর দরবারে। মহামহিম বাদশাহ তার প্রিয় বান্দাদের সুপারিশে জঘন্য অপরাধীকেও মাফ করে দেন। তিনি আজ মাফ করে দিলেন নদীমের অপরাধ। নদীম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেন।

ওয়ান নদীমে রাস্তে আয যখমো বলা’ যীন শফী আযোর্দ ও বরগাশত আয ওলা’ সেই নদীমের কেটে গেল বিপদ মৃত্যুর অভিঘাত কিন্তু সুপারিশকারীর প্রতি সে রুষ্ট ক্ষিপ্ত অকস্মাৎ। ইমাদুল মুলকের সুপারিশে নদীমের মহাবিপদ কেটে গেল। নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তিনি রক্ষা পেলেন। কথা ছিল নদীম সুপারিশকারী ইমাদুল মুলকের প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন। কিন্তু হয়ে গেল উল্টো। নদীম দারুণ অসন্তুষ্ট হলেন সুপারিশকারীর প্রতি। তার সঙ্গে এতদিন যেটুকু পরিচয় ছিল, জানাশোনা সম্পর্ক ছিল তাও যেন এখন থেকে ভুলে গেলেন। সামনে পড়লেও কথা বলেন না, এড়িয়ে চলেন। রাজদরবারের লোকজন নদীমের এমন আচরণ দেখে হতবাক। সবখানে সবাই বলাবলি করে কে ন মজনূন আস্ত ইয়ারী চোন বুরীদ আয কেসী কে জানে উ রা’ ওয়া খরীদ এই লোক কি পাগল? যে তার প্রাণ রক্ষা করল তাকে শত্রু ভাবে, এতদিনের বন্ধুত্ব ছিন্ন করল?

নদীমের তো উচিত ছিল মহান বাদশাহ যাকে সম্মান করেন তাকে সম্মান করা। যে তার প্রাণ বাঁচাল তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। অথচ এই দরদি মানুষটির সঙ্গে কেমন আচরণ। লোকটি পাগল হয়ে গেল নাকি? সবার মুখে সমালোচনা, তিরস্কার, ভর্ৎসনা। নদীমের একান্ত ঘনিষ্ঠ এক লোক এগিয়ে গেলেন। নদীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলেন। তিরস্কারের সুরে বললেন, এমন শুভাকাক্সক্ষীর সঙ্গে তুমি কীভাবে এমন অন্যায় আচরণ করছ?

তিনি তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেও তো সমীহ করা উচিত। কারণ, রাজ দরবারে তিনি সম্মানিত। আর তিনি তোমার জান রক্ষার মতো উপকার করেছেন। এর পরও তার প্রতি অবহেলা দেখাচ্ছ, কারণ কী? বন্ধুর ভর্ৎসনা মন দিয়ে শুনলেন নদীম। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বাদশাহ আমাকে প্রাণে বধ করতে চাইলেন, তিনি কেন বাদ সাধলেন। এটা তো আমার আর বাদশাহর ব্যাপার। বাদশাহর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গিত হোক, এটিই তো আমার জীবনের সাধনা ছিল। দরদি সেজে স্বয়ং বাদশাহর হাতে প্রাণটা তুলে দিতে পারব এমন সুযোগ কেন কেড়ে নিলেন তিনি?

গোফত বাহরে শাহ মবযুল আস্ত জা’ন উ চেরা’ আয়দ শফী আন্দর মিয়া’ন বলল, বাদশাহর জন্য উৎসর্গিত আমার প্রাণ কেন সুপারিশকারী সেজে দাঁড়ালেন মাঝখান। আমার জীবন তো বাদশাহর জন্য উৎসর্গিত। আমি চাই তার সন্তুষ্টি। তিনি যদি আমাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পান, যদি আমার প্রাণটা নিয়ে আমার ওপর সন্তুষ্ট হন, তাহলে তো আমার জীবন সার্থক। আমি তো জীবন ভর তার সন্তুষ্টিই চেয়েছি। আমার চাওয়া-পাওয়া তো একমাত্র মহামহিমের রেজামন্দি। বাদশাহ যখন উন্মুক্ত তরবারি হাতে আমার গর্দান নিতে এসেছিলেন তখন তো আমি সান্নিধ্যের চরম উষ্ণতায় পরিতৃপ্ত ছিলাম।

লী মাআল্লাহ ওয়াক্ত বুদ আ’ন দম মরা’ লা ইয়াসা ফীহে নবীয়ুন মুজতবা সে মুহূর্তে আল্লাহর সঙ্গে ছিল আমার একান্ত সান্নিধ্য কোনো নবী-রাসুল উচ্চমর্যাদার ফেরেশতাও সেথা নিষিদ্ধ। সুুফিয়ায়ে কেরামের মহলে হাদিস হিসেবে প্রচলিত একটি রেওয়ায়াতকে মওলানা রুমি এখানে কাব্যরূপ দিয়েছেন। যার মর্মবাণী হচ্ছে, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে আমার এমন একটি মুহূর্ত আছে যে মুহূর্তে কোনো রেসালতধারী নবী কিংবা একান্ত সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।’ তাসাউফের ভাবধারায় এটি ফানা ফিল্লাহর মাকাম। এ গল্পেও নদীম ফানাফিল্লাহর স্তরে উপনীত। তিনি মনে করেন, আমার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই। সবদিকে লা, লা, নাই নাই। আছে শুধু ইল্লাল্লাহ, একমাত্র আল্লাহ। আমার অস্তিত্ব বলতে আলাদা কিছু নেই। আমি তার মাঝে, তার ইচ্ছার কাছে সমাহিত।

এমন স্তরে পৌঁছার পর আমি তার রহমত চাই না। চাই তার যাহমত, দুঃখ-বেদনা। মহামহিম বাদশাহ ছাড়া কারও সাহায্য চাই না, সুপারিশ চাই না। কারও কাছে আশ্রয় পেতে চাই না। আমি বাদশাহর মোকাবিলায় সমগ্র দুনিয়াকে ‘লা’ করেছি, বলেছি ‘না’। জগতের মায়া ত্যাগ করেছি। একমাত্র তার ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে হৃদয়-কুটির আলোকিত রেখেছি। তার নেয়ামত পেলেও খুশি, না পেলেও রাজি। দুনিয়ার জীবনে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হলেও তার মাঝে তারই সন্তুষ্টি খুঁজি। আমি জানি, আমার দোষে তিনি যদি একটি প্রাণ নিয়ে নেন তাহলে দয়ার বশে ১০০টি প্রাণ তিনি দান করবেন। আমার কাজ মহামহিমের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা, তার রাহে আত্মহারা হওয়া, নিজেকে সঁপে দেওয়া, ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে তার হাতে তুলে দেওয়া। বাদশাহর কাজ হবে তখন আমার মাথার বদলা দেওয়া।

ফখরে আ’ন সর কে কফে শাহাশ বোরাদ নঙ্গে অ’ন সার কূ বে গাইরী সার বারাদ সেই শিরের জন্য গর্ব, যা বাদশাহর হাতে উৎসর্গিত সেই শির কলঙ্কিত, যা ধরনা দেয়, অন্যের কাছে বিনীত। এখানেই শহীদের অতুলনীয় মর্যাদার রহস্য লুকায়িত। এটি এমন স্তর যা রহস্য আর রহস্যে ঘেরা। কোনো ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না সাধনার পথের এ স্তরের মহিমা মর্যাদা। নদীম চরিত্রে মওলানা সাধকের ভাষায় আরও বলেন, ইবরাহিম (আ.) যখন নমরুদ বাদশাহর অগ্নিকু নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তখন আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেতে কারও সাহায্য চাননি। আমি তো সেই ইবরাহিমের অনুসারী।

আমার সুপারিশকারী ইমাদুল মুলক আদব শিখেননি জিবরাইলের কাছ থেকে। অগ্নিকু জিবরাইল (আ.) প্রথমে ইবরাহিমের কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কি আপনার কোনো সাহায্য করতে পারি? আপনি চাইলে আমার পাখার এক ঝাপ্টায় নমরুদের অগ্নিকু- মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারি? ইবরাহিম (আ.) সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। ইমদাদুল মুলকও প্রথমে আমার পরামর্শ চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। প্রেমিক বান্দা বিশ্বাস করে, এ জগতে যত দুঃখ-কষ্ট মাওলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা। ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এ পরীক্ষায় পাস করতে হবে। তাহলেই মওলার সন্তুষ্টি নসিব হবে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ২৯৩৩-২৯৭৭)