জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি? নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে আগেই। রাজনৈতিক দল হিসাবে এটি নিষিদ্ধ হবে কিনা সেটি ঝুলে আছে আদালতের উপর। ৭১-এ মানবতা বিরোধী অপরাধে বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের দণ্ডে জামায়াতের একে একে প্রধান চার কাণ্ডারী ফাঁসিতে ঝুলে এখন কবরে। আবুল আলা মওদুদীর ভাবদর্শনে জামায়াত রাজনীতিতে এসে অখণ্ড পাকিস্তানের নামে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাই নয়, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বোরচিত হত্যাকাণ্ড, দর্শন ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় গোটা দলকে যিনি জড়িয়েছিলেন, তিনি গোলাম আজম। ৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে রাজনীতির ময়দানে নিন্দিতই হননি, দলটিকেও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে মানুষের সামনে দৃশ্যমান করেছিলেন জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম।
৭১-এর ভূমিকাকে বীরত্বপূর্ণ জায়গায় রেখে জামায়াতের রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দিকে অগ্রসর করতে তার সঙ্গে যারা একাত্ম হয়ে পথ হেঁটেছিলেন তাদের অন্যতম জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা অন্যতম।
আশির দশকে ছাত্রশিবিরের একটি অংশ ৭১ প্রশ্নে জামায়াতের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে বিরোধীতা করে বেরিয়ে গেলেও জামায়াত ৭১-এর নিন্দিত ভূমিকার আত্মঅহংকার থেকে সরে দাঁড়ায়নি। ইতিহাস থেকে দূরে থাক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত আশা-আকাঙ্খাকে লালন করা দূরে থাক, তারুন্যের আবেগ-অনুভূতির জায়গাটি নিতে পারেনি। ৭৫-এর
১৫ই আগষ্ট সপরিবারে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তানি ভাবধারার দলগুলোর রাজনীতির দুয়ার খুলে দেয়া হলে জামায়াতের প্রত্যাবর্তন ঘটে। নাগরিকত্ব হারানো গোলাম আজম বিনা পাসপোর্টে দেশে ফিরে বহাল তবিয়তে অঘোষিত আমীর হিসাবে জামায়াতের নেতৃত্ব দেন। ৭১-এর আলবদর বাহীনির নৃশংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। সর্বশেষ ফাঁসিতে ঝুলে মরা মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন তার প্রধান।
৭৯ সালের নির্বাচনে মাওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে আইডিলের নামে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী। নিজেদের সুসংগঠিত করার এ রাজনীতিতে গোলাম আজমকে আলাদা রেখে ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান ও সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতকে সুসংগঠিত করার কাজে হাত দেন। ইসলামী বিপ্লবের নামে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মুসলিম দু’একটি দেশের আর্থিক সহায়তা পেলেও পরবর্তীতে দিনে দিনে জামায়াত নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করে দেশের অভ্যন্তরে। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ ও আবাসন খাতসহ নানা ব্যবসায় সফলতা কুড়ায়। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সেই ছাত্র সংঘের উত্তরাধিকারত্ব বহন করা ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্গ গড়ে যাত্রা শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া তারুন্যকে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি দিয়ে দলে টেনে সুশৃঙ্খল ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠনে রূপ দেয়। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্রতিরোধের মুখে কিংবা আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা একদিকে যেমন রগ কাটা নৃশংসতার জন্ম দেয়, তেমনি তাদেরও কর্মীদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের দলীয় গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ দিলেও জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন ইসলামী বিপ্লবের পথ হলেও, কৌশলগত কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিতে নিজেদের ঢেলে সাজায়। সেনা শাসন উত্তর ৯১ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসন নিয়ে জয় লাভ করার মধ্যে দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করে জামায়াত ইসলামী। সেই সংসদে বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও মন্ত্রীত্ব নেয়নি। দু’টি নারী আসন নিয়েছিল।
৯১ সালের পরাজয় থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগ উপলব্দি করেছিল তাদের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিভক্তি ও নিজেদের শক্তি সুসংগঠিত না করলে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় আরোহন কঠিন। একদিকে ৮৩ সালে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বেরিয়ে যাওয়া দলের একটি শক্তিশালী অংশকে যেমন ফিরিয়ে আনে, তেমনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকি বিচারের আন্দোলনে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে জামায়াতকে চাপে ফেলতে সফল হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন ঘুমিয়ে পড়া তারুন্য ও মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে জাগ্রত করে।
অন্যদিকে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সংসদ থেকে পদত্যাগ ছাড়াও রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জামায়াতকে কাছে পায় আওয়ামী লীগ। জাহানারা ইমামের আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লেও আওয়ামীলীগের আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার হয়। তৎকালীন বিরোধী দলের উপনেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদের ৮৩ লেক সার্কাস কলবাগানের বাসভবনে তিন দলের লিঁয়াজো কমিটির যে বৈঠক বসত সেখানে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করতেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিত্ব করতেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও মরহুম কাজী জাফর আহমদ। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করতেন মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মোহাম্মদ নাসিম। লিঁয়াজো কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া মরহুম আব্দুর রাজ্জাক নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো বৈঠকে বসেননি। সে সময় জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য নিয়ে আওয়ামীলীগের অনেক বুদ্ধিজীবীরা আপত্তি জানালেও দলের হাই কমাণ্ড আমলে নেয়নি। সেই কৌশল আন্দোলই নয়, ৯৬’র নির্বাচনে বিজয়মাল্যে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় এনেছিল। আর সেই নির্বাচনে ১৮টি আসন থেকে দু’টি আসন দিয়ে লোকসানের পাল্লায় তুলে দিয়েছিল জামায়াতকে । পরবর্তীতে বিএনপি’র সঙ্গে জোট গঠন করে আন্দোলন ও সরকার গঠনে যে ঐক্য গড়েছিল জামায়াত সেটি এখনো বহাল। বিএনপি জামায়াত শাসনামল ২১-এর গেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, জঙ্গিবাদের উত্থান, সন্ত্রাসবাদ ও গ্রেনেড বোমা হত্যাকাণ্ডে অভিশপ্ত হয়েছিল। সেই অভিশাপের বোঝা এখনো বইছে বিএনপি-জামায়াত।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপারাধীদের বিচারের জন্য গণরায় নেয়। ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরই ফাঁসিতে ঝোলায়নি, জাতীয় ও আন্তার্জাতিক মহল এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপ অগ্রাহ্য করে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। সেই বিচারে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডীত জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আজমের কারাগারেই মৃত্যুবরণ হয়েছে।
জামায়াতের রাজনীতিতে এসে কোরআন তাফসীর ও ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে বাগ্মিতায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের শহর থেকে গ্রামে মানুষকে যিনি টানছিলেন জামায়াতের পথে সেই দেলোয়ার হোসেন সাঈদীও আজীবন কারাদণ্ড নিয়ে জেলে আছেন। তাঁর রায়কে ঘিরে যে সহিংসতা, আত্মাহুতি ও প্রলয় ঘটেছে আর কারো বেলায় জামায়াত তা পারেনি। জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। দলটির অর্থনৈতিক প্রাণ শক্তি মীর কাশেম আলীর সামনে ফাঁসির দঁড়ি ঝুলছে। শুরুতে জামায়াত সহিংস আন্দোলনের পথ নিয়ে সরকারের দমননীনিতির মুখেই পতিত হয়নি, অনেক নেতা-কর্মী জেলে।সারাদেশে দলের কার্যালয়গুলোতে বাতি জ্বালানোরও কেউ নেই। তারপরও কার্যত নেতৃত্বহীন জামায়াত মাঠে নামাতে না পারলেও প্রেসরিলিজের মাধ্যমে গোপন জায়গা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। জামায়াত নেতৃত্ব ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুললেও নেতা-কর্মীরা কারাগার ও মামলার জালে পড়লেও সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় হলেও শেষ হয়ে যায়নি।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মঙ্গলবার বলেছেন, জামায়াত নিষিদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সরকারই করুক আর আদালতই করুক জামায়াত নিষিদ্ধ হচ্ছে সেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের নজর জামায়াত সামনে কি করবে? বর্তমানে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের মতো টিকে থাকার লড়াই করলেও তাদের সামনে অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ। একদিকে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন, অন্যদিকে সামনের জাতীয় নির্বাচনে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে নাকি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা জোটের আশ্রয়ে প্রার্থীদানের কৌশল নেবে? জামায়াতের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের নজরবন্দি। জনপ্রিয়তায় সরকার বা শাসকদের অবস্থান কোথায় সেটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া দৃশ্যমান হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে যেমন গ্রহণ করছে না, তেমন সরকার দেশি-বিদেশি শক্তির কাছে জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক দল হিসাবে চিহ্নিত করে আসছে। সব মিলিয়ে অন্ধকার সময়ের মুখোমুখী জামায়াতের সামনে পুলসিরাতের রাস্তা। পুলসিরারাতের রাস্তায় নেতাহীন জামায়াত এখন কি করবে?