বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শেষ হলো ট্রাফিক সপ্তাহ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পুলিশ। প্রথমে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা করেন। এরপর বিকালে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশব্যাপী ট্রাফিক সপ্তাহ ঘোষণা করা হয়। প্রথমে ট্রাফিক সপ্তাহ সাতদিন থাকলেও পরে তা দশ দিন করা হয়। ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে।
গত সোমবার পর্যন্ত সারাদেশে ত্রুটির কারণে যানবাহনের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৮০টি মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবারও পুলিশের অভিযান অব্যাহত ছিল। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা এক বার্তায় জানান, গত ৫ আগস্ট সারাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ ২০১৮-এর কার্যক্রম শুরু হয়। অত্যন্ত সফলভাবে এই ট্রাফিক সপ্তাহের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইজিপি মহোদয় দেশব্যাপী এ ট্রাফিক সপ্তাহের মেয়াদ আরও তিনদিন বৃদ্ধি করেন। ট্রাফিক সপ্তাহের ১০ দিনের এই কার্যক্রমের ফলে দেশের মহাসড়কে পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। বিভিন্ন পরিবহণ তথা গাড়ির ড্রাইভার ও জনগণের মাঝে ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেসসহ অন্যান্য কাগজপত্র সম্পর্কে অধিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সর্বোপরি এই ট্রাফিক সপ্তাহের কার্যক্রমে আপামর জনসাধারণের মনে রোড সেফটি সম্পর্কে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাফিক সপ্তাহের গতকাল ১০তম তথা শেষ দিন ছিল। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের ৬টি মেট্রোপলিটন এলাকা, ৮টি রেঞ্জ এবং হাইওয়ে রেঞ্জে মোট ১,৮০,২৪৯টি যানবাহনের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ৭৪,২২৪ জন চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ সময় বিভিন্ন আইনগত অনিয়মের কারণে ৭ কোটি ৮ লাখ ১৪ হাজার ৩৭৫ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে ৫৪১৮টি যানবাহন আটক করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সন্দেহভাজন যানবাহন তল্লাশি করছে।
ত্রুটি থাকলে মামলা, জরিমানা এমনকি যানবাহন আটক করছে। নগরীর বাংলা মোটরে দায়িত্বরত সার্জেন্ট আশরাফ উদ্দিন বলেন, গাড়ি কিংবা চালকের অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ২৩টি মামলা হয়েছে। ২টি গাড়ির কাগজ না থাকায় সেগুলো আটক করা হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ শৃঙ্খলা আনতে জোরালো অভিযান পরিচালনা করছে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানায়, গাড়ির ফিটনেস, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, হাইড্রোলিক হর্ন, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার এবং মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহার করার জন্য মামলাগুলো করা হয়। এছাড়া ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৯৭২টি মামলা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ট্রাফিকের যুগ্ম কমিশনার ফরিদউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে। তবে মামলা-জরিমানা করলেই সমাধান হবে না। সেক্ষেত্রে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সচেতনতাই পারে শৃঙ্খলা আনতে। তিনি আরও বলেন, কাউকেই আমরা ছাড় দিচ্ছি না। ট্রাফিক পুলিশকে সেভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যানবাহনে অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এই ট্রাফিক সপ্তাহে কারোরই অন্যায় আবদার বা তদবির ট্রাফিক সার্জেন্টরা শোনেননি। তদবিরের জন্য কোনো ফোন কল এলে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবেই। যানবাহনের যথাযথ কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকা পরিচিতজনদের আগে থেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন দ্রুত তা ঠিক করেই যেন রাস্তায় নামেন।
ট্রাফিক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে শুধু এ আন্দোলনের সময় থেকে নয়, অনেক আগে থেকেই আমরা তৎপর ছিলাম। সঠিকভাবে গাড়ি পার্কিং না করা, গাড়ির লাইসেন্স না থাকা, লার্নিং ড্রাইভারের লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানোসহ রেজিস্ট্রেশন ছাড়া যানবাহন আটকালেই পরিচিজনদের ফোন পেয়েছি। তদের জরিমানা ও মামলা থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা করলেও ভবিষ্যতে যেনো আর এমনটা না ঘটে সেজন্য কীভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে হবে সে বিষয়েও বুঝিয়েছেন তিনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তাদের সহায়তা করার। ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে তদবিরের কোনো ফোন কল আসার প্রবণতা অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা। আর মাথায় হেলমেট পরে চলাফেরাসহ রাস্তায় শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়ে সবসময়ই উদ্বুদ্ধ করেছেন এ ধরনের ফোনকলধারীদের।
নিজের উদাহরণ দিয়ে তাদের বুঝিয়েছেন ‘আমি মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করেছি কিন্তু হেলমেট থাকায় বেঁচে গেছি। গত মঙ্গলবার রাতে মাদকসহ একটি গাড়ি আটক করে পুলিশ। ওই গাড়ির ড্রাইভারের লাইসেন্স থাকলেও ভুয়া হিসেবে সনাক্ত হয়। আবার রাস্তায় দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সড়কে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে আসুক সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাফিক পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় তদবির এখন অনেক কম আসছে। সিনিয়র অফিসারদের চাপ, রাজনৈতিক চাপ খুবই কম। এটা খুব ইতিবাচক। এর আগে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সারাদেশে ট্রাফিক সপ্তাহ পালনের ঘোষণা দেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
গত ৫ আগস্ট থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয়ে গতকাল মঙ্গলবার তা শেষ হয়। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ভিআইপি পরিবহণের একটি বাস থামিয়ে চালকের লাইসেন্স চেক করেন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। গাড়িচালক রবিনকে তৎক্ষণাৎ নিচে নামালেন এনায়েত উল্লাহ। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক সার্জেন্ট ফরহাদ। তাকে লাইসেন্স যাচাই করতে বললেন। সার্জেন্ট লাইসেন্স যাচাই করে দেখলেন এটি অপেশাদার এবং হালকা যান (মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা) চালানোর লাইসেন্স। এরপর তাকে মামলা দেন সার্জেন্ট। এনায়েত উল্লাহ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ওর বয়স ২১ কেমনে হয়? দেখলেই বুঝা যায়, ওর ১৫-১৬ বছর।
অথচ পেশাদার লাইসেন্স পেতে ২১ বছর হতে হয়। এরা কীভাবে লাইসেন্স পাচ্ছে? কেন ওদের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে? জবাবে সার্জেন্ট ফরহাদ বলেন, লাইসেন্স তো বিআরটিএ দেয়। তিনি ঘণ্টাব্যাপী সড়কে দাঁড়িয়ে এই রুটে চলাচলকারী স্বাধীন, লাব্বায়েক, বিকাশ, ওয়েলকাম ও স্বজন পরিবহণের কয়েকটি বাস থামিয়ে সেগুলোর নিবন্ধন ও চালকের লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করতে থাকেন তারা। রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল ও মিরপুরে বাস মালিকরা যানবাহন ও লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করেন। খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, দুই শিশুর মৃত্যুর পর স্কুলের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আমাদের নজর কেড়েছে। আমরা দেখেছি যে, টার্গেট ও চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিযোগিতা ও দুর্ঘটনা ঘটছে।
আমরা এসব বন্ধের ঘোষণা দিয়েছি। সকাল থেকে রাস্তায় নেমে কয়েকটি বাস থামিয়ে এগুলোর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছি। আমাদের নজরে এসেছে যে, অনেক চালকের ২১ বছর হয়নি, তবুও লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। কেউ কেউ হালকা যানবাহনের লাইসেন্স দিয়ে ভারী যানবাহন চালায়। অনেক চালকের চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নেশা করে। আমার প্রশ্ন কীভাবে এত অল্প বয়সে তারা লাইসেন্স পাচ্ছে? অপরদিকে বাস মালিক ও পুলিশের পাশাপাশি মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বিআরটিএর একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়।
বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে আদালত পরিচালিত হয়। দুপুর পর্যন্ত যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে মোট ২০টি মামলা করা হয়। পয়েন্টে পয়েন্টে যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করলে অনেকেই বাস বের করে না। আসন্ন ঈদুল আজহায় পরিবহণ সংকটের বিষয়ে তারা বলেন, রাস্তায় গাড়ি আটকে কাগজপত্র ও লাইসেন্স যাচাই করা হবে না। বাস মালিকরা টার্মিনালে নিজ নিজ বাসের বিষয়ে নিজেদের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে।