বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আজ ১ মার্চ। বাঙালি জাতির অপরিহার্য প্রসবের কান্না শুনতে পাই এ মাসে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাঙালি জানান দেয় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার; বাঙালি আর কোনোদিন কারও গোলাম হয়ে না থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর ১৯৪৮ সালেই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কথা বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়েছে তা নিতান্তই একটি ধোঁকা।
প্রথমেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ভাষাকে অস্বীকার করল এবং ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালিদের বুকে গুলি চালিয়ে রাজপথকে করল রঞ্জিত। তারপরও আমরা ২৩টি বছর পশ্চিমাদের সঙ্গে থেকেছি; সহ্য করেছি হাজারো অত্যাচার-অবিচার। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিভাবে আমাদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সোনালি আঁশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হয়েছিল দর্শনীয় নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ। বাদ-প্রতিবাদের কমতি ছিল না।
বাঙালিরা তৈরি করেছিল ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ আর ’৭১। অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার শেষ দাওয়াই ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। যদিও ততদিনে বাঙালি মননে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে জন্মলাভ করার আকুতি দানা বেঁধে উঠেছিল। তারপরও ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল আমাদের মনোভাব সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে পরিষ্কার জানান দেয়ার সুযোগ। আমরা সে সুযোগ ষোলোআনাই কাজে লাগিয়েছি।
আমাদের সামনে তখন ভরসার জায়গা ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। বাঙালি সেদিন প্রাণ খুলে তাদের মনের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি (১০টি সংরক্ষিত মহিলা আসন) আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি (৭টি মহিলা আসনসহ) আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। প্রাদেশিক পরিষদে ভোটারদের রায় ছিল আরও ভিন্ন মাত্রায়।
সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লগি বিজয়ী হয় ২৯৮টি আসনে। সুতরাং জাতীয় হোক আর প্রাদেশিক, উভয় ক্ষেত্রেই এ দেশের জনগণের সোজাসুজি রায় ছিল- পাকিস্তান বাঙালিরাই শাসন করবে; পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব বাঙালিকেই দিতে হবে। এর কোনো অন্যথা মেনে নেয়ার জন্য বাঙালি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না এবং তা সঙ্গত কারণেই। কিন্তু বর্বর ও নির্বোধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেহেতু বাঙালিকে প্রজার বেশি কোনোদিন ভাবতে পারেনি তাই তাদের রাজার আসনে দেখবে কীভাবে?
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল ৩ মার্চ। কিন্তু ১ মার্চ অপ্রত্যাশিতভাবে সে অধিবেশন স্থগিত করা হয়। পাকিস্তানিদের কুমতলব অনুধাবন করতে বাঙালির ভুল হয়নি। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, বেরিয়ে পড়ে রাজপথে। সারা দেশ, বিশেষ করে ঢাকার রাজপথ হয়ে ওঠে উত্তাল। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণও থেমে থাকেনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাণহানির কথা শোনা যায়।
অনেকটা বাধ্য হয়েই তৈরি করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন- এ চারজন থাকলেন সামনের সারিতে। পরবর্তী সময়ে এ চারজনকে ‘চার খলিফা’ নামে সম্বোধন করা হতো। ছাত্রসমাজ সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ৩ মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে, যেখানে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন। সেই সমাবেশে ছাত্রলীগ যে ৫ দফাভিত্তিক প্রস্তাব গ্রহণ করে, পরবর্তী সময়ে সেটাই ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ নামে অভিহিত হয়।
এর পরের প্রতিটি দিনক্ষণই আলাদা মেজাজে উপস্থিত হতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সেদিনের বাঙালি আর একমুহূর্তের জন্যও মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। আমজনতার পাশাপাশি টেলিভিশন ও বেতার শিল্পীরাও অনুষ্ঠান বর্জন শুরু করেছিলেন। ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে যোগ দেন। দেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ, আন্দোলনের মুখে ইয়াহিয়া খান দিশেহারা হয়ে উঠলেন। তিনি ৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ আবার জাতীয় অধিবেশন আহ্বান করেন। এতে করে সমগ্র জাতি যেন নতুন করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতি পুরো জাতি অনাস্থা প্রকাশ করে।
জাতির এ সংকটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা নিতে ভুল করেনি। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার জন্য বিশাল জনসভার আয়োজন করে। সে জনসভাকে শুধু ঐতিহাসিক বলে খাটো করা যাবে না; বরং বলতে হবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির সে ছিল এক শপথ সমাবেশ। লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে হাজির হয়েছিলেন সেই জনসভায়; বলা যেতে পারে, পাকিস্তানের ‘শেষ’ দেখে নেয়ার ‘কসম’ খেতে।
আমজনতার সেরকম একটি মানসিক অবস্থার মধ্যে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন, কোটি কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত উচ্চারণ বেরিয়ে এলো বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ কালজয়ী বক্তৃতা নিয়ে হাজারো রকমের ব্যাখ্যা-বিবৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে সাবলীল ও যথার্থ মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুরই একজন সমালোচকের বক্তব্য।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সমালোচক আহমদ ছফাকে তার জীবনে কোনোদিন শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করতে দেখিনি। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সেই আহমদ ছফার মূল্যায়ন হল, “বস্তুত বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনার তরী নয়- ‘আর দাবায়া রাখবার পারবা না’। সহস্রাধিক বছরের পরাধীন জীবনের অস্তিত্বের প্রতি সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে এ উচ্চারণের মাধ্যমে গোটা জাতির চিত্তলোকে তিনি এমন একটা অনমনীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এ গৌরব শেখ মুজিবকে অবশ্যই দিতে হবে” (শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ; পৃষ্ঠা ২১)।
আহমদ ছফা ঠিকই বলেছিলেন, সেই ভাষণের পর বাঙালি আর পেছন ফিরে তাকায়নি। তাকানোর সুযোগও ছিল না। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছিলেন, ‘আমার অনুরোধ, প্রত্যেক মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ভার অলিখিতভাবেই নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কথাই সেদিন শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। মানুষের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা এবং তার ওপর মানুষের অবারিত আস্থা না থাকলে এমনটি হওয়া সম্ভব ছিল না। ‘শ্রমিক ভায়েরা, ২৮ তারিখ গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে…।’ কী অসাধারণ অভিভাবকত্ব! কী অসাধারণ আত্মবিশ্বাস!! এই আত্মবিশ্বাসই মানুষকে ‘স্বাধীনতা ছাড়া ঘরে না ফেরার’ প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর মুখনিঃসৃত সর্বশেষ স্বাধীনতার ঘোষণাটি আসে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ শিরোনামে ১৫ খণ্ডের রচিত গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের প্রথম পাতায় বাণীটি সন্নিবেশিত আছে- ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
২৫ মার্চ কালরাত্রিতে সাধারণ নিরীহ বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা মূলত পাকিস্তানেরই কবর রচনা করে। এ কথা ঠিক যে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। কিন্তু এ কথা বললে ভুল হবে না যে, প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বপ্নের, আমাদের কাঙ্ক্ষিত পথ তৈরি করেছি, যেখানে ঘোষিত হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’।