ড.গোলসান আরা বেগমঃ সোনার খাঁচায় বন্দি ময়না পাখিটি দুধ কলা খায়,নাচানাচি করে। লাল ঠোট দিয়ে কিচির মিচির করে গান শুনায়। কতো না খুশি হয় পাখিটির লালন পালনকারী কর্তাবাবু।বন্ধুদের ডেকে এনে পাখিটিরে দেখায়, মনে মনে খুশী অনুভব করে। ইনিয়ে বিনিয়ে পাখিটিরে নিয়ে খোশ গল্প করে।ছোট বাচ্চারা হয় মহা খুশী ময়না পাখিটির মিস্টি সুরেলা গান শুনে।
কেউ একবার ভাবে না, পাখিটিরও মুক্ত স্বাধীন সত্ত্বা আছে । সে স্বাধীনতার সাধ ভোগ করতে চায়। হাত পা খুলে আকাশে উড়তে চায়। বন্দি জীবন কতো কষ্টের সে ছাড়া কেউ বুঝে না, বা বুঝতে চায় না।
পাখিটি তো কারো ক্ষতি করেনি। কেন তার বন্দি জীবনের সাজা ভোগ করতে হচ্ছে? কে তাকে মুক্ত করবে? কার কাছে বিচার চাইবে।
পাখিটি বের হয়ে যাওয়ার জন্য ধরফর করে। ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে থাকে। কখনও-বা খাঁচার সাথে যুদ্ধ করতে করতে নেতিয়ে পড়ে, অবশ দেহে ঘুমিয়ে যায়।কেউ বুঝে না তার মর্ম ব্যথা। অভিমানে দুধ কলা খেতে চায় না। করবে কি, তাও ভাবতে পারে না। হায় হাত কড়া ছাড়াই কারাবন্দি জীবন। কেউ করে না ভালোবাসা বিনিময়। মনের সখ পূরণ করার জন্য, তার পালনকারী চকচক চোখে পাখিটির দিকে তাকিয়ে থাকে, আর বলে বাহ্ কি সুন্দর। তাতে ময়না পাখীর ভরে কি অন্তর?
বুড়ু রয়সে মানুষও হয়ে যায় ময়না পাখীর মত কারাবন্দি। বদ্ব ঘরে পার করতে হয় একাকী শান্ত দুপুর। তারা গুনতে হয়, আকাশের পানে চেয়ে চুপচাপ বারান্দায় বসে। কে হবে তার সঙ্গের সাথী। বুড়ু মানুষের সঙ্গে গল্প করে কেউ মজা পায় না, মনে করে সময়ের অপচয়। বুড়ু মানুষ ময়না পাখির মত নিজের মনের সাথে বিরহী মনে করে বিদ্রোহ ঘোষণা। কিন্তু লাভ নেই, রণে ভঙ্গ দিয়ে গুটিয়ে নেয় সকল আবেগ উচ্ছাস। ভালোবাসার হাত কেউ বাড়ায় না, বাড়াতে চায় না। কমর্ব্যস্ত জীবনে ইচ্ছে থাকলেও কেউ কেউ পারেনা।অথচ ফরজ দায়িত্ব মনে করা উচিৎ প্রত্যেক সন্তানের,প্রতিদিন অন্তত মিনিট দশেক সময় বুড়ু বাব,মা’র পেছনে ব্যয় করা।
কফি হাউজের সেই আড্ডাটা বুড়ু রয়সে চোখের সামনে ভাসে।কতো না ছিলো রঙিলা দুপুর।মনে হতো সাত রঙে আঁকা পৃথিবীটা খুশিতে ভরা হাতে মুঠোয়। চাঁদকে শুনাতো যৌবনের রোদেলা মধুর গান। প্রজাপতির মতো উড়ে ঘুরে বেড়াতো ফুলে ফুলে। চাঁদের টিপ কপালে পড়ে, আঁচল পেতে আকাশকে ডেকে বলতো,আয় না নেমে বাতাসের গান শুনাই। জোনাক ধরে ভালোবাসার ঠোঙ্গা বানাই। ঝালমুড়ি খাই লাবণ্য মাখা সবুজ ঘাসে মিশে।
কোন কোন সন্তানরা না চাইতেই বুড়ু বাবা,মা’র ঠোটে তুলে দেয় সুখের শত আয়োজন। কি খাবে, কেমন বিছানায় ঘুমাবে, নেই তার ঘাটতি। পায়ের কাছে সুখ করে ঘুরা ঘুরি। অভাবের সংসার হলে বুড়ুকে গলা ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় ফুটপাতে। কি নিমর্ম তাদের আচরণ।মধ্যবিত্ত পরিবারের বুড়ুর জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। কে হবে তার একাকিত্বের সঙ্গী।কি নিদারুন বয়সের ভারের ক্লান্তি। হাতে পায়ে জোড় থাকতে কেউ কি তা ভাবে?
বরং যৌবন কালে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে জোগাড় করেছে সুখের কাঠ খড়। থরে থরে সাজিয়েছে সন্তানের ভবিষ্যত, মাথা গুঁজার ঠাই। সোনার সুখ কিনতে ছুটে গিয়েছে উত্তর দক্ষি মেরু পাড়ি দিয়ে জিন পেতনির জগতে। সকল ভয়কে দুহাতে ঢলে করেছে জয়। তিল তিল করে সংসারে যুক্ত করেছে সুখের তৈল, ঘি। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সাজিয়েছে ভবিষ্যতের ভালোবাসার ফুলদানি। সকল ভয়কে করেছে জয়।
আরো এক ধরনের ময়না পাখি রয়েছে, সোনার খাঁচায় বন্দি– তাঁরা হলো বিয়ে করা ঘরের বউ। কারো স্বামী থাকে বিদেশে বছরের পর বছর। বউ ছটফট করে রাত দিন। অন্ধকারে রাতের বিছানায় যৌবনকে কোলে নিয়ে গড়াগড়ি খায়। ফোনে বা ভিডিও কলে করে প্রেমের আদান প্রদান। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটায়। এমন ময়না পাখির বিয়ের কি প্রয়োজন? অথচ বিদেশী পাত্র দেখলে মেয়েকে বিয়ে দিতে পাগল হয়ে যায় বাবা মা।
পরোকীয়া, জোয়া,নেশা, অন্য নারীতে আসক্ত পুরুষের বউ, ঘরে পড়ে করে ধরফর। মান সন্মান খোয়া যাওয়ার ভয়ে ঘরের বউ নামক ময়না পাখিটি, দুঃখ ব্যথা ঢেকে রেখে, সুখে হাসি করে বিলিবন্টন। সন্তান কে মনে করে সুখের ছায়া অবলম্বন। সে কি করবে। বেশী বাড়াবাড়ি করলে গলা টিপে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বউকে পাঠিয়ে দিবে পরপারে। কি দরকার এতোসব ঝক্কি ঝামেলা মাথায় নিয়ে। শুকনা মুখে দুঃখের বাতাস উল্টায় ও সুখের আশায় আল্লাহ আল্লাহ করে।
তারপরও ময়না মতি সিনেমায় — নায়ক রাজ রাজ্জাককে বিরহে কাতর হয়ে একটি গান গাইতে দেখা যায়
“অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়”।
ময়নার ভুমিকায় অভিনয় করছে বিখ্যাত নায়িকা কবরী। এই তো আমাদের খাঁচায় বন্দি ময়না পাখীর জীবন। সূতায় টান পড়লে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে। তাঁরপরও কেন ময়নাকে সোনার শিকলে বেঁধে রাখি। আসুন আমরা মানবিক, আন্তরিক হই।
লেখকঃ কবি,কলামিস্ট, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।