ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সনির গল্প হার মানায় চলচ্চিত্রকেও

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাল্যবিয়ে, সংসার ও পোশাক কারখানায় কাজ করার পরও তিনি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজের জীবনে কঠিন বাস্তবতা পার করার পর এখন কাজ করছেন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে, আশা দেখাচ্ছেন অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের। হার না মানা জীবনের এ গল্প সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সনি আক্তারের। এ জীবনকাহিনি হার মানায় চলচ্চিত্রের গল্পকেও।

বগুড়ার মেয়ে সনি আক্তার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। অল্প বয়সেই বাবা-মা আর ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে পাড়ি জমান ইট-পাথরের শহর ঢাকায়। সনি স্বল্প বেতনে চাকরি নেন সাভারের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। তবে শত কষ্টের মাঝেও সনি চেয়েছিলেন লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে। কারখানায় চাকরির পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করেন তিনি। একসময়ের পোশাক শ্রমিক সনি আক্তার এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি কাজ করছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।

 সনি আক্তার জানান, কারখানায় চাকরিরত অবস্থায় সহকর্মী সাইফুল ইসলামের প্রেমে পড়েন সনি। বিয়েও হয় নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। তবু লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। কারখানায় কঠোর পরিশ্রম শেষে বাসায় ফিরে সারতেন সাংসারিক কাজ। এরই মাঝে সময় করে বসতেন বই নিয়ে। এভাবে সনি আক্তার স্কুল ও কলেজের পাঠ চুকিয়ে এখন পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সনির স্বপ্ন— তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিষ্ঠিতদের কাতারে নিজেকে দাঁড় করাবেন। তাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন স্বামী সাইফুল ইসলাম।

সনি আক্তার বর্তমানে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় নারী প্রগতি সংঘ নামে একটি এনজিও-তে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত। এই এনজিও’র আওতায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) প্রকল্পে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

সনির পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। স্বামী সাইফুল ইসলামও পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে এখন ব্যবসা করছেন। আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ কাঁঠালবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন তারা।

সনি আক্তার তার জীবনযুদ্ধ জয়ের গল্প শুনিয়েছেন রাইজিংবিডিকে। তিনি বলেন, “২০০৮ সালে বগুড়া থেকে ফ্যামিলিসহ ঢাকায় এসেছি। গ্রামে আমার পরিবারে আর্থিক সংকট ছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময় আশুলিয়ার শ্রীপুরে ফিনিক্সি টেক্সটাইলে চাকরি নিই। আমি তখন কোনো কাজ জানতাম না। ওনারা ইন্টারভিউ নেয় লাইন কিপার পদের জন্য। গ্রামের স্কুলে আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। ফলে ইন্টারভিউয়ে টিকে যাই। মূলত সবার হাজিরা কার্ড লেখার কাজ ছিল আমার। তখন আমার বেতন ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। এরপরে আমি একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ নিই। ওই ফ্যাক্টরিতে আমি ডিজাইন সেকশনে মার্চেন্ডাইজারদের সঙ্গে কাজ করি।

‘২০০৯ সালে আমি ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা চিন্তা করি। মা-বাবা রাজি হলে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নাইনে মানবিক শাখায় ভর্তি হই। এসবের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। ২০১০ সালে আমরা বিয়ে করি।’’

সাফল্যের পেছনে স্বামীর অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি নারী বলেন, ‘আমার হাসবেন্ড খুব হেল্পফুল। তার সাপোর্টেই আমি এত দূর আসতে পেরেছি। সে আমাকে ফুললি সাপোর্ট দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, সে খুব কম টাকার খাবার খাচ্ছে। কারণ, ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন‌্য বউকে রিকশাভাড়া দিতে হবে। সে খুব দামি পোশাক পরছে না বউকে ভালো ড্রেস দেওয়ার জন‌্য।’

কীভাবে পোশাক কারখানার চাকরি, লেখাপড়া আর সংসার একসঙ্গে সামলাতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সনি বলেন, ‘ওই সময় আমার খুব কষ্ট হতো। কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার। ওই দিন ক্লাস করে এসে রাতে পড়াশুনা করতাম। আমার হাসবেন্ড আমাকে সাপোর্ট করত। বাসার কাজে সাহায‌্য করত। তখন আমার মনে হতো, আমাক ক্লাসে যেতে হবে, পরীক্ষায় পাস করতে হবে, বড় কিছু হতে হবে। এজন্য ক্লান্তি আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘‘২০১২ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৮৭ পেয়ে পাস করি। পরে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। আগেই ইপিজেডের চাকরি ছেড়ে গাজীপুরের এসেনসিয়াল ক্লথিং লিমিটেডে কারখানায় চাকরি নিয়েছিলাম। কলেজে পড়া অবস্থায় কারখানায় লাইন চিফ পদে আমার প্রমোশন হয়। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আমার পেটে সন্তান আসে। এর চার মাসের মাথায় আমি চাকরি ছেড়ে দেই। একই সময় আমার এইচএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়। দ্বিতীয় পরীক্ষার সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম। এ সময় সবাই আমাকে পরীক্ষা না দেওয়ার পরামর্শ দেয়।

‘তবে আমি বললাম, আমি এটা করব না। তখন পরিবারের সবাই আমাকে গণস্বাস্থ্যের অ্যাম্বুলেন্সে করে সাভার কলেজে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই থাকে, যাতে কোনো সমস্যা হলে আমাকে নিয়ে আসতে পারে। আমার সিট ছিল পাঁচ তলায়। অ‌্যাপ্লিকেশন করে নিচতলায় পরীক্ষা দেই। ১৫ অক্টোবর আমার মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। তিন দিনের বাচ্চা বাসায় রেখে আবারও পরীক্ষা দিতে যাই আমি। ২০১৬ সালে জিপিএ ২.৫০ পেয়ে উচ্চ মাধ‌্যমিক পাস করি।’’

সনি আরও বলেন, ‘বাচ্চা পেটে আসার পরও বাসায় বসে থাকতাম না। দুই বেলা ২০ জন স্টুডেন্টকে পড়াতাম। টিউশনি করে মাসে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পেতাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ২০১৭ সালে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য স্টুডেন্টদের সঙ্গে ম্যাচ করাটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। তবে দুই-তিনজন টিচার আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমিও খুব পরিশ্রম করছি। তখন অনেক বেশি পড়তাম। প্রথম সেমিস্টার ছাড়া সব সেমিস্টারেই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। কয়েক মাস পরেই অনার্স শেষ হবে আমার।’

এনজিও-তে চাকরি পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু ২০১৯ সালে আমার ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর হাসবেন্ডের চাকরিও চলে যায়। তখন আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি? ওই সময় আমার স্বামীর পরিচিতজন মিন্টু ভাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘে চাকরি পাই।‘
ভবিষ‌্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সনি আক্তার বলেন, ‘আমি বিসিএস ক্যাডার হতে চাই। পুলিশে চাকরি করতে চাই।’

সনি আক্তারের স্বামী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পড়াশুনার প্রতি আমার স্ত্রীর আকর্ষণ অনেক বেশি। তাই চাকরি, সংসার সবকিছু সামলে সে লেখাপাড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সনির জন্য গর্ববোধ করি।’

নারী প্রগতি সংঘের প্রশিক্ষক ও সমন্বয়ক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘আমরা চাই, সনি আরও এগিয়ে যাক। তার মতো প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা এগিয়ে যাক।’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সনির গল্প হার মানায় চলচ্চিত্রকেও

আপডেট টাইম : ০৩:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ ২০২১

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাল্যবিয়ে, সংসার ও পোশাক কারখানায় কাজ করার পরও তিনি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজের জীবনে কঠিন বাস্তবতা পার করার পর এখন কাজ করছেন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে, আশা দেখাচ্ছেন অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের। হার না মানা জীবনের এ গল্প সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সনি আক্তারের। এ জীবনকাহিনি হার মানায় চলচ্চিত্রের গল্পকেও।

বগুড়ার মেয়ে সনি আক্তার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। অল্প বয়সেই বাবা-মা আর ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে পাড়ি জমান ইট-পাথরের শহর ঢাকায়। সনি স্বল্প বেতনে চাকরি নেন সাভারের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। তবে শত কষ্টের মাঝেও সনি চেয়েছিলেন লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে। কারখানায় চাকরির পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করেন তিনি। একসময়ের পোশাক শ্রমিক সনি আক্তার এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি কাজ করছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।

 সনি আক্তার জানান, কারখানায় চাকরিরত অবস্থায় সহকর্মী সাইফুল ইসলামের প্রেমে পড়েন সনি। বিয়েও হয় নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। তবু লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। কারখানায় কঠোর পরিশ্রম শেষে বাসায় ফিরে সারতেন সাংসারিক কাজ। এরই মাঝে সময় করে বসতেন বই নিয়ে। এভাবে সনি আক্তার স্কুল ও কলেজের পাঠ চুকিয়ে এখন পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সনির স্বপ্ন— তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিষ্ঠিতদের কাতারে নিজেকে দাঁড় করাবেন। তাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন স্বামী সাইফুল ইসলাম।

সনি আক্তার বর্তমানে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় নারী প্রগতি সংঘ নামে একটি এনজিও-তে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত। এই এনজিও’র আওতায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) প্রকল্পে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

সনির পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। স্বামী সাইফুল ইসলামও পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে এখন ব্যবসা করছেন। আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ কাঁঠালবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন তারা।

সনি আক্তার তার জীবনযুদ্ধ জয়ের গল্প শুনিয়েছেন রাইজিংবিডিকে। তিনি বলেন, “২০০৮ সালে বগুড়া থেকে ফ্যামিলিসহ ঢাকায় এসেছি। গ্রামে আমার পরিবারে আর্থিক সংকট ছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময় আশুলিয়ার শ্রীপুরে ফিনিক্সি টেক্সটাইলে চাকরি নিই। আমি তখন কোনো কাজ জানতাম না। ওনারা ইন্টারভিউ নেয় লাইন কিপার পদের জন্য। গ্রামের স্কুলে আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। ফলে ইন্টারভিউয়ে টিকে যাই। মূলত সবার হাজিরা কার্ড লেখার কাজ ছিল আমার। তখন আমার বেতন ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। এরপরে আমি একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ নিই। ওই ফ্যাক্টরিতে আমি ডিজাইন সেকশনে মার্চেন্ডাইজারদের সঙ্গে কাজ করি।

‘২০০৯ সালে আমি ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা চিন্তা করি। মা-বাবা রাজি হলে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নাইনে মানবিক শাখায় ভর্তি হই। এসবের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। ২০১০ সালে আমরা বিয়ে করি।’’

সাফল্যের পেছনে স্বামীর অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি নারী বলেন, ‘আমার হাসবেন্ড খুব হেল্পফুল। তার সাপোর্টেই আমি এত দূর আসতে পেরেছি। সে আমাকে ফুললি সাপোর্ট দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, সে খুব কম টাকার খাবার খাচ্ছে। কারণ, ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন‌্য বউকে রিকশাভাড়া দিতে হবে। সে খুব দামি পোশাক পরছে না বউকে ভালো ড্রেস দেওয়ার জন‌্য।’

কীভাবে পোশাক কারখানার চাকরি, লেখাপড়া আর সংসার একসঙ্গে সামলাতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সনি বলেন, ‘ওই সময় আমার খুব কষ্ট হতো। কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার। ওই দিন ক্লাস করে এসে রাতে পড়াশুনা করতাম। আমার হাসবেন্ড আমাকে সাপোর্ট করত। বাসার কাজে সাহায‌্য করত। তখন আমার মনে হতো, আমাক ক্লাসে যেতে হবে, পরীক্ষায় পাস করতে হবে, বড় কিছু হতে হবে। এজন্য ক্লান্তি আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘‘২০১২ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৮৭ পেয়ে পাস করি। পরে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। আগেই ইপিজেডের চাকরি ছেড়ে গাজীপুরের এসেনসিয়াল ক্লথিং লিমিটেডে কারখানায় চাকরি নিয়েছিলাম। কলেজে পড়া অবস্থায় কারখানায় লাইন চিফ পদে আমার প্রমোশন হয়। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আমার পেটে সন্তান আসে। এর চার মাসের মাথায় আমি চাকরি ছেড়ে দেই। একই সময় আমার এইচএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়। দ্বিতীয় পরীক্ষার সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম। এ সময় সবাই আমাকে পরীক্ষা না দেওয়ার পরামর্শ দেয়।

‘তবে আমি বললাম, আমি এটা করব না। তখন পরিবারের সবাই আমাকে গণস্বাস্থ্যের অ্যাম্বুলেন্সে করে সাভার কলেজে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই থাকে, যাতে কোনো সমস্যা হলে আমাকে নিয়ে আসতে পারে। আমার সিট ছিল পাঁচ তলায়। অ‌্যাপ্লিকেশন করে নিচতলায় পরীক্ষা দেই। ১৫ অক্টোবর আমার মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। তিন দিনের বাচ্চা বাসায় রেখে আবারও পরীক্ষা দিতে যাই আমি। ২০১৬ সালে জিপিএ ২.৫০ পেয়ে উচ্চ মাধ‌্যমিক পাস করি।’’

সনি আরও বলেন, ‘বাচ্চা পেটে আসার পরও বাসায় বসে থাকতাম না। দুই বেলা ২০ জন স্টুডেন্টকে পড়াতাম। টিউশনি করে মাসে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পেতাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ২০১৭ সালে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য স্টুডেন্টদের সঙ্গে ম্যাচ করাটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। তবে দুই-তিনজন টিচার আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমিও খুব পরিশ্রম করছি। তখন অনেক বেশি পড়তাম। প্রথম সেমিস্টার ছাড়া সব সেমিস্টারেই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। কয়েক মাস পরেই অনার্স শেষ হবে আমার।’

এনজিও-তে চাকরি পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু ২০১৯ সালে আমার ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর হাসবেন্ডের চাকরিও চলে যায়। তখন আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি? ওই সময় আমার স্বামীর পরিচিতজন মিন্টু ভাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘে চাকরি পাই।‘
ভবিষ‌্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সনি আক্তার বলেন, ‘আমি বিসিএস ক্যাডার হতে চাই। পুলিশে চাকরি করতে চাই।’

সনি আক্তারের স্বামী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পড়াশুনার প্রতি আমার স্ত্রীর আকর্ষণ অনেক বেশি। তাই চাকরি, সংসার সবকিছু সামলে সে লেখাপাড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সনির জন্য গর্ববোধ করি।’

নারী প্রগতি সংঘের প্রশিক্ষক ও সমন্বয়ক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘আমরা চাই, সনি আরও এগিয়ে যাক। তার মতো প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা এগিয়ে যাক।’