বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ রাজকীয় মসজিদের সংখ্যায় তুরস্কের ইস্তাম্বুলকে ছাড়িয়ে যাবে এমন সাধ্য নেই বিশ্বের আর কোনো শহরের। সেখানে কমপক্ষে সাতটি রাজকীয় মসজিদ আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কোনো না কোনো অটোমান সুলতানের নাম। মূলত নিজের নাম শত শত বছর ধরে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জমকাল মসজিদ নির্মাণের প্রচলন ছিল তাদের মধ্যে।
সুলতানদের নির্মিত সেইসব মসজিদ আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তুরস্কের নানা প্রান্তে। তবে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর শাসকের অর্থায়নে মসজিদ নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্ক যখন ধর্ম-নিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করেন, তারপর থেকে এরদোয়ানের আগ পর্যন্ত কোনো শাসকের তত্ত্বাবধানে মসজিদ তৈরি হয়নি।
কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় থাকাকালীন তুরস্কের সরকার রাজনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে বিদায় করে পাশ্চাত্য মুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তর করে আরো একবার রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে সরিয়ে রাখার বার্তা দেন। কামাল পাশার আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল রাজধানীকে ইস্তাম্বুল থেকে সরিয়ে আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া। এর মাধ্যমে তিনি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছিলেন।
তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন আধুনিক তুরস্ক আর অটোমান সাম্রাজ্যের দিকে ফিরে যাবে না। পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণ করে তুরস্কের ইসলামি ঐতিহ্যকে চরমভাবে ধ্বংস করেছিলেন আতাতুর্ক। ফলে তুর্কিদের আবারো ইসলামি ভাবধারায় ফিরে যাওয়ার জন্য আতাতুর্কের বিপরীত মতাদর্শী একজন নেতার প্রয়োজন ছিল।
অবশেষে তুর্কিরা সেই নেতাকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি হলেন রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। যাকে অনেকে রাজনৈতিক উচ্চবিলাসের কারণে সুলতান এরদোয়ান নামে ডাকেন। আতাতুর্ক যেখানে আয়া সোফিয়া নামের পাশ থেকে মসজিদ শব্দটি কেটে দিয়েছিলেন, এরদোয়ান তা পুনরায় প্রতিস্থাপন করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, ১৯২৩ সালের পর তুরস্কের প্রথম শাসক হিসেবে তিনি চামলিজা নামের একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণ করেছেন। যা এরই মধ্যে এরদোয়ান মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তুরস্কের সর্ববৃহৎ এই মসজিদে একসঙ্গে ৬৩ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে ৩৫ বর্গ মিটারের আর্ট গ্যালারি, তিন হাজার বর্গ মিটারের কনফারেন্স হল। এছাড়াও মসজিদের ভেতরে তিন হাজার ৫০০ গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা রয়েছে।
চামলিজা মসজিদের বিশেষত হচ্ছে এর স্ট্রাকচার থেকে শুরু করে দরজা জানালার কাঁচ ও রং পর্যন্ত অটোমান নকশায় তৈরি করা হয়েছে। এরদোয়ানে চামলিজা মসজিদ অনেক রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। অটোমান সুলতানরা ইস্তাম্বুলের সাত পাহাড়ের চূড়ায় মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এতে করে মসজিদ পুরো ইস্তাম্বুল শহর থেকে দেখা যেত।
এরদোয়ানও সেই পথে হেঁটেছেন। বরং নিজেকে এক ধাপ এগিয়ে রেখেছেন তিনি। তার মসজিদ নির্মাণ করেছেন ইস্তাম্বুলের সাত পাহাড়ের মধ্যে সর্বোচ্চ চূড়া চামলিজায়। এই চূড়ার নামানুসারেই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে। যদিও লোকমুখে এখন তা এরদোয়ান মসজিদ নামেই পরিচিত। চামলিজা মসজিদের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তার মিনার সংখ্যা।
এই মসজিদে মোট ছয়টি মিনার রয়েছে, যার মধ্যে চারটি মিনার ১০৭.১ মিটার উঁচু, যা ১০৭১ সালে বাইজেনস্টাইন সাম্রাজ্যের বিপক্ষে সেলযুদ্ধদের মানজিকার্ত যুদ্ধজয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাকি দুটি মিনারের উচ্চতা ৯০ মিটার। ইস্তাম্বুলে চামলিজা মসজিদ ছাড়া একমাত্র সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মস্কে ছয়টি মিনার আছে।
চামলিজা মসজিদের ৭২ মিটার উঁচু ও ৩৪ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট প্রধান গম্বুজ কয়েক মাইল দূর থেকে দৃষ্টিগত হয়। গম্বুজটির উচ্চতা তুরস্কের ৭২টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানায়। আর ৩৪ মিটার ব্যাস জানান দেয় ইস্তাম্বুল শহরের গাড়ির নির্ধারিত নাম্বার প্লেটের কথা। অটোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলা হয় সুলেমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্টকে।
ইস্তাম্বুলের তার প্রতিষ্ঠিত সলেমানি মসজিদের গম্বুজের উচ্চতা ৫৩ মিটার, যা এতো দিন আয়া সোফিয়া ও সুলতান আহমেদ মসজিদকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সুলতান সুলেমানের মসজিদকেও ছাড়িয়ে গেছে চামলিজা তথা এরদোয়ান মসজিদের গম্বুজ।