ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সহজ মানুষ প্রাণের মানুষ

বাংলাদেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতির পদে আসীন হয়েছেন ওবায়দুল হাসান। পৃথিবীর সব দেশেই প্রধান বিচারপতির আসন ও দায়িত্ব অনেক বড়। দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে তার নেতৃত্ব ও বিজ্ঞ সিদ্ধান্তের ফল হয় বহুদূরব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির পদ আজীবন। আমাদের দেশে ৬৭ বছর। বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের রক্ষক তিনি। বিচারের সাধনা মূলত তপস্যার সাধনা। বিচার বিভাগ দেশের মানুষের এক পরম আস্থা ও ভরসার কেন্দ্র। তার নিয়োগ ঘিরে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব আশা ও আনন্দ তৈরি হয়েছে। আর তিনি সব শ্রেণির মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়েছেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি গণপরিষদের সদস্য হিসেবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন। আজ আমরা গৌরববোধ করি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ঔদার্যে, পরমতসহিষ্ণুতায়, মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে ও সব সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচারে পৃথিবীর আদর্শস্থল।

তিনি ১৯৭৮ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকাশিত হতে থাকে। তার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস, এমএসএস এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে ও ২০০৫ সালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তার বিরল গুণ ও যোগ্যতার কারণে তিনি ২০২০ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। সততা, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, কৃতিত্ব ও বিরল সাফল্যের কারণে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের লেখক হিসেবে আলাদা একটি পরিচয় আছে। লেখক হিসেবে জটিল বিষয়কে তিনি দক্ষ রূপকারের মতো নতুন করে প্রাণ দিতে পারেন। এ কারণে তার লেখা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘অবর্ণনীয় নির্মমতার চিত্র একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য’; ‘বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, একজন যুদ্ধশিশুর গল্প ও অন্যান্য’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের মনোলোক গঠনে তার পিতার প্রভাব ছিল গভীর ও ব্যাপক। তার পিতা ছিলেন একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। ওবায়দুল হাসান পূর্ব ময়মনসিংহের হিন্দু-মুসলমানের মিলিত নিঃশ্বাসে পুষ্ট মৈমনসিংহ গীতিকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতরে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি একজন নানা গুণ সমন্বিত পুরুষ। তিনি একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী মানুষ। তাকে আমরা কাছ থেকে জানি বলে একটি কথা বলতে চাই- তার মতো সৎ, কর্মবীর ও চারিত্রশক্তিসম্পন্ন মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। তার মধ্যে আমরা যে মেধা ও বুদ্ধির দীপ্তি দেখেছি, এতে আমাদের মনে এই বিশ্বাস জাগে- তিনি যদি আইন পেশায় থাকতেন, তা হলে সবচেয়ে নামিদামি আইনজীবী হতে পারতেন; যদি সিভিল সার্ভিসে আসতেন, তা হলে শীর্ষপদে আসীন হতেন; আর যদি রাজনীতি করতেন, তা হলে অনিবার্যভাবে বড় নেতৃত্বের পদ পেতেন। তিনি একজন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ। পার্থিব কোনো বিষয়ের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করে চলার মতো লোক তিনি নন। উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক ও মহৎ মূল্যবোধের প্রতীক তিনি। আমার কাছে একটি বিষয় অবাক লাগে- যখনই তার কাছে গিয়েছি, তখন তিনি তার শত কাজের মধ্যেও কথা বলার অবকাশ খুঁজে পেতেন। আমাদের জন্য অনেক সময় বরাদ্দ করতেন। কখনো কথা বলতে বলতে রাত গভীর হতো। কিন্তু কখনো তিনি ব্যস্ততা দেখাতেন না। মনে হতো, এই সাত্তিক মানুষটি যেন অন্তহীন ছুটির মধ্যে বসে আছেন। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু সবার প্রতি তার সমআচরণ। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ থেকে বিচিত্র ধরনের মানুষ তার সাহায্যপ্রার্থী হন। কাউকেই তিনি ফিরিয়ে দেন না। শত কাজের মধ্যে তিনি এত অবকাশ কেমন করে মেলাতে পারেন, সেটি আমার কাছে এক রহস্যের বিষয়। তার কণ্ঠস্বর নিটোল ও সুন্দর। তার উচ্চারণ স্পষ্ট ও দৃঢ়। তার হাসিমুখে অভ্যর্থনার মধুরতা ও আলাপের আন্তরিকতা কখনো ভোলার নয়। তার অন্য একটি মহৎ গুণ হলোÑ যখন কাউকে তিনি কাছে ডাকেন, তখন তার প্রতি সবটুকু মনোনিবেশ করেন। তার সঙ্গে কথা বলে যখন বেরিয়ে আসতাম, তখন মনে হতো আমাদের মলিন জীবন আনন্দে ভরে উঠল। আমাদের জীবন ধন্য হলো। তিনি একজন অসাধারণ সজ্জন ব্যক্তি। তার পঠনের পরিধি বিরাট। তিনি একজন আলাপ দক্ষ এবং অনেক বিষয়ে বিদ্বানমনস্বী ব্যক্তি। মাথা হেঁট করার মানুষ তিনি নন। তার সংকল্প, সংযম ও সাহস কিংবদন্তিতুল্য।

বাংলাদেশে নানা কারণে ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের অর্থ ও সময়ের অপচয় ঘটছে। এ কারণে পরোক্ষভাবে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের হতাশা বাড়ছে। আমাদের পবিত্র সংবিধান মৌলিক মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের, ধর্মের স্বাধীনতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব সোনালি আদর্শ থাকা সত্ত্বেও বিচারের বাণী এ দেশে বছরের পর নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। আমাদের দেশে একজন বিচারক তুলাদণ্ডের ভার বহন করেন। দেশে মৌলিক অধিকারের সঠিক সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান সুপ্রিমকোর্টের দায়িত্ব। আজ বাংলাদেশের বহু বাচনিক সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বিচার বিভাগ ওই ব্যাপক দুর্ভোগ কমাতে পারে যদি এই আস্থা তৈরি হয় যে- আদালতে যিনি পৌরোহিত্য করবেন, তিনি ভয় বা অনুগ্রহ, অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী সমান আচরণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন বার্জার একবার বলেছিলেন, ‘সম্ভাব্য ন্যূনতম ব্যয়ে সম্ভাব্য ন্যূনতম সময়ে এবং পক্ষদের ওপর সামান্যতম চাপ রেখে ন্যায়বিচার সাধন করাই হবে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির কাজ।’

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত, স্নিগ্ধকোমল সজ্জন ব্যক্তিত্ব, অনুপম চারিত্রশক্তির অধিকারী, নিরহঙ্কার, বিনয়ী, সৎ, সর্বজনীন শ্রদ্ধার পাত্র, কর্মবীর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে আমরা আন্তরিকভাবে বরণ করি। তার তপস্যায় বাঙালির ন্যায়বিচারের আজীবন লালিত স্বপ্ন সার্থকতা লাভ করুক- আমাদের প্রাণের মানুষটির কাছে এই প্রত্যাশা।

মাসুদ সিদ্দিকী : সাবেক সচিব

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

সহজ মানুষ প্রাণের মানুষ

আপডেট টাইম : ০৭:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩

বাংলাদেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতির পদে আসীন হয়েছেন ওবায়দুল হাসান। পৃথিবীর সব দেশেই প্রধান বিচারপতির আসন ও দায়িত্ব অনেক বড়। দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে তার নেতৃত্ব ও বিজ্ঞ সিদ্ধান্তের ফল হয় বহুদূরব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতির পদ আজীবন। আমাদের দেশে ৬৭ বছর। বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের রক্ষক তিনি। বিচারের সাধনা মূলত তপস্যার সাধনা। বিচার বিভাগ দেশের মানুষের এক পরম আস্থা ও ভরসার কেন্দ্র। তার নিয়োগ ঘিরে বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব আশা ও আনন্দ তৈরি হয়েছে। আর তিনি সব শ্রেণির মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়েছেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি গণপরিষদের সদস্য হিসেবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন। আজ আমরা গৌরববোধ করি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ঔদার্যে, পরমতসহিষ্ণুতায়, মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে ও সব সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচারে পৃথিবীর আদর্শস্থল।

তিনি ১৯৭৮ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকাশিত হতে থাকে। তার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস, এমএসএস এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে ও ২০০৫ সালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তার বিরল গুণ ও যোগ্যতার কারণে তিনি ২০২০ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। সততা, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, কৃতিত্ব ও বিরল সাফল্যের কারণে ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের লেখক হিসেবে আলাদা একটি পরিচয় আছে। লেখক হিসেবে জটিল বিষয়কে তিনি দক্ষ রূপকারের মতো নতুন করে প্রাণ দিতে পারেন। এ কারণে তার লেখা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘অবর্ণনীয় নির্মমতার চিত্র একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য’; ‘বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, একজন যুদ্ধশিশুর গল্প ও অন্যান্য’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের মনোলোক গঠনে তার পিতার প্রভাব ছিল গভীর ও ব্যাপক। তার পিতা ছিলেন একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। ওবায়দুল হাসান পূর্ব ময়মনসিংহের হিন্দু-মুসলমানের মিলিত নিঃশ্বাসে পুষ্ট মৈমনসিংহ গীতিকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতরে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি একজন নানা গুণ সমন্বিত পুরুষ। তিনি একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী মানুষ। তাকে আমরা কাছ থেকে জানি বলে একটি কথা বলতে চাই- তার মতো সৎ, কর্মবীর ও চারিত্রশক্তিসম্পন্ন মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। তার মধ্যে আমরা যে মেধা ও বুদ্ধির দীপ্তি দেখেছি, এতে আমাদের মনে এই বিশ্বাস জাগে- তিনি যদি আইন পেশায় থাকতেন, তা হলে সবচেয়ে নামিদামি আইনজীবী হতে পারতেন; যদি সিভিল সার্ভিসে আসতেন, তা হলে শীর্ষপদে আসীন হতেন; আর যদি রাজনীতি করতেন, তা হলে অনিবার্যভাবে বড় নেতৃত্বের পদ পেতেন। তিনি একজন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ। পার্থিব কোনো বিষয়ের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করে চলার মতো লোক তিনি নন। উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক ও মহৎ মূল্যবোধের প্রতীক তিনি। আমার কাছে একটি বিষয় অবাক লাগে- যখনই তার কাছে গিয়েছি, তখন তিনি তার শত কাজের মধ্যেও কথা বলার অবকাশ খুঁজে পেতেন। আমাদের জন্য অনেক সময় বরাদ্দ করতেন। কখনো কথা বলতে বলতে রাত গভীর হতো। কিন্তু কখনো তিনি ব্যস্ততা দেখাতেন না। মনে হতো, এই সাত্তিক মানুষটি যেন অন্তহীন ছুটির মধ্যে বসে আছেন। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যক্তি তিনি। তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু সবার প্রতি তার সমআচরণ। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ থেকে বিচিত্র ধরনের মানুষ তার সাহায্যপ্রার্থী হন। কাউকেই তিনি ফিরিয়ে দেন না। শত কাজের মধ্যে তিনি এত অবকাশ কেমন করে মেলাতে পারেন, সেটি আমার কাছে এক রহস্যের বিষয়। তার কণ্ঠস্বর নিটোল ও সুন্দর। তার উচ্চারণ স্পষ্ট ও দৃঢ়। তার হাসিমুখে অভ্যর্থনার মধুরতা ও আলাপের আন্তরিকতা কখনো ভোলার নয়। তার অন্য একটি মহৎ গুণ হলোÑ যখন কাউকে তিনি কাছে ডাকেন, তখন তার প্রতি সবটুকু মনোনিবেশ করেন। তার সঙ্গে কথা বলে যখন বেরিয়ে আসতাম, তখন মনে হতো আমাদের মলিন জীবন আনন্দে ভরে উঠল। আমাদের জীবন ধন্য হলো। তিনি একজন অসাধারণ সজ্জন ব্যক্তি। তার পঠনের পরিধি বিরাট। তিনি একজন আলাপ দক্ষ এবং অনেক বিষয়ে বিদ্বানমনস্বী ব্যক্তি। মাথা হেঁট করার মানুষ তিনি নন। তার সংকল্প, সংযম ও সাহস কিংবদন্তিতুল্য।

বাংলাদেশে নানা কারণে ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের অর্থ ও সময়ের অপচয় ঘটছে। এ কারণে পরোক্ষভাবে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের হতাশা বাড়ছে। আমাদের পবিত্র সংবিধান মৌলিক মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের, ধর্মের স্বাধীনতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব সোনালি আদর্শ থাকা সত্ত্বেও বিচারের বাণী এ দেশে বছরের পর নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। আমাদের দেশে একজন বিচারক তুলাদণ্ডের ভার বহন করেন। দেশে মৌলিক অধিকারের সঠিক সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান সুপ্রিমকোর্টের দায়িত্ব। আজ বাংলাদেশের বহু বাচনিক সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, বিচার বিভাগ ওই ব্যাপক দুর্ভোগ কমাতে পারে যদি এই আস্থা তৈরি হয় যে- আদালতে যিনি পৌরোহিত্য করবেন, তিনি ভয় বা অনুগ্রহ, অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী সমান আচরণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন বার্জার একবার বলেছিলেন, ‘সম্ভাব্য ন্যূনতম ব্যয়ে সম্ভাব্য ন্যূনতম সময়ে এবং পক্ষদের ওপর সামান্যতম চাপ রেখে ন্যায়বিচার সাধন করাই হবে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির কাজ।’

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত, স্নিগ্ধকোমল সজ্জন ব্যক্তিত্ব, অনুপম চারিত্রশক্তির অধিকারী, নিরহঙ্কার, বিনয়ী, সৎ, সর্বজনীন শ্রদ্ধার পাত্র, কর্মবীর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে আমরা আন্তরিকভাবে বরণ করি। তার তপস্যায় বাঙালির ন্যায়বিচারের আজীবন লালিত স্বপ্ন সার্থকতা লাভ করুক- আমাদের প্রাণের মানুষটির কাছে এই প্রত্যাশা।

মাসুদ সিদ্দিকী : সাবেক সচিব