ঢাকা , শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের যোদ্ধা হস্তিরা যেমন ছিল

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ গ্রিকরা যখন মগধ রাজ্যের উপকণ্ঠে বিশ্বজয়ের অভিপ্রায়ে তখন তারা হাতি নামের এক বিশাল যোদ্ধা প্রাণীর নাম শুনতে পায় যা মগধ রাজার সেনাবাহিনীতে এক বিশেষ ভূমিকা রাখে। ভয়ে গ্রিক সেনারা আর এগোতে সাহস পায় না। পাল ও সেন রাজাদের হাতির বহরের কথা তাদের সভা কবিরা বিভিন্ন উপমা দিয়ে লিখে গেছেন। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজের হাতির পাল ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকাকেও ঐতিহাসিকরা পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে বলে দাবি করেন।
মোগলদের সঙ্গে বাংলার বারো ভুইয়াদের যুদ্ধে হাতির ভূমিকার গুরুত্ব বোঝাতে একটি মাপকাঠি উল্লেখ করা হয়। মোগলরা বারো ভুইয়াদের আত্মসমর্পণের যে শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল হাতি সম্পর্কিত। পরাজিত ভুইয়াদের হাতিসালার সব ‘ফিলান-ই-দান্দানদার’ মানে সমস্ত দাতাল যোদ্ধা হাতি মোগলদের হাতে সমর্পণ করতে হবে। সঙ্গে থাকবে আত্মসমর্পণকারী নেতার কোনো ভাই বা ছেলে। হাতি আর নৌকা থাকলে বাংলার জলাজঙ্গলে ঘোড়া না হাতিই মূল যুদ্ধাস্ত্র ছিল।
এই হাতিগুলো ছিল আধুনিক ট্যাংকের মতো যা পদাতিক আর ঘোড়াসওয়ার বাহিনীকে নিমেষে ছত্রভঙ্গ করে দিত। মোগল সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে তার সেনা দল সাজাতেন বারো ভুইয়াদের হাতি বাহিনীকে মাথায় রেখে। মোগল সেনাবাহিনীর একটা স্পেশালাইজড দল থাকত আধুনিক কমান্ডোদের মতো যাদের কাজই ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধা হাতিগুলোর পা কেটে অকেজো করে দেয়া।
ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার বারো ভুইয়ার এক ভুইয়া খাজা ওসমানের প্রধান দুটি হাতির নাম উল্লেখ্যে করেছেন বাজ ও বখত। মির্জা নাথান খাজা ওসমানের আরো কয়টি যুদ্ধ হাতির নাম উল্লেখ্য করেছেন তার ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’তে অনুপা, সিঙ্গালী, দাস্তা, শতরঞ্জী। মোগল হাতিগুলোর মধ্যে নামকরা ছিল বাঘদলন, বালসুন্দর, চঞ্চল, ফাতহা, গোপাল ও রনসিঙ্গার। সিলেটের ভুইয়া বায়জিদের প্রধান হাতির নাম ছিল ‘আবর’। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান দ্ব্যর্থহীনভাবে তার হাতিগুলোর তুলনায় যে বারো ভুইয়াদের হাতি অনেক উৎকৃষ্ট যোদ্ধা ছিল সেটা স্বীকার করে গেছেন।
নাথান মির্জা ওসমানের প্রধান হাতি ‘বাখতা’রের বীরত্বের বর্ণনা দিয়েছেন তার লেখায়। বাখতা ছিল আকারে পাহাড়ের মতো। দুর্গের পাথর ভেঙে ফেলার মতো শক্তি বাখতার ছিল। যুদ্ধের মাঠে মাহুতের হুকুম ছাড়া বাখতাকে এক পা ও নড়ানো যেত না এই বিশেষ গুণের জন্য বাখতা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাদশাহ জাহাঙ্গীর বাখতাকে তার জীবন স্মৃতিতে ‘গজপতি’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এসব যুদ্ধ হাতি যুদ্ধের ময়দানে ইস্পাত নির্মিত বর্মের মতো আচ্ছাদান ব্যবহার করত যাকে বলা হতো ‘পাখার’। ইকবাল নামায় লেখা আছে খাজা ওসমান বাখতাকে সামনে রেখে মোগলদের আক্রমণ করতেন। আবার কখনো কখনো বাখতাকে লুকিয়ে রেখে অন্য হাতি দিয়ে আক্রমণ শানানো হতো। বাখতাকে লুকিয়ে রাখা হতো। যুদ্ধের বিশেষ মুহূর্তে সেই লুকানো বন জঙ্গল ভেদ করে চলমান দুর্গের মতো যখন বাখতা যুদ্ধের ময়দানে ধেয়ে আসত শত্রু তখন পালানোর পথ পেত না।
মির্জা ওসমানের সঙ্গে মির্জা নাথানের দৌলাম্বাপুরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক যুদ্ধে হাতির যুদ্ধের বেশ ভালো একটা বর্ণনা দেয়া আছে। সে যুদ্ধে মোগল হাতি ‘গোপাল’ বাংলার হাতির পরাক্রমের সামনে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়, মির্জা নাথানের শক্তিশালী হাতি ‘বাঘদলন’কে ওসমানের আর একটি হাতি ‘অনুপা’ নাজেহাল করে। নাথানের দুরন্ত হাতি ‘চঞ্চল’ ওসমানের অমিত বিক্রমশালী ‘বাখতা’র দিকে তেড়ে যায় কিন্তু বাখতার এর সওয়ারী গোলন্দাজদের গুলির আঘাতে আহত হয়ে চঞ্চল পালিয়ে যায়। এই দৌলাম্বপুর যুদ্ধে মির্জা ওসমান নিহত হলে মির্জা ওসমানের ছেলে আর ভাইয়েরা বাখতা কে নিয়ে মির্জা নাথানের মোগলসেনাদের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাখতার আক্রমণে মোগল বাহিনী খড়কুটোর মতো উড়তে থাকে। একপর্যায়ে যুদ্ধ মদমত্ত বাখতা মির্জা নাথানের নাগাল পেয়ে তার ঘোড়াসহ শুঁড় দিয়ে তুলে ফেলে দূরে ছুড়ে ফেলে। ভাগ্য ভালো সে যাত্রায় মির্জা নাথান আহত হলেও জানে বেঁচে যান। মোগল সেনারা ঘিরে ফেলে বাখতাকে। ধারালো তলোয়ার দিয়ে বাখতার পা, শুঁড় আর দাঁত কেটে ফেলতে থাকে। এ অবস্থাতেও মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে বাখতা। একপর্যায়ে প্রভু মির্জা ওসমানের বীরের মতো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। বন্দি হওয়ার থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীরের মৃত্যুকেই বেছে নেন মির্জা ওসমান আর তার প্রাণপ্রিয় যুদ্ধ হাতি বাখতা। গোলামির থেকে সম্মানজনক মৃত্যু অনেক মহিমার।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ইতিহাসের যোদ্ধা হস্তিরা যেমন ছিল

আপডেট টাইম : ১১:৩১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ গ্রিকরা যখন মগধ রাজ্যের উপকণ্ঠে বিশ্বজয়ের অভিপ্রায়ে তখন তারা হাতি নামের এক বিশাল যোদ্ধা প্রাণীর নাম শুনতে পায় যা মগধ রাজার সেনাবাহিনীতে এক বিশেষ ভূমিকা রাখে। ভয়ে গ্রিক সেনারা আর এগোতে সাহস পায় না। পাল ও সেন রাজাদের হাতির বহরের কথা তাদের সভা কবিরা বিভিন্ন উপমা দিয়ে লিখে গেছেন। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজের হাতির পাল ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকাকেও ঐতিহাসিকরা পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে বলে দাবি করেন।
মোগলদের সঙ্গে বাংলার বারো ভুইয়াদের যুদ্ধে হাতির ভূমিকার গুরুত্ব বোঝাতে একটি মাপকাঠি উল্লেখ করা হয়। মোগলরা বারো ভুইয়াদের আত্মসমর্পণের যে শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল হাতি সম্পর্কিত। পরাজিত ভুইয়াদের হাতিসালার সব ‘ফিলান-ই-দান্দানদার’ মানে সমস্ত দাতাল যোদ্ধা হাতি মোগলদের হাতে সমর্পণ করতে হবে। সঙ্গে থাকবে আত্মসমর্পণকারী নেতার কোনো ভাই বা ছেলে। হাতি আর নৌকা থাকলে বাংলার জলাজঙ্গলে ঘোড়া না হাতিই মূল যুদ্ধাস্ত্র ছিল।
এই হাতিগুলো ছিল আধুনিক ট্যাংকের মতো যা পদাতিক আর ঘোড়াসওয়ার বাহিনীকে নিমেষে ছত্রভঙ্গ করে দিত। মোগল সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে তার সেনা দল সাজাতেন বারো ভুইয়াদের হাতি বাহিনীকে মাথায় রেখে। মোগল সেনাবাহিনীর একটা স্পেশালাইজড দল থাকত আধুনিক কমান্ডোদের মতো যাদের কাজই ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধা হাতিগুলোর পা কেটে অকেজো করে দেয়া।
ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার বারো ভুইয়ার এক ভুইয়া খাজা ওসমানের প্রধান দুটি হাতির নাম উল্লেখ্যে করেছেন বাজ ও বখত। মির্জা নাথান খাজা ওসমানের আরো কয়টি যুদ্ধ হাতির নাম উল্লেখ্য করেছেন তার ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’তে অনুপা, সিঙ্গালী, দাস্তা, শতরঞ্জী। মোগল হাতিগুলোর মধ্যে নামকরা ছিল বাঘদলন, বালসুন্দর, চঞ্চল, ফাতহা, গোপাল ও রনসিঙ্গার। সিলেটের ভুইয়া বায়জিদের প্রধান হাতির নাম ছিল ‘আবর’। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান দ্ব্যর্থহীনভাবে তার হাতিগুলোর তুলনায় যে বারো ভুইয়াদের হাতি অনেক উৎকৃষ্ট যোদ্ধা ছিল সেটা স্বীকার করে গেছেন।
নাথান মির্জা ওসমানের প্রধান হাতি ‘বাখতা’রের বীরত্বের বর্ণনা দিয়েছেন তার লেখায়। বাখতা ছিল আকারে পাহাড়ের মতো। দুর্গের পাথর ভেঙে ফেলার মতো শক্তি বাখতার ছিল। যুদ্ধের মাঠে মাহুতের হুকুম ছাড়া বাখতাকে এক পা ও নড়ানো যেত না এই বিশেষ গুণের জন্য বাখতা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাদশাহ জাহাঙ্গীর বাখতাকে তার জীবন স্মৃতিতে ‘গজপতি’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এসব যুদ্ধ হাতি যুদ্ধের ময়দানে ইস্পাত নির্মিত বর্মের মতো আচ্ছাদান ব্যবহার করত যাকে বলা হতো ‘পাখার’। ইকবাল নামায় লেখা আছে খাজা ওসমান বাখতাকে সামনে রেখে মোগলদের আক্রমণ করতেন। আবার কখনো কখনো বাখতাকে লুকিয়ে রেখে অন্য হাতি দিয়ে আক্রমণ শানানো হতো। বাখতাকে লুকিয়ে রাখা হতো। যুদ্ধের বিশেষ মুহূর্তে সেই লুকানো বন জঙ্গল ভেদ করে চলমান দুর্গের মতো যখন বাখতা যুদ্ধের ময়দানে ধেয়ে আসত শত্রু তখন পালানোর পথ পেত না।
মির্জা ওসমানের সঙ্গে মির্জা নাথানের দৌলাম্বাপুরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক যুদ্ধে হাতির যুদ্ধের বেশ ভালো একটা বর্ণনা দেয়া আছে। সে যুদ্ধে মোগল হাতি ‘গোপাল’ বাংলার হাতির পরাক্রমের সামনে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়, মির্জা নাথানের শক্তিশালী হাতি ‘বাঘদলন’কে ওসমানের আর একটি হাতি ‘অনুপা’ নাজেহাল করে। নাথানের দুরন্ত হাতি ‘চঞ্চল’ ওসমানের অমিত বিক্রমশালী ‘বাখতা’র দিকে তেড়ে যায় কিন্তু বাখতার এর সওয়ারী গোলন্দাজদের গুলির আঘাতে আহত হয়ে চঞ্চল পালিয়ে যায়। এই দৌলাম্বপুর যুদ্ধে মির্জা ওসমান নিহত হলে মির্জা ওসমানের ছেলে আর ভাইয়েরা বাখতা কে নিয়ে মির্জা নাথানের মোগলসেনাদের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাখতার আক্রমণে মোগল বাহিনী খড়কুটোর মতো উড়তে থাকে। একপর্যায়ে যুদ্ধ মদমত্ত বাখতা মির্জা নাথানের নাগাল পেয়ে তার ঘোড়াসহ শুঁড় দিয়ে তুলে ফেলে দূরে ছুড়ে ফেলে। ভাগ্য ভালো সে যাত্রায় মির্জা নাথান আহত হলেও জানে বেঁচে যান। মোগল সেনারা ঘিরে ফেলে বাখতাকে। ধারালো তলোয়ার দিয়ে বাখতার পা, শুঁড় আর দাঁত কেটে ফেলতে থাকে। এ অবস্থাতেও মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে বাখতা। একপর্যায়ে প্রভু মির্জা ওসমানের বীরের মতো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। বন্দি হওয়ার থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীরের মৃত্যুকেই বেছে নেন মির্জা ওসমান আর তার প্রাণপ্রিয় যুদ্ধ হাতি বাখতা। গোলামির থেকে সম্মানজনক মৃত্যু অনেক মহিমার।