ঢাকা , সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরবানি একটি মহান ইবাদত

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করেছেন। এ ত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং মনের পশুত্বকে দমন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করে থাকে। কোরআনে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন তারা যেন সেগুলোর ওপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ: ৩৪)

ইসলামি জীবন বিধানে ‘কোরবানি’ একটি মহান ইবাদত। হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এর মহান আত্মত্যাগের অনন্য নজির হলো এ ‘পশু কোরবানি’। কুরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। আরবি বর্ষ পঞ্জিকার সর্বশেষ মাস ‘জিলহজ’ এর ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে পশু জবাই করা হয় তাকে কোরবানি বলা হয়। ঈদুল আজহার প্রধান কাজ হচ্ছে ঈদের নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা।

কোরবানি শুধু একটা আনন্দ উৎসবই নয়, এটা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন এবং আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে বিশেষ ইবাদত ও তাঁর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জীবন-মৃত্যু, নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের মতো বিশেষ দিনে পশু জবাইকেও রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করার নির্দেশনা দিয়ে ‘কোরবানির’ তাৎপর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে ‘আপনি বলুন আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ (সূরা আনআম : ১৬২)।

মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে কোরবানি প্রথা চালু হয় এবং আল্লাহ তায়ালা মানব বংশ বিস্তারের জন্য হজরত আদম (আ.) এর সন্তানদের জন্য ‘বিবাহের’ বিশেষ বিধান জারি করেন। কিন্তু হজরত আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল সে বিধান লঙ্ঘন করতে চাইলে তার দুই পুত্রের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের মতভেদ দূর করার জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজ নিজ কোরবানি পেশ করেন। ওই সময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন এসে কোরবানিকে ভস্মীভূত করে দিত। যে কোরবানিকে আগুন ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো।

হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পালন করত, সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কোরবানি করল। কাবিল কৃষিকাজ করত, সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কোরবানি জন্য পেশ করল। আকাশ থেকে আগুন এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কোরবানি জমিনেই পড়ে রইল। আল্লাহ তায়ালার দরবারে এভাবেই মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘আর তাদের কাছে সঠিকভাবে বর্ণনা করো দুই আদম সন্তানের কাহিনি, কেমন করে তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল; কিন্তু তা কবুল হলো তাদের একজনের কাছ থেকে, অপরজনের কাছ থেকে তা গৃহীত হলো না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।’ অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ তো শুধু মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কবুল করেন।’ (সূরা মায়িদা : ২৭)।

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করেছেন। এ ত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং মনের পশুত্বকে দমন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করে থাকে। কোরআনে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন তারা যেন সেগুলোর ওপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ : ৩৪)। জাহেলি যুগেও কাফের-মোশরেকরা তাদের মূর্তির নামে পশু কোরবানি করত এবং কোরবানি পশুর গোশত মূর্তির সামনে রাখত ও তার রক্ত মূর্তির ওপর ছিটিয়ে দিত।

কিন্তু ইসলামের বিধান হলো একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এবং তাঁর নামেই কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা ও রিজিকদাতা, তিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। কোরবানিকৃত পশুর গোশত বা রক্ত তাঁর প্রয়োজন নেই। মূলত এ কোরবানির দ্বারা আল্লাহর একত্ববাদ ও সবকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা হয় এবং শুধু কোরবানিদাতার তাকওয়া ও পরহেজগারিতাই তাঁর কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ ‘এগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এই কারণে যে, তিনি তোমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা হজ : ৩৭)। এ প্রসঙ্গ হাদিসে এসেছে ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা দেখেন না এবং তোমাদের সম্পদও দেখেন না; বরং তোমাদের অন্তর দেখেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৪)।

আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.) এর মাধ্যমে মানবজাতিকে চতুষ্পদ জন্তু কোরবানির বিধান দেন। পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ধৈর্যশীলতার মাধ্যমে সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দৃষ্টান্ন স্থাপন করেন। চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি মূলত একটি প্রতীকী কোরবানি, যার মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের বিধান বাস্তবায়ন করে নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সমর্পণ করার মাধ্যমে সৎকর্মশীল বান্দা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে ‘অতঃপর যখন তার ছেলে তার সঙ্গে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, অতএব তোমার কী অভিমত? পুত্র বলল : হে আমার পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন।

ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শুয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান জবাইয়ের বিনিময়ে।’ (সূরা সাফফাত : ১০২-১০৭)।

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ। হজের মৌসুমে যারা হজ ও ওমরা একসঙ্গে আদায় করে তাদের আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি করতে হয়। কোরআনে কোরবানির এ পশুগুলোকে ‘আল্লাহর বিশেষ চিহ্ন বা নিদর্শন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজের বিভিন্ন বিধিবিধান ইহরাম পরিধান করা, মাথা মু-ন করা ও বিভিন্ন স্থান কাবা, সাফা-মারওয়া পাহাড়, মিনা, আরাফা, মুজদালিফার মতো ‘কোরবানির এ পশু’ও ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। কোরআনে এ পশুকে ‘হাদি’, ‘বুদন’ ও তার বিশেষ চিহ্নকে ‘কালাঈদ’ বলে উল্লেখ করে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হজে ‘পশু কোরবানি’ এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, কোনো কারণে পশু কোরবানি করতে না পারলে পরিবর্তে রোজা ব্রত পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মানবজাতির মতো এ পশু আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি এবং এ সৃষ্টির মাধ্যমে তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে। ইসলামি বিধানে পশুর সব অধিকার সংরক্ষণ করে জবাইয়ের সময় তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ বর্জন করে ‘ইহসান’ করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত শাদ্দাদ ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর প্রতি ইহসান করা ফরজ করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে, আর যখন জবাই করবে, তখন উত্তম পন্থায় জবাই করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকেরই ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া উচিত এবং জবাইকৃত জন্তুকে ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত। (নাসায়ি)।

তাই আসুন, ইসলামের বিধান অনুযায়ী ‘পশু কোরবানি’ করে আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি এবং এ মহান ইবাদতের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি।

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, উত্তরা ইউনিভার্সিটি

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

কোরবানি একটি মহান ইবাদত

আপডেট টাইম : ০৬:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৭ অগাস্ট ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করেছেন। এ ত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং মনের পশুত্বকে দমন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করে থাকে। কোরআনে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন তারা যেন সেগুলোর ওপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ: ৩৪)

ইসলামি জীবন বিধানে ‘কোরবানি’ একটি মহান ইবাদত। হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এর মহান আত্মত্যাগের অনন্য নজির হলো এ ‘পশু কোরবানি’। কুরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। আরবি বর্ষ পঞ্জিকার সর্বশেষ মাস ‘জিলহজ’ এর ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে পশু জবাই করা হয় তাকে কোরবানি বলা হয়। ঈদুল আজহার প্রধান কাজ হচ্ছে ঈদের নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা।

কোরবানি শুধু একটা আনন্দ উৎসবই নয়, এটা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন এবং আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে বিশেষ ইবাদত ও তাঁর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জীবন-মৃত্যু, নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের মতো বিশেষ দিনে পশু জবাইকেও রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করার নির্দেশনা দিয়ে ‘কোরবানির’ তাৎপর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে ‘আপনি বলুন আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ (সূরা আনআম : ১৬২)।

মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে কোরবানি প্রথা চালু হয় এবং আল্লাহ তায়ালা মানব বংশ বিস্তারের জন্য হজরত আদম (আ.) এর সন্তানদের জন্য ‘বিবাহের’ বিশেষ বিধান জারি করেন। কিন্তু হজরত আদম (আ.) এর পুত্র কাবিল সে বিধান লঙ্ঘন করতে চাইলে তার দুই পুত্রের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের মতভেদ দূর করার জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজ নিজ কোরবানি পেশ করেন। ওই সময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন এসে কোরবানিকে ভস্মীভূত করে দিত। যে কোরবানিকে আগুন ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো।

হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পালন করত, সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কোরবানি করল। কাবিল কৃষিকাজ করত, সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কোরবানি জন্য পেশ করল। আকাশ থেকে আগুন এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কোরবানি জমিনেই পড়ে রইল। আল্লাহ তায়ালার দরবারে এভাবেই মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘আর তাদের কাছে সঠিকভাবে বর্ণনা করো দুই আদম সন্তানের কাহিনি, কেমন করে তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল; কিন্তু তা কবুল হলো তাদের একজনের কাছ থেকে, অপরজনের কাছ থেকে তা গৃহীত হলো না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব।’ অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ তো শুধু মুত্তাকিদের পক্ষ থেকে কবুল করেন।’ (সূরা মায়িদা : ২৭)।

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান নির্ধারণ করেছেন। এ ত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং মনের পশুত্বকে দমন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করে থাকে। কোরআনে এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দান করেছেন তারা যেন সেগুলোর ওপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ : ৩৪)। জাহেলি যুগেও কাফের-মোশরেকরা তাদের মূর্তির নামে পশু কোরবানি করত এবং কোরবানি পশুর গোশত মূর্তির সামনে রাখত ও তার রক্ত মূর্তির ওপর ছিটিয়ে দিত।

কিন্তু ইসলামের বিধান হলো একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এবং তাঁর নামেই কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা ও রিজিকদাতা, তিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। কোরবানিকৃত পশুর গোশত বা রক্ত তাঁর প্রয়োজন নেই। মূলত এ কোরবানির দ্বারা আল্লাহর একত্ববাদ ও সবকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করা হয় এবং শুধু কোরবানিদাতার তাকওয়া ও পরহেজগারিতাই তাঁর কাছে পৌঁছায়। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ ‘এগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এই কারণে যে, তিনি তোমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা হজ : ৩৭)। এ প্রসঙ্গ হাদিসে এসেছে ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা দেখেন না এবং তোমাদের সম্পদও দেখেন না; বরং তোমাদের অন্তর দেখেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৪)।

আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.) এর মাধ্যমে মানবজাতিকে চতুষ্পদ জন্তু কোরবানির বিধান দেন। পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ধৈর্যশীলতার মাধ্যমে সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দৃষ্টান্ন স্থাপন করেন। চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি মূলত একটি প্রতীকী কোরবানি, যার মাধ্যমে মানবজাতি আল্লাহর একত্ববাদের বিধান বাস্তবায়ন করে নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সমর্পণ করার মাধ্যমে সৎকর্মশীল বান্দা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে ‘অতঃপর যখন তার ছেলে তার সঙ্গে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, অতএব তোমার কী অভিমত? পুত্র বলল : হে আমার পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন।

ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়েই আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শুয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান জবাইয়ের বিনিময়ে।’ (সূরা সাফফাত : ১০২-১০৭)।

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ। হজের মৌসুমে যারা হজ ও ওমরা একসঙ্গে আদায় করে তাদের আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ চতুষ্পদ জন্তু কোরবানি করতে হয়। কোরআনে কোরবানির এ পশুগুলোকে ‘আল্লাহর বিশেষ চিহ্ন বা নিদর্শন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজের বিভিন্ন বিধিবিধান ইহরাম পরিধান করা, মাথা মু-ন করা ও বিভিন্ন স্থান কাবা, সাফা-মারওয়া পাহাড়, মিনা, আরাফা, মুজদালিফার মতো ‘কোরবানির এ পশু’ও ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। কোরআনে এ পশুকে ‘হাদি’, ‘বুদন’ ও তার বিশেষ চিহ্নকে ‘কালাঈদ’ বলে উল্লেখ করে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হজে ‘পশু কোরবানি’ এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, কোনো কারণে পশু কোরবানি করতে না পারলে পরিবর্তে রোজা ব্রত পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মানবজাতির মতো এ পশু আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি এবং এ সৃষ্টির মাধ্যমে তারা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে। ইসলামি বিধানে পশুর সব অধিকার সংরক্ষণ করে জবাইয়ের সময় তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ বর্জন করে ‘ইহসান’ করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত শাদ্দাদ ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর প্রতি ইহসান করা ফরজ করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে, আর যখন জবাই করবে, তখন উত্তম পন্থায় জবাই করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকেরই ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া উচিত এবং জবাইকৃত জন্তুকে ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত। (নাসায়ি)।

তাই আসুন, ইসলামের বিধান অনুযায়ী ‘পশু কোরবানি’ করে আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি এবং এ মহান ইবাদতের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি।

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, উত্তরা ইউনিভার্সিটি