ঢাকার দুই মেয়রের এক বছরের কার্যক্রমে অনেক নগরবাসীই কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তবে সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য এক বছর সময় যথেষ্ট হিসেবে মনে করছেন না কেউ। উভয় মেয়রই বলছেন, তারা নগর দুর্ভোগ ঘোচাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয় বছর পূর্ণ হলে উন্নয়নের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। গত বছরের ৬ মে দুই মেয়র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনসভা ও জনসংযোগকালে দেওয়া তাদের ওয়াদা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দু-একটি বিষয় ছাড়া প্রায় দু’জনেরই ওয়াদা ছিল অভিন্ন। নিরাপদ, বাসযোগ্য, যানজট-জলাবদ্ধতা-সন্ত্রাস-মশক-বর্জ্য-মাদকমুক্ত পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী উপহার দেওয়া। এ ছাড়া ছিল আধুনিক রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পর্যাপ্ত সড়কবাতি, বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা প্রভৃতি।
এই প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘এই এক বছর সময়কে প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। দ্বিতীয় বছর থেকে জনগণ বাস্তব প্রতিফলন দেখতে চাইবে। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে নগরীর সব ধরনের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। সব ক্ষমতা তো মেয়রের হাতে নেই। তারপরও কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের রাস্তা দখলমুক্ত হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস সিস্টেম ও বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার উদ্যোগগুলো দেখা গেছে। এগুলো ভালো লক্ষণ। সরকারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে তাদের কাজগুলো করতে হবে।’ নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, ‘তারা কিছু ভালো কাজ করেছেন।
এ জন্য তাদের স্যালুট দিই।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা ওয়াদা দিয়েছিলেন_ সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে খালগুলো পরিষ্কার করবেন। তবে কোনো ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দেখিনি এলাকাবাসীকে নিয়ে খাল পরিষ্কার করতে; ওয়াসার এমডিকে নিয়ে খাল উদ্ধারের আন্দোলনে যেতে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে যে ৪০ শতাংশ জলজট নিরসনের আশ্বাস তারা দিয়েছেন, সেটা সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আনিসুল হকের জরিপে মশার সমস্যা ছিল ১ নম্বরে। গত এক বছরে মশক নিধনে বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সবুজায়ন মানেই কয়েকটি ফুট ওভারব্রিজে ফুলগাছ লাগানো নয়। ফুটপাতে ডাস্টবিন লাগালেই নগর পরিচ্ছন্ন হয়ে যায় না। গত এক বছরে তারা যা করেছেন, প্রথম ছয় মাসেই করা যেত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাস্তব কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত উদ্যোগের অভাব ছিল। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের দীনতা ছিল স্পষ্ট। জনগণকে সম্পৃক্ত করে গুরুত্ব অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণে আশাভঙ্গের বিষয়ও আছে। তারপরও দু’জনই নগরবাসীর প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাড়াতে পেরেছেন। একেবারে হতাশ করেননি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগ :যানজট নিরসনের জন্য ইতিমধ্যে টঙ্গী থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত ২২টি ইউলুপ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের রাস্তা দখলমুক্ত করে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্যামলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত সড়ককে পার্কিং-ফ্রি ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে সড়কটি আগের চেহারায় ফিরে এসেছে বলে বিস্তর অভিযোগ।
জলজট নিরসনের ক্ষেত্রে ১৩টি খাল ভরাটের চিত্র মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করেছে ডিএনসিসি। উন্মুক্ত ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন কেনা হয়েছে। আশ্বাস দিয়েছেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ৪০ শতাংশ জলাবদ্ধতা কমবে। ফুটপাতকে দখলমুক্ত করার জন্য গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন আনিসুল হক। ওই সময়ের পরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবর্জনা অপসারণে বেশ কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ৭২টি ট্রান্সফার স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নিলেও এ পর্যন্ত ১৪টি তৈরি হয়েছে। গুলশান ২-এ পার্কের জায়গায় এগুলো তৈরি হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে কয়েক হাজার অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ফুটপাতে ডাস্টবিন স্থাপনের কাজ চলছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) দৃশ্যমান কাজের অভাব :ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাঈদ খোকন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন পরিচ্ছন্নতার ওপর। এ জন্য চলতি বছরকে পরিচ্ছন্নতা বর্ষ হিসেবে ঘোষণাও দেন। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে প্রচারও চালান। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ‘লাভ ফর ঢাকা কনসার্ট’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন ভাবনাকে তিনি নগরবাসীর ভেতরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। এ জন্য বিনামূল্যে ৭ লাখ পলিব্যাগও দেন। রাস্তার পাশে স্থাপন করেছেন প্রায় আড়াই হাজার ডাস্টবিন। তবে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা হয়নি গুলিস্তান এলাকার। ওই এলাকার ফুটপাত ও রাস্তাকে হকারদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করার জন্য একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, নিউমার্কেট এলাকাসহ প্রায় সর্বত্রই এ চিত্র ভয়াবহ। অগত্যা গুলিস্তানে এলিভেটেড ওয়াকওয়ে (দোতলা ফুটপাত) নির্মাণের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে ডিএসসিসি। তবে এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এমনকি নগর ভবনের পেছনের সড়কটির অবস্থাও বেহাল। মেয়রের যাতায়াতের কারণে একাংশের চেহারায় পরিবর্তন এলেও অন্য অংশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চারটি এসএটিএস নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে পরিচ্ছন্ন নগরী উপহার দেওয়ার আশ্বাস নগরবাসী আমলে নিতে পারছেন না।
এ ছাড়া পুরান ঢাকার নর্থসাউথ রোড, নবাবপুর রোড, ইংলিশ রোড থেকে বাবুবাজার ব্রিজসহ পুরো এলাকাতেই সড়কের মধ্যে পার্ক করে রাখা হয় ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, পিকআপ প্রভৃতি। ফলে এসব সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচলের উপায় থাকে না। যানজট নিরসনের যে আশ্বাস নির্বাচনের আগে সাঈদ খোকন দিয়েছিলেন, তাও অনেকটা ধোঁয়াশা। অলিগলির সড়কের অবস্থা ছিল এতদিন বেহাল। সম্প্রতি এসব সড়কের উন্নয়নকাজ শুরু হলেও খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বেহাল থাকলেও সেদিকে নজর নেই। মশক নিধন কার্যক্রম চলছে অনেকটা গতানুগতিকভাবে। বিলবোর্ড এখনও অনেক স্থানেই চোখে পড়ে। মেয়র মাঝেমধ্যেই জনতার মুখোমুখি হয়ে এলাকাবাসীর নানা সমস্যার কথা শুনছেন। এতে জলাবদ্ধতা, মাদক, সন্ত্রাস, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থাসহ নানা সমস্যার কথা প্রতিটি অনুষ্ঠানেই উঠে আসছে। রাজপথে স্বচ্ছ আলো দেওয়ার জন্য এলইডি বাতি লাগানোর কাজ শুরু হয়ে এখন তা ধীরগতিতে চলছে। কেবল কারওয়ান বাজার থেকে টিএসসি পর্যন্তই এ বাতি দেখা যাচ্ছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওয়াদা থাকলেও সফল হতে পারেননি মেয়র। এ কাজে ব্যর্থতার কারণে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
এসব প্রসঙ্গে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, এ সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। ছয় মাসের মধ্যে ডিএসসিসির সব এলাকায় এলইডি বাতি বসবে। বুড়িগঙ্গার আধুনিকায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ৩০০ রাস্তার উন্নয়নের কাজ চলছে। পরিচ্ছন্ন কাজে ক্রিকেটার, বিশিষ্ট ব্যক্তি, জনপ্রিয় অভিনেতা-নেত্রীদের এনে প্রচার চালিয়েছেন গুলিস্তান এলাকা হকারমুক্ত করার জন্য। বেশ কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে। সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি পিতা মেয়র হানিফের আদর্শ অনুসরণ করে নগরবাসীর কল্যাণে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন।