ঢাকা , শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভূমিহীনের তালিকায় জমির মালিকেরা, অসহায় চরের বাসিন্ধারা

চারপাশে নদী। নেই কোনো হাটবাজার ও রাস্তাঘাট। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব মৌলিক অধিকারের সুবিধা অনুপস্থিত। এমনই এক জায়গা নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরআতাউর। এখানে সরকারি আশ্রয়ণের ব্যারাক হাউস ও গুচ্ছগ্রামে বাস করছে শতাধিক ভূমিহীন পরিবার। কিন্তু কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। কারণ ঘরের পাশ থেকে শুরু করে চরের সব খাসজমি বন্দোবস্ত নিয়ে গেছেন মূল ভূখণ্ডে বাস করা প্রভাবশালীরা। এসব জমি নিজেদের নামে দেওয়ার দাবি ভূমিহীনদের।

তমরদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম পাশে চরআতাউরের অবস্থান। মূল ভূখণ্ড থেকে নদীপথে ২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এখানে বনশ্রী আশ্রয়ণের আওতায় ৪০টি ভবনের সমন্বয়ে একটি ব্যারাক হাউস রয়েছে, যাতে থাকতে পারে ২০০ পরিবার। এ ছাড়া তরুবীথি ও ছায়াবীথি নামের দুটি গুচ্ছগ্রামে ১০০ পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তিন জায়গা মিলিয়ে রয়েছে শতাধিক পরিবার। তাঁরা নদীভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব। অনেকে কয়েকবার ভাঙনের কবলে পড়েছেন।

চরের বাসিন্দারা জানান, পাকা ও আধা পাকা এসব ঘরে প্রথমে মানুষ বসবাস করতে আসতে চাননি। কারণ এখানে হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল-কিছুই নেই। জীবিকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষজনকে এক ধরনের বেকার জীবনযাপন করতে হয়। ২০১৭ সালের দিকে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানরা জমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন সুবিধার কথা বলে লোকজনকে এ চরে নিয়ে আসেন। কিন্তু ভূমি কার্যালয়কে হাত করে প্রভাবশালীরা একেকজন ৫-৬ একর বা আরও বেশি জমি বন্দোবস্ত নিয়ে গেছেন।

ব্যারাকের বাসিন্দা নাজমা বেগম জানান, তাঁর স্বামী ও এক সন্তান চট্টগ্রামে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি চরে থাকা অন্য সন্তানকে নিয়ে কেওড়া বাগানের কাঠ কুড়ানোর কাজ করেন। অনেক নারী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। তাঁদের পাশের জমিগুলো চাষ করতে পারলে হয়তো পরিবারের বছরের খাবার জোগাড় হতো। কিন্তু এ জমিগুলো চাষ করেন বড়লোকেরা। ধান চাষের মৌসুমে জমিতে পা ফেলা যায় না। চাষিদের পাহারাদার থাকেন। চাষিরা মূল ভূখণ্ড থেকে এসে সময়মতো পাকা ধান কেটে নিয়ে যান।

খোকন নামের একজন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে গৌতম সাহা নামের একজন পল্লিচিকিৎসক এসে চিকিৎসা দিয়ে যান। সপ্তাহে এক দিন এসে নাপিত মানুষের চুল-দাঁড়ি কেটে যান। এটা জেলখানার মতো। এখানে বসবাস করা মানুষজনের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বিধায় তাঁরা এখানে বাস করছেন।’

হাতিয়া উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চরের খাসজমিগুলো ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বড়লোকদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বুড়িরচর ইউপির সাবেক এক মেম্বার ও তমরদ্দি ইউপির সাবেক এক চেয়ারম্যান ২০০ একর করে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেন জানান, তিনি ভূমিহীনদের আগের বন্দোবস্ত বাতিল করার জন্য আবেদন দিতে বলেছেন। আবেদন পেলে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

যোগাযোগ করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইবনে আল জায়েদ হোসেন বলেন, ‘চরে বসবাস করা মানুষজনকে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। ইতিমধ্যে যেসব ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে অনেকের বন্দোবস্ত বাতিল করে হলেও চরে বসবাস করা ভূমিহীনদের জমি দেওয়া হবে। এ ছাড়া এখন থেকে তাঁদের সরকারি সব সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হবে।’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ভূমিহীনের তালিকায় জমির মালিকেরা, অসহায় চরের বাসিন্ধারা

আপডেট টাইম : ৪ ঘন্টা আগে

চারপাশে নদী। নেই কোনো হাটবাজার ও রাস্তাঘাট। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব মৌলিক অধিকারের সুবিধা অনুপস্থিত। এমনই এক জায়গা নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরআতাউর। এখানে সরকারি আশ্রয়ণের ব্যারাক হাউস ও গুচ্ছগ্রামে বাস করছে শতাধিক ভূমিহীন পরিবার। কিন্তু কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। কারণ ঘরের পাশ থেকে শুরু করে চরের সব খাসজমি বন্দোবস্ত নিয়ে গেছেন মূল ভূখণ্ডে বাস করা প্রভাবশালীরা। এসব জমি নিজেদের নামে দেওয়ার দাবি ভূমিহীনদের।

তমরদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম পাশে চরআতাউরের অবস্থান। মূল ভূখণ্ড থেকে নদীপথে ২ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। এখানে বনশ্রী আশ্রয়ণের আওতায় ৪০টি ভবনের সমন্বয়ে একটি ব্যারাক হাউস রয়েছে, যাতে থাকতে পারে ২০০ পরিবার। এ ছাড়া তরুবীথি ও ছায়াবীথি নামের দুটি গুচ্ছগ্রামে ১০০ পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তিন জায়গা মিলিয়ে রয়েছে শতাধিক পরিবার। তাঁরা নদীভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব। অনেকে কয়েকবার ভাঙনের কবলে পড়েছেন।

চরের বাসিন্দারা জানান, পাকা ও আধা পাকা এসব ঘরে প্রথমে মানুষ বসবাস করতে আসতে চাননি। কারণ এখানে হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল-কিছুই নেই। জীবিকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষজনকে এক ধরনের বেকার জীবনযাপন করতে হয়। ২০১৭ সালের দিকে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানরা জমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন সুবিধার কথা বলে লোকজনকে এ চরে নিয়ে আসেন। কিন্তু ভূমি কার্যালয়কে হাত করে প্রভাবশালীরা একেকজন ৫-৬ একর বা আরও বেশি জমি বন্দোবস্ত নিয়ে গেছেন।

ব্যারাকের বাসিন্দা নাজমা বেগম জানান, তাঁর স্বামী ও এক সন্তান চট্টগ্রামে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি চরে থাকা অন্য সন্তানকে নিয়ে কেওড়া বাগানের কাঠ কুড়ানোর কাজ করেন। অনেক নারী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। তাঁদের পাশের জমিগুলো চাষ করতে পারলে হয়তো পরিবারের বছরের খাবার জোগাড় হতো। কিন্তু এ জমিগুলো চাষ করেন বড়লোকেরা। ধান চাষের মৌসুমে জমিতে পা ফেলা যায় না। চাষিদের পাহারাদার থাকেন। চাষিরা মূল ভূখণ্ড থেকে এসে সময়মতো পাকা ধান কেটে নিয়ে যান।

খোকন নামের একজন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে গৌতম সাহা নামের একজন পল্লিচিকিৎসক এসে চিকিৎসা দিয়ে যান। সপ্তাহে এক দিন এসে নাপিত মানুষের চুল-দাঁড়ি কেটে যান। এটা জেলখানার মতো। এখানে বসবাস করা মানুষজনের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বিধায় তাঁরা এখানে বাস করছেন।’

হাতিয়া উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চরের খাসজমিগুলো ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বড়লোকদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বুড়িরচর ইউপির সাবেক এক মেম্বার ও তমরদ্দি ইউপির সাবেক এক চেয়ারম্যান ২০০ একর করে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেন জানান, তিনি ভূমিহীনদের আগের বন্দোবস্ত বাতিল করার জন্য আবেদন দিতে বলেছেন। আবেদন পেলে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

যোগাযোগ করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইবনে আল জায়েদ হোসেন বলেন, ‘চরে বসবাস করা মানুষজনকে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। ইতিমধ্যে যেসব ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রয়োজনে অনেকের বন্দোবস্ত বাতিল করে হলেও চরে বসবাস করা ভূমিহীনদের জমি দেওয়া হবে। এ ছাড়া এখন থেকে তাঁদের সরকারি সব সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হবে।’