অতিবৃষ্টি, অকালবন্যা ও রাসায়নিক দূষণে হাওরাঞ্চলে লাখ লাখ হেক্টর বোরো ধান ও মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শস্যভান্ডার নামে খ্যাত চলনবিল ও আত্রাই উপত্যকায় আকস্মিক অকাল বন্যা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানেও হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধানসহ সব ধরনের ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। আর একসপ্তাহ পরেই যে সব ধান কৃষকের গোলায় উঠত তা’র অনেকটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। কেউ কেউ আধাপাকা ধান কেটে নিয়ে ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করলেও প্রয়োজনীয় কৃষিশ্রমিকের অভাবে তাও সম্ভব হয়নি। এহেন বাস্তবতায় দেশের মানুষ যখন হাওরের মানুষের দুর্ভোগে সহমর্মী হওয়ার পাশাপাশি আগামী মাসগুলোতে দেশে খাদ্য ঘাটতি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে ঠিক তখনি ধানে মহামারি রোগ দেখা দিয়েছে। দেশে উৎপাদিত ধানের সিংহভাগই আসে হাওর এবং উত্তরের জেলাগুলো থেকে। বন্যায় হাওর ও চলনবিলের বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রংপুর, দিনাজপুর কৃষি অঞ্চলের ধানক্ষেতগুলোতে অজ্ঞাত রোগ দেখা দেখায় কৃষকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রোগ দমনে করণীয় সম্পর্কে কোন তথ্য না থাকায় কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক নাশক ও বালাই নাশক কিনে ব্যবহার করেও কোন ফল পাচ্ছে না বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।
আর মাত্র দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই বোরো ধান কাটা শুরু হবে। উত্তরের জনপদে এখন সবুজের সমারোহ। এই ধানের উপর নির্ভর করছে লাখ লাখ কৃষক ও কৃষিজীবীর সাংবাৎসরিক স্বপ্ন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, দিনাজপুর ও আশপাশের জেলাগুলোতে ধানক্ষেতে অজ্ঞাত, অভূতপূর্ব রোগে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সবুজ ধানগাছ লাল হয়ে মরে যাচ্ছে। বাতাসে দোল খেলানো ধানের শীষগুলো শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের জন্য এ এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। কৃষক এবং মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে জেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে। অথচ বিষয়টি অতীব গুরুতর এবং জরুরী। এ ধরনের মহামারি যদি ছড়িয়ে পড়ে তবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশের খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। হাওরে ও চলনবিলের অকালবন্যায় ফসলহানির প্রভাব ইতিমধ্যেই দেশের চালের বাজারে পড়েছে। গত দু’সপ্তাহে খুচরা বাজারে চালের মূল্য প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে প্রতীয়মান হয়, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধানক্ষেতে ব্লাস্টরোগের আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সে সব খবরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কি ধরনের প্রতিকারমূলক উদ্যোগ নিয়েছিলেন বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা’ আমাদের জানা নেই। গত মাসের শেষদিকেই ডুমুরিয়া, কেশবপুরে ব্লাস্টরোগে ধানক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। অত:পর কুড়িগ্রামে ব্লাস্টরোগের প্রকোপের সংবাদও ছাপা হয় আরো দু’সপ্তাহ আগে। এখন আরো বিভিন্ন এলাকায় ধানের মহামারি রোগ ছড়িয়ে পড়ায় দেশব্যাপী আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে শুরু করে প্রতিটি নদী অববাহিকা এলাকায় একের পর এক বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। দেশের এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে হাওর সম্পর্কিত উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা একযোগে বিদেশ সফরে রয়েছেন বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে করণীয় নির্ধারনে সংশ্লিষ্ট দফতর কিছুই করতে পারেনি। তবে ব্লাস্টরোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রংপুর দিনাজপুর কৃষি অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তাদের সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু ছুটি বাতিল করলেই হবে না, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশি-বিদেশি কৃষি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টীম গঠন করে কৃষকদেরকে জরুরী নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।