বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আর্থিক খাতের ওপর বিশ্বব্যাংকের তৈরি ‘ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (এফএসএপি) খসড়া প্রতিবেদনে সুশাসনের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এফএসএপির খসড়া প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি।
উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- দক্ষিণ এশিয়ায় ১১ দশমিক ৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ভুটান ও আফগানিস্তান, যাদের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯ এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত দশ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে চার গুণ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা; ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
সরকার অবশ্য মুজিববর্ষ সামনে রেখে খেলাপি ঋণমুক্ত দেশে গড়ার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন আইন-২০২০’-এর খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে, যেখানে বলা হয়েছে- খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে অন্য কারও কাছে লিজ দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হলে ঋণখেলাপির পুরো সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা পাবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন।
তবে প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, খেলাপি ঋণের অধিকাংশই সরকারি ব্যাংকে।
এ অবস্থায় আরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব কতটা যুক্তিযুক্ত, ভেবে দেখতে হবে।
উদ্বেগের বিষয় হল, খেলাপি ঋণের বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না দেশের ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব, সুশাসনের অভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল হওয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করার কারণে সেখানেও খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কথা সর্বজনবিদিত, অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের মালিক ও পরিচালক রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন।
পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরাও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান। এর ফলে তাদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব অনেকটাই শিথিল। এ সুযোগে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তারা নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছেন।
ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে গ্রাস করে ফেলছে এবং এর ফলে খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে, যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে। ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর সতর্ক থাকা জরুরি।
মিথ্যা তথ্য ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পর তা খেলাপিতে পরিণত করার প্রবণতা শুরুতেই রোধ করা গেলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঝুঁকি এড়ানো সহজ হবে। দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতার পরিবেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেবে- এটাই প্রত্যাশা।