ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নদী বন্যাব্যবস্থাপনায় চীনের আর্থিক কারিগরি সহায়তা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাংলাদেশ চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার খবর বেরিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তিস্তা প্রকল্পের জন্য ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য চেয়েছিলেন চীনের কাছে। চীন অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। এর ফলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তা অববাহিকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহতের, বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন, বন্যার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে- এতে অত্র অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ছোট-বড় অসংখ্য নদী বাংলাদেশে বহমান সুপ্রাচীনকাল থেকে। বাংলাদেশের মতো নদীবহুল দেশে নদী রক্ষা ও নদীর পানি ব্যবহারের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার আবশ্যকীয়তা বলা প্রয়োজন পড়ে না। শুধু তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেই নয়- বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলোর ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রকল্প গ্রহণ করে দ্রম্নত বাস্তবায়ন করা দরকার। দেশে বহমান নদ-নদীগুলো রক্ষা, নদ-নদীগুলোর পানি সারা বছর চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারের জন্য সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার আবশ্যকীয়তা বাংলাদেশ বহুদিন ধরে উপলব্ধি করলেও কারিগরি জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষম হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত, বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদীভাঙন থেকে পদ্মাপারের জনপদ রক্ষার লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলে গ্রহণ করা ‘গঙ্গা ব্যারেজ’ প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি কারিগরি সক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের অভাবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পরিকল্পিত নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ায় বন্যা, নদীভাঙনের ক্ষতি থেকেই রক্ষা শুধু পাচ্ছে না, দেশজুড়ে সাশ্রয়ী যোগাযোগের নৌপথ চালু, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি চাহিদামতো ব্যবহার করে অধিক শস্য উৎপাদন করতেও সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ নদীবহুল দেশ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নদীনির্ভর। নদীনির্ভর দেশ হয়েও বাংলাদেশ পরিকল্পিত নদীব্যবস্থাপনা এত দিনেও গড়ে তুলতে না পারা দুর্ভাগ্যই। বাংলাদেশে প্রতি বছরই ছোট-বড় বন্যা হয়। এ সব বন্যায় ফসলহানিসহ সহায়-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। নদীভাঙনে প্রতি বছর শ শ হেক্টর ভূমি নদীতে বিলীন হয়; এতে প্রতি বছর বিপুল মানুষ ভূমিহীনের তালিকায় যুক্ত হয়। উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশ অভিমুখী নদ-নদীগুলোর পানি আটকিয়ে রাখার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের চাষাবাস, জীববৈচিত্র্য-মৎস্য সম্পদের ক্ষতিসহ নদীর নাব্য হ্রাস, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদীপথ বিলীনজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে। বাংলাদেশে বহমান নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখা এবং নদীর পানি সারা বছর প্রয়োজনমতো ব্যবহার নিশ্চিত করে- এমন পরিকল্পনা দ্রম্নত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য জরুরি তা বলা নিষ্প্রয়োজন। দেশে বহমান নদ-নদীগুলোকে রক্ষা, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য কেন্দ্রীয় নদীব্যবস্থাপনা ‘আন্তঃনদীব্যবস্থাপনা’ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে বাংলাদেশকে। ‘আন্তঃনদীব্যবস্থাপনা’ হলে নদ-নদীর অবদানে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মনির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা, নদীভাঙন, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শস্য উৎপাদন ব্যাহতের, নৌপথ সংকুচিতের ক্ষতিসহ উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে জলবায়ু, পরিবেশ-প্রতিবেশের যে ক্ষতি হয় তা না হলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর একটি হতো বহু আগেই। যেহেতু বাংলাদেশের আধুনিক নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই সে কারণে বন্ধু দেশ বা দেশগুলোর সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

তিস্তা নদী রক্ষা, তিস্তা নদীর ভাঙন রোধ, তিস্তা অববাহিকায় বর্ষা মৌসুমে ভারত গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে তিস্তায় দেখা দেয় বন্যা; শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের গেট আটকিয়ে পানি ধরে রাখার কারণে দেখা দেওয়া পানিসংকট থেকে পরিত্রাণের চিন্তাই সরকার তিস্তা নদী কেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত যথাযথ। নদীব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার সক্ষমতা চীনের রয়েছে। নদীব্যবস্থাপনায় চীনের সাফল্য বিশ্বে উদাহরণ। হোয়াংহো নদীকে এক সময় বলা হতো চীনের দুঃখ। চীনের দুঃখখ্যাত হোয়াংহো নদীকে আশীর্বাদে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে চীন পরিকল্পনা মাফিক ব্যবহার করার মাধ্যমে। চীনের ওপর দিয়ে বইছে বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াংজি। চীনের পাঁচটি প্রদেশ ইয়াংজি নদীর পানিতে পস্নাবিত হয়। পরিকল্পনার মাধ্যমে পস্নাবিত এলাকাগুলোর বন্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে চীন। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র। এ নদ চীনে ‘ইয়ারলুং সাংপো নামে পরিচিত। পর্বতাঞ্চলে অবস্থিত ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নদের উপর বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। নদীব্যবস্থাপনায় চীনের অভিজ্ঞতা ও সাফল্য তাক লাগানো। চীন বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সাহায্য-সহযোগিতা দিলে বাংলাদেশের বহুদিনের আশা পূরণ হবে। চীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে সাহায্য-সহায়তা করছে দীর্ঘদিন ধরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা খাতে চীনের সাহায্য-সহযোগিতার সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে। সম্প্রতি চীন বাংলাদেশকে শূন্য শুল্কে ৯৭ শতাংশ পণ্য রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ সুযোগ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে সক্ষম হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকগুণ বাড়বে। বাংলাদেশের বলা যায় সব মেগাপ্রকল্পই বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায়। করোনা সংকটেও বাংলাদেশকে চীন সহায়তা দিয়েছে। নদী রক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীর পানি সারা বছর চাহিদামতো ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ চীনের সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশ যদি পায় তাহলে তা হবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য গ্রেট অপরচুনিটি। চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা দিতে আন্তরিকভাবে আগ্রহীও। গতবছর অনুষ্ঠিত ‘ হ্যান্ডওভার সেরিমনি অব দ্য পস্ন্যানিং ফর ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে চীনা অনুদানে সম্পাদিত সমীক্ষাভিত্তিক বাংলাদেশের বন্যাব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর গতি-প্রকৃতি, অবস্থা, বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে চীনের স্ট্যাডি রয়েছে তা প্রমাণ করে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কলা-কৌশল বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের ঘটনায়। নদীব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় আর্থিক-কারিগরি সাহায্য-সহায়তা দিতে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য দরজায় কড়া নাড়ার মতো। নদ-নদী বাংলাদেশের প্রাণ। নদ-নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো একে একে মরে যাচ্ছে, বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রাখার কারণে; আবার বর্ষাকালে বাংলাদেশ পানিতে ভাসছে উজানে নির্মিত বাঁধের ফটকগুলো খুলে দেওয়ার কারণে। এর থেকে রক্ষার উপায় বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। বাংলাদেশের নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা পেলে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া- হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া নদ-নদীগুলো আবারও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে; সেই সঙ্গে নদীভাঙনসহ বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে আসা পানির কারণে দেখা দেওয়া বন্যার ক্ষতি থেকেও বাংলাদেশ রক্ষা পাবে। মানবদেহে শিরা-উপশিরা যেভাবে ছড়িয়ে আছে অনেকটা তেমনিভাবে নদ-নদীগুলো বাংলাদেশের ভূমির ওপর ছড়িয়ে আছে। মানব-দেহের শিরা-উপশিরা শুকিয়ে গেলে মানবের মৃতু্য যেমন অবধারিত হয়ে যায়, তেমনি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে গেলে বাংলাদেশ নামের দেশটির মৃতু্যও অবধারিত হবে। সুপ্রচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, জীবনাচার, আবহাওয়া-জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, কৃষ্টির সঙ্গে নদ-নদীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।

নদনদীশূন্য বা পানিশূন্য নদনদীর বাংলাদেশ, চিন্তাই করা যায় না। নদীর দেশ বাংলাদেশ বাঁচাতে হলে আগে নদী বাঁচাতে হবে; বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীভিত্তিক অর্থনীতিতে জোর দিতে হবে। এর জন্যই নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন। বন্যা ও নদীব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে এটা সুখবর।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

নদী বন্যাব্যবস্থাপনায় চীনের আর্থিক কারিগরি সহায়তা

আপডেট টাইম : ০১:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাংলাদেশ চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার খবর বেরিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তিস্তা প্রকল্পের জন্য ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য চেয়েছিলেন চীনের কাছে। চীন অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। এর ফলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তা অববাহিকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহতের, বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন, বন্যার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলে পর্যটন কেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে- এতে অত্র অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ছোট-বড় অসংখ্য নদী বাংলাদেশে বহমান সুপ্রাচীনকাল থেকে। বাংলাদেশের মতো নদীবহুল দেশে নদী রক্ষা ও নদীর পানি ব্যবহারের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার আবশ্যকীয়তা বলা প্রয়োজন পড়ে না। শুধু তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেই নয়- বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলোর ক্ষেত্রেও অনুরূপ প্রকল্প গ্রহণ করে দ্রম্নত বাস্তবায়ন করা দরকার। দেশে বহমান নদ-নদীগুলো রক্ষা, নদ-নদীগুলোর পানি সারা বছর চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারের জন্য সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার আবশ্যকীয়তা বাংলাদেশ বহুদিন ধরে উপলব্ধি করলেও কারিগরি জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্ষম হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত, বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদীভাঙন থেকে পদ্মাপারের জনপদ রক্ষার লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলে গ্রহণ করা ‘গঙ্গা ব্যারেজ’ প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি কারিগরি সক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের অভাবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পরিকল্পিত নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ায় বন্যা, নদীভাঙনের ক্ষতি থেকেই রক্ষা শুধু পাচ্ছে না, দেশজুড়ে সাশ্রয়ী যোগাযোগের নৌপথ চালু, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি চাহিদামতো ব্যবহার করে অধিক শস্য উৎপাদন করতেও সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ নদীবহুল দেশ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নদীনির্ভর। নদীনির্ভর দেশ হয়েও বাংলাদেশ পরিকল্পিত নদীব্যবস্থাপনা এত দিনেও গড়ে তুলতে না পারা দুর্ভাগ্যই। বাংলাদেশে প্রতি বছরই ছোট-বড় বন্যা হয়। এ সব বন্যায় ফসলহানিসহ সহায়-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। নদীভাঙনে প্রতি বছর শ শ হেক্টর ভূমি নদীতে বিলীন হয়; এতে প্রতি বছর বিপুল মানুষ ভূমিহীনের তালিকায় যুক্ত হয়। উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশ অভিমুখী নদ-নদীগুলোর পানি আটকিয়ে রাখার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের চাষাবাস, জীববৈচিত্র্য-মৎস্য সম্পদের ক্ষতিসহ নদীর নাব্য হ্রাস, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদীপথ বিলীনজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে। বাংলাদেশে বহমান নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখা এবং নদীর পানি সারা বছর প্রয়োজনমতো ব্যবহার নিশ্চিত করে- এমন পরিকল্পনা দ্রম্নত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য জরুরি তা বলা নিষ্প্রয়োজন। দেশে বহমান নদ-নদীগুলোকে রক্ষা, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য কেন্দ্রীয় নদীব্যবস্থাপনা ‘আন্তঃনদীব্যবস্থাপনা’ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে বাংলাদেশকে। ‘আন্তঃনদীব্যবস্থাপনা’ হলে নদ-নদীর অবদানে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মনির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে বন্যা, নদীভাঙন, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শস্য উৎপাদন ব্যাহতের, নৌপথ সংকুচিতের ক্ষতিসহ উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে জলবায়ু, পরিবেশ-প্রতিবেশের যে ক্ষতি হয় তা না হলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর একটি হতো বহু আগেই। যেহেতু বাংলাদেশের আধুনিক নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই সে কারণে বন্ধু দেশ বা দেশগুলোর সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

তিস্তা নদী রক্ষা, তিস্তা নদীর ভাঙন রোধ, তিস্তা অববাহিকায় বর্ষা মৌসুমে ভারত গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে তিস্তায় দেখা দেয় বন্যা; শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা বাঁধের গেট আটকিয়ে পানি ধরে রাখার কারণে দেখা দেওয়া পানিসংকট থেকে পরিত্রাণের চিন্তাই সরকার তিস্তা নদী কেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত যথাযথ। নদীব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার সক্ষমতা চীনের রয়েছে। নদীব্যবস্থাপনায় চীনের সাফল্য বিশ্বে উদাহরণ। হোয়াংহো নদীকে এক সময় বলা হতো চীনের দুঃখ। চীনের দুঃখখ্যাত হোয়াংহো নদীকে আশীর্বাদে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে চীন পরিকল্পনা মাফিক ব্যবহার করার মাধ্যমে। চীনের ওপর দিয়ে বইছে বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াংজি। চীনের পাঁচটি প্রদেশ ইয়াংজি নদীর পানিতে পস্নাবিত হয়। পরিকল্পনার মাধ্যমে পস্নাবিত এলাকাগুলোর বন্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে চীন। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র। এ নদ চীনে ‘ইয়ারলুং সাংপো নামে পরিচিত। পর্বতাঞ্চলে অবস্থিত ‘ইয়ারলুং সাংপো’ নদের উপর বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। নদীব্যবস্থাপনায় চীনের অভিজ্ঞতা ও সাফল্য তাক লাগানো। চীন বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সাহায্য-সহযোগিতা দিলে বাংলাদেশের বহুদিনের আশা পূরণ হবে। চীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে সাহায্য-সহায়তা করছে দীর্ঘদিন ধরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা খাতে চীনের সাহায্য-সহযোগিতার সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে। সম্প্রতি চীন বাংলাদেশকে শূন্য শুল্কে ৯৭ শতাংশ পণ্য রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ সুযোগ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে সক্ষম হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকগুণ বাড়বে। বাংলাদেশের বলা যায় সব মেগাপ্রকল্পই বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায়। করোনা সংকটেও বাংলাদেশকে চীন সহায়তা দিয়েছে। নদী রক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীর পানি সারা বছর চাহিদামতো ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ চীনের সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশ যদি পায় তাহলে তা হবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য গ্রেট অপরচুনিটি। চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা দিতে আন্তরিকভাবে আগ্রহীও। গতবছর অনুষ্ঠিত ‘ হ্যান্ডওভার সেরিমনি অব দ্য পস্ন্যানিং ফর ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে চীনা অনুদানে সম্পাদিত সমীক্ষাভিত্তিক বাংলাদেশের বন্যাব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর গতি-প্রকৃতি, অবস্থা, বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে চীনের স্ট্যাডি রয়েছে তা প্রমাণ করে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কলা-কৌশল বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের ঘটনায়। নদীব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় আর্থিক-কারিগরি সাহায্য-সহায়তা দিতে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের জন্য দরজায় কড়া নাড়ার মতো। নদ-নদী বাংলাদেশের প্রাণ। নদ-নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো একে একে মরে যাচ্ছে, বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রাখার কারণে; আবার বর্ষাকালে বাংলাদেশ পানিতে ভাসছে উজানে নির্মিত বাঁধের ফটকগুলো খুলে দেওয়ার কারণে। এর থেকে রক্ষার উপায় বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। বাংলাদেশের নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা পেলে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া- হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া নদ-নদীগুলো আবারও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে; সেই সঙ্গে নদীভাঙনসহ বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে আসা পানির কারণে দেখা দেওয়া বন্যার ক্ষতি থেকেও বাংলাদেশ রক্ষা পাবে। মানবদেহে শিরা-উপশিরা যেভাবে ছড়িয়ে আছে অনেকটা তেমনিভাবে নদ-নদীগুলো বাংলাদেশের ভূমির ওপর ছড়িয়ে আছে। মানব-দেহের শিরা-উপশিরা শুকিয়ে গেলে মানবের মৃতু্য যেমন অবধারিত হয়ে যায়, তেমনি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে গেলে বাংলাদেশ নামের দেশটির মৃতু্যও অবধারিত হবে। সুপ্রচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, জীবনাচার, আবহাওয়া-জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, কৃষ্টির সঙ্গে নদ-নদীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।

নদনদীশূন্য বা পানিশূন্য নদনদীর বাংলাদেশ, চিন্তাই করা যায় না। নদীর দেশ বাংলাদেশ বাঁচাতে হলে আগে নদী বাঁচাতে হবে; বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীভিত্তিক অর্থনীতিতে জোর দিতে হবে। এর জন্যই নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন। বন্যা ও নদীব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ চীন বাংলাদেশকে নদী ও বন্যাব্যবস্থাপনায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে এটা সুখবর।