ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মরণ এক মৃত্যুহীন প্রাণ

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ২০১২ সালের শেষের দিক। আমি তখন গাজীপুরে ভিয়েলাটেক্স গ্রুপে চাকরি করতাম। ঘটনাক্রমে আমার বসার জায়গাটি ছিল চেয়ারম্যানের  চেম্বারের ঠিক পেছনের দিকের একটি কক্ষে। আমরা প্রায় চার-পাঁচজন সহকর্মী পাশাপাশি বসতাম সেখানে। একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ আমার আশপাশের সহকর্মীরা বলাবলি করতে লাগলেন, ইয়ুথ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আলম আসছেন। তাকে একনজর দেখার খুব কৌতূহল লক্ষ করলাম সবার মধ্যে। বিষয়টি আমার মধ্যেও একটি আগ্রহের জন্ম দেয়। কে এই ব্যক্তি? কেনইবা সবাই তাকে একনজর দেখতে চায়। অফিস শেষে বের হওয়ার সময় কাকতালীয়ভাবে ভিয়েলাটেক্সের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফিরোজ আলমও বের হলেন। আমরা বেশ পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখেছিলাম। সাদা রঙের হালকা সিল্ক অথবা সুতি কাপড়ে বানানো পায়জামা আর পাঞ্জাবিতে খুব ধীরগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বকীয় পোশাক আর হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যে কাউকে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে বাধ্য। বলতে গেলে এটিই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। জানতে পারলাম, ভিয়েলাটেক্স গ্রুপ ও ইয়ুথ গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি এসেছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালন ক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশের একজন অন্যতম অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

দৈবক্রমের ঠিক ছয় মাসের মাথায় আমার রিজিকের ফয়সালা হয়ে যায় ইয়ুথ গ্রুপে। প্রায় ছয় বছর টানা কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার তার সঙ্গে। চার দশকের কর্মজীবনে ফিরোজ আলম ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন ব্যক্তিত্ব। ছিলেন একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা। তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, উন্নত শিক্ষা ও আর্থিক খাতে সমান পদচারণা ছিল তার। ট্রেডিং ব্যবসা থেকে সব সময় দূরে থাকতে দেখেছি তাকে। ট্রেডিং করে অনেক অর্থ উপার্জন করার সুযোগ থাকলেও কখনও তিনি তা করেননি। শিল্পের মাধ্যমে দেশীয় সম্পদের উন্নত ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের এক অসাধারণ সাম্য রক্ষা করতে দেখেছি তাকে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ।

শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। জ্ঞান আহরণের প্রচণ্ড রকমের ইচ্ছা সব সময় তাকে তাড়া করে বেড়াত। দুঃসাহসিক ঝুঁকি গ্রহণ করা ছিল তার চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন উদ্যোক্তার প্রধান কাজ হচ্ছে ঝুঁকি পরিমাপ ও গ্রহণ করা আর ব্যবসা পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে পেশাদার ও অভিজ্ঞ কর্মীদের কাজ। ব্যবসায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যেসব ব্যবসায়িক ধারণা গতানুগতিক উদ্যোগ তারা উপেক্ষা করতেন, তিনি সে ধারণাগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিনিয়োগ করেছেন। শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে চূড়ান্ত সফলতা বের করে আনার অহরহ নজির রয়েছে তার ব্যবসায়িক কর্মজীবনে। ফিরোজ আলম অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাস করতেন। প্রিয় মাতৃভূমি সন্দ্বীপের প্রত্যেক মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা তিনি শৈশবকাল থেকেই অনুধাবন করতেন। নিজের এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করার চেষ্টা থেকে প্রিয় বন্ধু রেজাকুল হায়দারকে ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের অধীনে ইতোমধ্যে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে প্রিয় বন্ধু রেজাকুল হায়দারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের শুভ উদ্বোধন সম্পন্ন হচ্ছে।

ইয়াছিন আহমেদ : প্রাবন্ধিক

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মরণ এক মৃত্যুহীন প্রাণ

আপডেট টাইম : ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ অক্টোবর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ২০১২ সালের শেষের দিক। আমি তখন গাজীপুরে ভিয়েলাটেক্স গ্রুপে চাকরি করতাম। ঘটনাক্রমে আমার বসার জায়গাটি ছিল চেয়ারম্যানের  চেম্বারের ঠিক পেছনের দিকের একটি কক্ষে। আমরা প্রায় চার-পাঁচজন সহকর্মী পাশাপাশি বসতাম সেখানে। একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ আমার আশপাশের সহকর্মীরা বলাবলি করতে লাগলেন, ইয়ুথ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আলম আসছেন। তাকে একনজর দেখার খুব কৌতূহল লক্ষ করলাম সবার মধ্যে। বিষয়টি আমার মধ্যেও একটি আগ্রহের জন্ম দেয়। কে এই ব্যক্তি? কেনইবা সবাই তাকে একনজর দেখতে চায়। অফিস শেষে বের হওয়ার সময় কাকতালীয়ভাবে ভিয়েলাটেক্সের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফিরোজ আলমও বের হলেন। আমরা বেশ পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখেছিলাম। সাদা রঙের হালকা সিল্ক অথবা সুতি কাপড়ে বানানো পায়জামা আর পাঞ্জাবিতে খুব ধীরগতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বকীয় পোশাক আর হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যে কাউকে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে বাধ্য। বলতে গেলে এটিই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। জানতে পারলাম, ভিয়েলাটেক্স গ্রুপ ও ইয়ুথ গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি এসেছিলেন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালন ক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশের একজন অন্যতম অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

দৈবক্রমের ঠিক ছয় মাসের মাথায় আমার রিজিকের ফয়সালা হয়ে যায় ইয়ুথ গ্রুপে। প্রায় ছয় বছর টানা কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার তার সঙ্গে। চার দশকের কর্মজীবনে ফিরোজ আলম ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন ব্যক্তিত্ব। ছিলেন একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা। তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, উন্নত শিক্ষা ও আর্থিক খাতে সমান পদচারণা ছিল তার। ট্রেডিং ব্যবসা থেকে সব সময় দূরে থাকতে দেখেছি তাকে। ট্রেডিং করে অনেক অর্থ উপার্জন করার সুযোগ থাকলেও কখনও তিনি তা করেননি। শিল্পের মাধ্যমে দেশীয় সম্পদের উন্নত ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের এক অসাধারণ সাম্য রক্ষা করতে দেখেছি তাকে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ।

শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। জ্ঞান আহরণের প্রচণ্ড রকমের ইচ্ছা সব সময় তাকে তাড়া করে বেড়াত। দুঃসাহসিক ঝুঁকি গ্রহণ করা ছিল তার চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন উদ্যোক্তার প্রধান কাজ হচ্ছে ঝুঁকি পরিমাপ ও গ্রহণ করা আর ব্যবসা পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে পেশাদার ও অভিজ্ঞ কর্মীদের কাজ। ব্যবসায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যেসব ব্যবসায়িক ধারণা গতানুগতিক উদ্যোগ তারা উপেক্ষা করতেন, তিনি সে ধারণাগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিনিয়োগ করেছেন। শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে চূড়ান্ত সফলতা বের করে আনার অহরহ নজির রয়েছে তার ব্যবসায়িক কর্মজীবনে। ফিরোজ আলম অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাস করতেন। প্রিয় মাতৃভূমি সন্দ্বীপের প্রত্যেক মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা তিনি শৈশবকাল থেকেই অনুধাবন করতেন। নিজের এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করার চেষ্টা থেকে প্রিয় বন্ধু রেজাকুল হায়দারকে ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের অধীনে ইতোমধ্যে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে প্রিয় বন্ধু রেজাকুল হায়দারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের শুভ উদ্বোধন সম্পন্ন হচ্ছে।

ইয়াছিন আহমেদ : প্রাবন্ধিক