বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (১৯৭২-৭৪) রিপোর্টে প্রকাশিত মূলনীতি অনুসারে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয় (১৯৭৬-৭৮)। পরে দেশের পূর্ণ শিক্ষাক্রম আরও দু’বার (১৯৯১-৯৫ এবং ২০১১-১২) পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন (প্রথমবার) ও পরিমার্জনে (পরের পূর্ণ দু’বার) সম্পৃক্ত থেকে নেতৃত্ব দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জব্বার এ দেশের শিক্ষাক্রমের গুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রায় ৮৫ বছর বয়সে অধ্যাপক জব্বার পরলোকগমন করেন। জব্বার স্যারের একজন গুণমুগ্ধ ‘ভাব-শিষ্য’ হিসেবে তার মৃত্যুর পর প্রতি বছরই শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখি। ভাবছি এবার কী দিয়ে শুরু করা যায়! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘কনিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কর্তব্যগ্রহণ’ চতুর্দশষ্পদী দিয়ে শুরু করা যাক : ‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি- / শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। / মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী, / আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’
অধ্যাপক এমএ জব্বারের শিক্ষাক্রম মিশন দেশের ভেতরে-বাইরে (তিনি ইউনেস্কো ও বিশ্বব্যাংকের শিক্ষা-পরামশর্কের দায়িত্ব পালন করেন। ইউনেস্কোর ফেলো হিসেবে থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় কিছু সময়ের জন্য শিক্ষাক্রমের কাজ করেন) কার্যকর ছিল। তবে অবশ্যই দেশের ভেতরে ছিল বেশি কার্যকর। ১৯৭৬ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির পরিচালক ও সদস্য-সচিব হিসেবে তিনি সাত খণ্ডে প্রকাশিত দেশের প্রথম শিক্ষাক্রম দলিল প্রস্তুতির মূল দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলিলগুলো শুধু তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি; ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত National Curriculum Development Centre (NCDC)-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে এসব কাছে রেখেছেন এবং ১৯৮৩ সালে NCDC-র অফিস এলিফ্যান্ট রোডের ভাড়া বাড়ি থেকে মতিঝিলে অবস্থিত টেক্সটবুক বোর্ড ভবনে স্থানান্তরের সময় প্রায় দেড় হাজার কপি সঙ্গে এনেছিলেন (যেমনটা তিনি আমাকে ২০০৬ সালে জানিয়েছিলেন)। শুধু তাই নয়, বেশকিছু কপি তিনি নায়েম ও বেনবেইজ গ্রন্থাগারেও রেখেছিলেন। বোঝা যায়, বিজ্ঞানী নিউটন যে কথা তিনশ’ বছর আগে বলে গেছেন- If I have seen (something) further than others, it is by standing upon the shoulders of giants- তা তিনি ভালোই মনে রেখেছিলেন।
নিউটনের সেই ‘বিখ্যাত ব্যক্তিদের ঘাড়ের উপর দাঁড়ানো’ কথার অর্থ কী? গবেষণা করা ও পথচলায় সেই ‘বিখ্যাত ব্যক্তি’ বা মনীষীদের অর্জিত ও সৃষ্ট জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করা হচ্ছে এ কথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। সেসব সৃষ্ট জ্ঞান লিপিবদ্ধ থাকে প্রধানত প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে। তাই গ্রন্থ সংরক্ষণও যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝেই অধ্যাপক জব্বার নিজ হাতে প্রস্তুত প্রথম শিক্ষাক্রমের প্রায় ১৫০০ কপি নিয়ে এসেছিলেন এবং বিভিন্ন গ্রন্থাগারে কপি রেখেছিলেন এই মনে করে যে, সব জায়গা থেকে তো তা আর হারিয়ে যাবে না! যা হোক, ১৯৮৪ সালে এনসিডিসি বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (জাশিপাবো) গঠিত হলে অধ্যাপক জব্বার এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম সদস্যের (শিক্ষাক্রম) দায়িত্ব পালন করে (১৯৮৪-৮৭) ১৯৮৮ সালে নায়েমের একজন পরিচালক হিসেবে সরকারি ‘চাকরি’ শেষ করেন।
অধ্যাপক জব্বার পরিণত বয়সের কর্মজীবন কাটিয়েছেন জাশিপাবো ও নায়েমে। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের প্রয়াত এ গুরুকে সম্মান জানিয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাশিপাবো কর্তৃপক্ষ এর গ্রন্থাগারসংলগ্ন অংশকে একটি মিলনায়তনে রূপদান করে তার নাম রেখেছে ‘মুহাম্মদ আবদুল জব্বার মিলনায়তন’। এভাবে জাশিপাবো দেশের শিক্ষাক্রমের পথিকৃৎকে নামকরণের মাধ্যমে সম্মান জানালো বটে; কিন্তু তার তৈরি দলিল সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠানটি এখনও উদাসীন রয়ে গেছে। শিক্ষাক্রমের এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি দলিলের শুধু দ্বিতীয় (নিম্নমাধ্যমিক) ও তৃতীয় খণ্ডের (মাধ্যমিক) মোট চার-পাঁচটি কপি আছে।
আমি ২০০২ সালের মে মাসে প্রথমবার জাশিপাবোতে আসি সেসিপের (SESIP=Secondary Education Sector Improvement Project) আওতায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে। অল্পদিনের মধ্যেই জানতে পারি উপর্যুক্ত শিক্ষাক্রম দলিল হারানোর কথা। এর কারণও স্পষ্ট হয়ে ওঠে : এ বোর্ডের সদস্যের (শিক্ষাক্রম) দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথমজন (গুরু এমএ জব্বার, ১৯৮৪-৮৭) এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী (১৯৯৫-৯৯) ছাড়া প্রায় সবাই ছিলেন যে কোনো বিষয়ের অধ্যাপক, শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ।
তাই মনস্থ করলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বের গবেষণা বাদ দিয়ে বিদেশ থেকে শিক্ষায় ডক্টরেট করে এসে নিজ দেশের শিক্ষার এ এপেক্স বডিতে সদস্য (শিক্ষাক্রম) হয়ে শিক্ষাক্রমের কাজ যথাযথভাবে করব। চার মাসের প্রশিক্ষণে মালয়েশিয়া গিয়ে প্রথম চেষ্টা করলাম। ভর্তির অফার পেলেও বৃত্তি মিলল না; তাই সেসিপের কাজে ভাটা পড়লে ২০০৬ সালে প্রয়োজনীয় Language Course করে বৃত্তি নিয়ে সিঙ্গাপুর NIE-তে ভর্তি হলাম। পিএইচডি থিসিস জমা দিয়ে দেশে এসে আট মাস ঝুলে থেকে সোয়া তিন বছর জাশিপাবোতে ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিক্ষাক্রম ও সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির কাজ করলাম এবং করালাম। কিন্তু সরকারি কলেজের বিভিন্ন বিষয়ের প্যাটার্ন অনুসারে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি না হওয়ায় আমার অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আগেই মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি- এসব বিষয়ের জুনিয়ররা অধ্যাপক হয়ে যান। অধ্যাপক হওয়ার পরও সরকার আমাকে জাশিপাবোতেই নিম্নপদে, জুনিয়রদের অধীনে পদায়ন করে।
এ অবস্থায়ও লেখালেখির মাধ্যমে হারানো দলিল জোগাড় করা ও সংরক্ষণের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু কোনো কাজে এল না। শেষ পর্যন্ত মনে হলো শিক্ষাক্রমের গুরু জব্বার স্যার আমাকে কবিগুরুর ভাষায় স্বর্গ থেকে ডেকে বলছেন : ‘কে লইবে মোর কার্য’, জাশিপাবোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা (বিশেষত দুই সদস্য- শিক্ষাক্রম) তো ডাক শুনেনই না, ‘নিরুত্তর ছবি’ হয়ে থাকা তো তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক! তাই শেষ পর্যন্ত ‘মাটির প্রদীপের’ মতো ‘আমার যেটুকু সাধ্য’ তা করতে শুরু করলাম ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
প্রথমে সহযোগিতার হাত বাড়ালেন ঢাবি আইইআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান (এমএড কোর্সে আমার শিক্ষাক্রমের শিক্ষক)। তার কাছ থেকে স্বাধীন দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম দলিলের পঞ্চম খণ্ডসহ (বৃত্তিমূলক শিক্ষা) মোট আটটি দলিল ধার পেলাম। তারপর নায়েম গ্রন্থাগার থেকে পেলাম প্রথম খণ্ড (প্রাথমিক স্তর), শিক্ষা পরামর্শক ড. এমএ ওহাব মিয়ার কাছে পেলাম চতুর্থ (উচ্চমাধ্যমিক স্তর) ও ষষ্ঠ খণ্ড (শিক্ষক প্রশিক্ষণ); বেনবেইজ গ্রন্থাগারে পাওয়া গেল সপ্তম খণ্ড (পরীক্ষা ও মূল্যায়ন)। পরে সাবেক সদস্য (শিক্ষাক্রম) মোহাম্মদ আলী স্যারের কাছে পেলাম ১৯৯১ সালের (২য় আবর্তনের) প্রাথমিক শিক্ষাক্রম (যার নাম ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’) এবং ছিদ্দিকুর রহমান স্যারের কাছে পেলাম ২০০২ সালের (৩য় আবর্তন) প্রাথমিক শিক্ষাক্রম। ছিদ্দিকুর রহমান স্যারের কাছে পাকিস্তান আমলের শরীফ খান কমিশন (১৯৫৯) রিপোর্টসহ বেশকিছু দুষ্প্র্রাপ্য দলিল পাওয়া গেল; এগুলো পাকিস্তান আমলের সব কমিশন রিপোর্ট খুঁজতে উৎসাহ জোগাল। নায়েম গ্রন্থাগারে পাওয়া গেল মাওলানা আকরম খাঁ কমিশন রিপোর্ট (১৯৫১); জানা গেল পাকিস্তান আমলের বাকি তিনটি (আতাউর রহমান খান, ১৯৫৭; হামিদুর রহমান, ১৯৬৪ এবং নূর খান, ১৯৬৯) কমিশনের রিপোর্টও এ গ্রন্থাগারে ছিল; কিন্তু হারিয়ে গেছে! খুব কষ্ট পেলাম শুনে যে, এ হারানো প্রক্রিয়ায় ‘অবদান’ রেখেছেন ২০১০ সালের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ কমিটির সম্মানিত সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর। তার সঙ্গে কথা বললাম, তিনি নিজের চেয়ে তখনকার গ্রন্থাগারিককে বেশি দায়ী করলেন!
যা হোক, যা পাওয়া গেল তার প্রতিটির তিনটি করে কাগজের কপি (জাশিপাবোর জন্য দুটি, নিজের জন্য একটি) করালাম, সব স্ক্যান করে পিডিএফ তৈরি করা হলো। বেনবেইজের ওয়েবসাইটে পাওয়া বাংলাদেশ আমলের মফিজউদ্দিন কমিশন (১৯৮৮), শামসুল হক কমিটি (১৯৯৭) এবং মনিরুজ্জামান মিয়া কমিশন (২০০৩) রিপোর্টগুলোরও কাগজের কপি করা হলো। শিক্ষাক্রম ১৯৯৫-এর কাগজের কপিও স্ক্যান করে পিডিএফ তৈরি করা হলো। আমার এ কাজে ভেতর থেকে উৎসাহ জুগিয়েছেন বোর্ড সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ও ১৩তম বিসিএসের বন্ধু অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম এবং সদস্য (অর্থ) মির্জা তারিক হিকমত।
কাজ শেষ করে এনে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বললাম, মন্ত্রণালয়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এনে বিষয়টি উদ্বোধন করিয়ে উদযাপন করা যায়। তিনি বললেন, এসব দলিল তো থাকারই কথা (ছিল না, তা স্বীকার করা ঠিক মনে হয়নি!)। অগত্যা সন্তর্পণে কাগজের হার্ড কপিগুলো ৫ জানুয়ারি জাশিপাবোর গ্রন্থাগারে জমা করা হলো। পিডিএফ কপিগুলো পরিষ্কার করার কাজ করছেন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. মুনাব্বির হোসেন। কাজ শেষ হলে সব কপি জাশিপাবো, নায়েম, বেনবেইজ, এমনকি খোদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও আপলোড করা যেতে পারে। এতে সব দুষ্প্রাপ্য শিক্ষা দলিল সবার জন্য সহজপ্রাপ্য হয়ে যাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী করা হবে এসব শিক্ষা দলিল দিয়ে? নিউটনের কথা মেনে ঘাড় পর্যন্ত জ্ঞানের যে উচ্চতা তৈরি হয়ে আছে, তা মেনে এ অংশে বারবার নতুন করে হাত না দিয়ে বরং ভালোমতো পড়ে, বুঝে নতুন কিছু করার পথে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের আগে ‘বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণে’র অংশ হিসেবে আগের সব শিক্ষাক্রম দলিল স্টাডি করতে হবে। দলিলগুলো সংরক্ষণ এবং বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা প্রয়াত শিক্ষাক্রম গুরুকে সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে পারি।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক, প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক