ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য ও জাসদ রাজনীতির ইতিবৃত্ত

মহিউদ্দিন খান মোহন

বলা যায় বোমাই ফাটিয়েছেন তিনি। যার বিস্ফোরণে ক্ষমতাসীন মহলটি একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। শুরু হয়েছে চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি। আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে। সহৃদয় পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন বোমাটি কী ধরনের এবং কে তা ফাটিয়েছেন। হ্যাঁ এটা একটা ‘বক্তৃতা বোমা’ এবং তার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের ড্রাইভিং সীটে বসা দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গত ১৩ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগের এক সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সম্বন্ধে এমন কিছু উক্তি করেছেন, যা দেশের সর্বমহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। কেন এবং কি উদ্দেশ্যে সৈয়দ আশরাফ ১৪ দলের শরীক একটি দল সম্পর্কে এমন চাঁচাছোলা মন্তব্য করলেন, এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উঠেছে ঝড়। টিভি চ্যানেলগুলোর টক শো’তে চলছে নামমুখী বিশ্লেষণ। মোট কথা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

বক্তৃতায় সৈয়দ আশরাফ কী বলেছেন তা এখন সবাই জ্ঞাত। তাই এখানে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে সারসংক্ষেপে জাসদ সম্বন্ধে তার মন্তব্যের কিছুটা তুলে ধরা দরকার আলোচনার স্বার্থেই। সৈয়দ আশরাফ জাসদ সম্বন্ধে যা বলেছেন তাহলো, ১. জাসদ একটি হটকারী সংগঠন. ২. জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পরিকল্পিতভাবে ভিন্নখাতে পরিচালিত করেছে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ যাতে কোনোদিনই একটি কার্যকরি রাষ্ট্র হতে না পারে।

৩. জাসদ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সব পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। ৪. জাসদ সে সময় এ দেশটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল. ৫ যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিল তারা ছিল ভন্ড, শতভাগ ভন্ড। সৈয়দ আশরাফ তার এসব কথাকে ইতিহাসের স্মরণ বলে আখ্যায়িত করে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের এগুলো মনে রাখার আহবান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, সেই জাসদের একজনকে মন্ত্রী করা হয়েছে এর প্রায়শ্চিত আওয়ামী লীগকে আজীবন করতে হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ত্রিধা বিভক্ত জাসদে। দলটির সবগুলো খন্ড থেকেই সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়েছে। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেছেন, এ বির্তক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ঐক্যকে দুর্বল করবে। তিনি বলেছেন, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ আমরা যখন সম্পন্ন করছি, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে দুর্বল করবে। গত ১৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশে শিরীন আখতার আরো বলেন, জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতার এমন কথা বলা উচিত না, যাতে ঐক্য নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, শত্রু পক্ষ উৎসাহিত হতে পারে।

জাসদের আরেক খন্ডাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে একটি দৈনিককে বলেছেন ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হঠাৎ এমন বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তিনি যা বলেছেন, তা সত্য নয়, বিভ্রান্তিকর। তার বক্তব্যে সত্যকে আড়াল করা হয়েছে।’

আর জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আরেক খন্ডাংশ ‘জেএসডি’ সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। আওয়ামী লীগের দলীয় ভুল রাজনীতি বঙ্গবন্ধুকে দলীয় আবর্তে বন্দি করে, উপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ করে জনগণ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করে। ৩২ নং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে আওয়ামী লীগ নেতারাই মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় এবং সে সরকারই দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করে। এসব সত্য এবং ভুল রাজনীতি আওয়ামী লীগের স্বীকার না করাই হবে অতিমাত্রায় ভন্ডামি।
অপরদিকে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে দলের নয়, তার ব্যক্তিগত মতামত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

আর সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়।
এদিকে গত ১৫ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন ‘জাসদ যদি সেদিন গণবাহিনী করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা না করতো তাহলে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জাসদ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বিষয়টি ক্ষমতাসীন জোটে বেশ বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। জাসদ নেতারা (সব খন্ডের) আত্মপক্ষ সমর্থনের পাশাপাশি সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধেও কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তবে তা অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে। বোঝা যাচ্ছে তারা আহত হলেও কোনোরকমে ‘মলমপট্টি’ দিয়ে বেদনা উপশমের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে সরকারের অংশীদার জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তারা যে কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগের বগলদাবায় থেকে ক্ষমতার ‘হালুয়া রুটি’র আস্বাদ গ্রহণ অব্যাহত রাখতে চান। লক্ষণীয় বিষয় হলো সৈয়দ আশরাফ তার বক্তব্যের পক্ষে এখনো পর্যন্ত নিজ দলের কারো সমর্থন পান নি। বরং প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের ‘ওটা তার ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে মন্তব্য করায় এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এ বিতর্কে অংশ নেবে না বা এর দায় দায়িত্ব ও গ্রহণ করবে না। ফলে এ মন্তব্যের জন্য সৈয়দ আশরাফ কী পুরষ্কার-তিরস্কার দলনেত্রীর কাছ থেকে লাভ করেন সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তবে জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এ ধরনের মন্তব্য এটাই নতুন নয়। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এক শোকসভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছিলেন- ‘জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা কখনও বঙ্গবন্ধুর উপর আঘাত হানতে পারত না, যদি গণবাহিনী ও জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত।’ লক্ষণীয় বিষয় হলো-১০ মাস পরে ঠিকই একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সুতরাং, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন মন্তব্য নয়, বরং জাসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে চাপা ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠছে তারই বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেয়া যায়।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। দলটির জন্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ সব সময় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। কল্পিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মুখরোচক রাজনৈতিক চাটনী সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের উঠতি তরুণ যুকদের মুখে তুলে দিয়ে তারা একটি আলোড়ন অবশ্য তুলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর বাইরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠনের নেপথ্যে যারা ছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দ্বিতীয় বছরে তাদেরই পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় জাসদ গঠিত হয়। জাসদের অঙ্কুরোদগম বা ভ্রুন সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দাল থেকে। ‘দাদা ভাই’ নামে পরিচিত তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের ‘অতি বাম’ নীতি ছাত্রলীগকে দ্বিধা বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। যার কারণে ১৯৭২ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুইটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দুই প্যানেলে ছাত্রলীগের ভোট ভাগাভাগি হওয়ার কারণে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন। সিরাজুল আলম খানপন্থীরা ডাকসুও হল সংসদে চৌদ্দটি আসন পায়। ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙ্গে একই বছরের জুলাই মাসে। ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপ ২১-২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অ স ম রবের গ্রুপ পল্টন ময়দানে আর নুরে আলম সিদ্দিকী-আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন আহ্বান করে। উভয় গ্রুপই শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেরটা উদ্বোধন করেন। ফলে ২১ জুলাই ১৯৭২ তারিখেই ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। এক গ্রুপের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ এবং অপর গ্রুপে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-সংক্ষেপে জাসদ গঠিত হয়। সিরাজুল আলম খান নেপথ্যে থেকে সমস্ত কলকাঠি নাড়লেও দলে তিনি প্রকাশ্যে আসলেন না। নতুন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক করা হলো মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল (অব) এবং আ স ম আবদুর রবকে।

একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেজর জলিলকে সভাপতি, আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক ও শাহজাহান সিরাজকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এরপর নবগঠিত জাসদ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং একটি মাত্র আসনে জয় লাভ করে।

একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবেই জন্ম হয়েছিল জাসদের। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এক উদ্ভট তত্ত্ব প্রচার করলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিই ছিল তাদের রাজনৈতিক লাইন। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ সে লাইনচ্যুত হয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। মূলত তাদের পর্দার অন্তরালের তাত্ত্বিক নেতার অতি বিপ্লবী চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা দলটিকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পন্থা বাদ দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে দেশে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী গ্রহণ করে জাসদ সর্বনাশের কূপে পা রাখে। মুলত ১৯৭৪ সাল থেকেই জাসদের রাজনীতিতে এ পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়ার এক পর্যায়ে গঠিত হয় গোপন সংগঠন গণবাহিনী। এ বাহিনীই শেষ পর্যন্ত জাসদের জন্য ‘মরণ ফাঁদ’ হিসেবে দেখা দেয়।

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা ছিল। সভার শেষে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী না থাকলেও জাসদ নেতা-কর্মীরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে। এ সময় সেখানে কয়েক ট্রাক পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী এসে উপস্থিত হয়। হঠাৎ শুরু হয় গোলাগুলি। এতে সরকারি হিসেবে ১৭জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়। যদিও নিহতের সংখ্যা ৫০ বলে দাবি করেছিল জাসদ। ওই দিন রাতেই জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ অফিস তছনছ করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় এর সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে।

চুয়াত্তরের ১৭ মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের অভ্যন্তরে পরবর্তীতে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি ‘গ্রন্থে লিখেছেন- “১৭ মার্চের মিছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়। প্রথম প্রশ্ন ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি কেন ঘেরাও করতে হবে, গণভবন নয় কেন ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো-প্রথম গুলি কারা ছুড়েছে। জাসদের পক্ষ থেকেই প্রথম গুলি ছোড়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এটা ছিল দলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার একটি অংশ। পরিকল্পনাটি সফল হয়। এ প্রসঙ্গে জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর ভাষ্য এরকম : মমতাজ (মমতাজ বেগম জাসদের কেন্দ্রীয় মহিলা সম্পাদক ও হাবিবুল্লাহর স্ত্রী) আমারে কইছিল, গুলি প্রথমে আমরার লোকেরাই করছিল।  পরে মে মাসে আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ের তিনতলায় তিনদিন বৈঠক হয়। প্রথমে শুনলাম গুলি করছে হাবিবুল হক বেনু। পরে জানলাম এইডা হাসানুল হক ইনুর কাম।” (পৃষ্ঠা-১১৩)

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে জাসদ তার গোপন  সংগঠন গণবাহিনী গড়ে তোলে। মেজর জিয়া নামে একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা কমান্ডার তার আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। বর্তমান ১৪ দলীয় জোট সরকারের আরেক মন্ত্রী নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান ছিলেন গণবাহিনীর মাদারীপুর শাখার কমান্ডার।

মূলতঃ গণবাহিনী গঠন করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুজিব সরকারকে উৎখাতের লাইন গ্রহণ করেই জাসদ সর্বনাশের পথে পা দেয়। এই গণবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের এমপি-নেতাদের হত্যা করে। বহুস্থানে তারা রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গণবাহিনীকে কঠোর হাতে দমনের পদক্ষেপ নেয়। ফলে রক্ষী বাহিনীর হাতে কয়েক হাজার জাসদ কর্মী-বেঘোরে প্রাণ হারায়। এ সবই ছিল জাসদের হঠকারী রাজনীতি ও তার বিষময় ফল।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও জাসদের হঠকারী রাজনীতি বন্ধ হয়নি। বরং ভিন্ন কায়দায় তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের নীলনকশা এঁকেছিল। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সে নীলনকশা বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলীর সুযোগ নিয়ে জাসদ ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। এ কাজে কর্নেল তাহের তৎকালীন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জিয়া ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। কর্নেল তাহের জিয়ার সে ইমেজকে ব্যবহার করে নিজের পরিকল্পনা সফল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বুদ্ধিমত্তা ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করে দেয়।

এর পর জাসদ আরেকটি হঠকারী পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর তারা ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ভারতীয় হাই কমিশন আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণ ও জিম্মি করে সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করা। এ অপহরণ পরিকল্পনার মূলে ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর কমান্ডার ও কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। যিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগের একজন বড়মাপের বরকন্দাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তার গঠিত সুইসাইড স্কোয়াড- যেটাতে তার আরেক ছোট ভাই-ওয়ারেসাত হোসেন বেলালও (বর্তমানে এমপি) ছিলেন। হাই কমিশনার সমরসেনকে অপহরণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিরাপত্তা রক্ষীদের ব্রাশ ফায়ারে ঘটনাস্থলেই দলনেতা বাহারসহ চারজন নিহত হয়। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন বেলাল ও সবুজ) মহিউদ্দিন আহমদের উল্লিখিত গ্রন্থ পৃষ্ঠা-২০৯)।

মূলতঃ স্বাধীনতার অব্যবহতি পরেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মধ্য দিয়ে যে জাসদের অভূদ্যয়, তার পরিণতি খুব একটা সুখকর হয়নি। প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক লাইন পরিবর্তন এবং সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় না রেখে হঠকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে অতি বিপ্লবী সাজার চেষ্টা এ দলটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দলটি তখন কয়েকটি ক্ষুদ্রাংশে পরিণত হয়েছে। হঠকারী রাজনীতি যে কখনোই সফলতার মুখ দেখে না জাসদ তার অতি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কেন জাসদ সম্বন্ধে এমন নির্মম সত্য উচ্চারণ করলেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন। তবে, তার এ বক্তব্য যে একটি ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। জাসদ নেতৃবৃন্দ যতোই বলুন তারা ‘বঙ্গবঙ্গ কন্যা’র কর্মসূচী বাস্তবায়নে প্রাণপাত চেষ্টা করছেন, তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের বর্তমান গাঁটছড়া যে শুধুই ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ পাওয়ার জন্য সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সে হালুয়া-রুটির ভাগ নিশ্চিত ও নিরবচ্ছিন্ন করার জন্যই ‘মহাজোট’ সরকারে থাকা জাসদীয় মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনবরত অশালীন অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থায় দৃষ্টে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোধকরি বেগম খালেদা জিয়া সম্বন্ধে অশালীন কটুক্তি করার জন্য ওই মন্ত্রীজীকে বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান এখনো জানা যায় নি। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে কীভাবে নেন তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। এদিকে অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাতে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসতে পারে এমন একটা গুঞ্জন রয়েছে। যারা সেটা চান তারা এ বক্তব্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার মওকা পাবেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে এটা বোঝাতে পারবেন যে, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য মহাজোটে অনৈক্য সৃষ্টি করবে এবং তা সরকারের জন্য মহাসর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। নেত্রী যদি তাদের কথা আমলে নেন তাহলে সৈয়দ আশরাফের ভাগ্য বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য ও জাসদ রাজনীতির ইতিবৃত্ত

আপডেট টাইম : ০১:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ অগাস্ট ২০১৬

মহিউদ্দিন খান মোহন

বলা যায় বোমাই ফাটিয়েছেন তিনি। যার বিস্ফোরণে ক্ষমতাসীন মহলটি একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। শুরু হয়েছে চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি। আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে। সহৃদয় পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছেন বোমাটি কী ধরনের এবং কে তা ফাটিয়েছেন। হ্যাঁ এটা একটা ‘বক্তৃতা বোমা’ এবং তার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের ড্রাইভিং সীটে বসা দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গত ১৩ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগের এক সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সম্বন্ধে এমন কিছু উক্তি করেছেন, যা দেশের সর্বমহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। কেন এবং কি উদ্দেশ্যে সৈয়দ আশরাফ ১৪ দলের শরীক একটি দল সম্পর্কে এমন চাঁচাছোলা মন্তব্য করলেন, এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উঠেছে ঝড়। টিভি চ্যানেলগুলোর টক শো’তে চলছে নামমুখী বিশ্লেষণ। মোট কথা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

বক্তৃতায় সৈয়দ আশরাফ কী বলেছেন তা এখন সবাই জ্ঞাত। তাই এখানে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে সারসংক্ষেপে জাসদ সম্বন্ধে তার মন্তব্যের কিছুটা তুলে ধরা দরকার আলোচনার স্বার্থেই। সৈয়দ আশরাফ জাসদ সম্বন্ধে যা বলেছেন তাহলো, ১. জাসদ একটি হটকারী সংগঠন. ২. জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পরিকল্পিতভাবে ভিন্নখাতে পরিচালিত করেছে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ যাতে কোনোদিনই একটি কার্যকরি রাষ্ট্র হতে না পারে।

৩. জাসদ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সব পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। ৪. জাসদ সে সময় এ দেশটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল. ৫ যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিল তারা ছিল ভন্ড, শতভাগ ভন্ড। সৈয়দ আশরাফ তার এসব কথাকে ইতিহাসের স্মরণ বলে আখ্যায়িত করে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের এগুলো মনে রাখার আহবান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, সেই জাসদের একজনকে মন্ত্রী করা হয়েছে এর প্রায়শ্চিত আওয়ামী লীগকে আজীবন করতে হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ত্রিধা বিভক্ত জাসদে। দলটির সবগুলো খন্ড থেকেই সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়েছে। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেছেন, এ বির্তক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ঐক্যকে দুর্বল করবে। তিনি বলেছেন, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ আমরা যখন সম্পন্ন করছি, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে তথ্যমন্ত্রী যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখন এই ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করবে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে দুর্বল করবে। গত ১৪ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশে শিরীন আখতার আরো বলেন, জাতীয় পর্যায়ের কোনো নেতার এমন কথা বলা উচিত না, যাতে ঐক্য নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, শত্রু পক্ষ উৎসাহিত হতে পারে।

জাসদের আরেক খন্ডাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে একটি দৈনিককে বলেছেন ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হঠাৎ এমন বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তিনি যা বলেছেন, তা সত্য নয়, বিভ্রান্তিকর। তার বক্তব্যে সত্যকে আড়াল করা হয়েছে।’

আর জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আরেক খন্ডাংশ ‘জেএসডি’ সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। আওয়ামী লীগের দলীয় ভুল রাজনীতি বঙ্গবন্ধুকে দলীয় আবর্তে বন্দি করে, উপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ করে জনগণ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করে। ৩২ নং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে আওয়ামী লীগ নেতারাই মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় এবং সে সরকারই দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করে। এসব সত্য এবং ভুল রাজনীতি আওয়ামী লীগের স্বীকার না করাই হবে অতিমাত্রায় ভন্ডামি।
অপরদিকে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে দলের নয়, তার ব্যক্তিগত মতামত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

আর সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়।
এদিকে গত ১৫ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন ‘জাসদ যদি সেদিন গণবাহিনী করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা না করতো তাহলে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জাসদ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বিষয়টি ক্ষমতাসীন জোটে বেশ বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। জাসদ নেতারা (সব খন্ডের) আত্মপক্ষ সমর্থনের পাশাপাশি সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধেও কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তবে তা অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে। বোঝা যাচ্ছে তারা আহত হলেও কোনোরকমে ‘মলমপট্টি’ দিয়ে বেদনা উপশমের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে সরকারের অংশীদার জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তারা যে কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগের বগলদাবায় থেকে ক্ষমতার ‘হালুয়া রুটি’র আস্বাদ গ্রহণ অব্যাহত রাখতে চান। লক্ষণীয় বিষয় হলো সৈয়দ আশরাফ তার বক্তব্যের পক্ষে এখনো পর্যন্ত নিজ দলের কারো সমর্থন পান নি। বরং প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের ‘ওটা তার ব্যক্তিগত অভিমত’ বলে মন্তব্য করায় এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এ বিতর্কে অংশ নেবে না বা এর দায় দায়িত্ব ও গ্রহণ করবে না। ফলে এ মন্তব্যের জন্য সৈয়দ আশরাফ কী পুরষ্কার-তিরস্কার দলনেত্রীর কাছ থেকে লাভ করেন সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তবে জাসদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এ ধরনের মন্তব্য এটাই নতুন নয়। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এক শোকসভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছিলেন- ‘জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা কখনও বঙ্গবন্ধুর উপর আঘাত হানতে পারত না, যদি গণবাহিনী ও জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত।’ লক্ষণীয় বিষয় হলো-১০ মাস পরে ঠিকই একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সুতরাং, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন মন্তব্য নয়, বরং জাসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে চাপা ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠছে তারই বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেয়া যায়।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। দলটির জন্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ সব সময় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। কল্পিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মুখরোচক রাজনৈতিক চাটনী সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের উঠতি তরুণ যুকদের মুখে তুলে দিয়ে তারা একটি আলোড়ন অবশ্য তুলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর বাইরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠনের নেপথ্যে যারা ছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দ্বিতীয় বছরে তাদেরই পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় জাসদ গঠিত হয়। জাসদের অঙ্কুরোদগম বা ভ্রুন সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দাল থেকে। ‘দাদা ভাই’ নামে পরিচিত তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের ‘অতি বাম’ নীতি ছাত্রলীগকে দ্বিধা বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়। যার কারণে ১৯৭২ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুইটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দুই প্যানেলে ছাত্রলীগের ভোট ভাগাভাগি হওয়ার কারণে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন। সিরাজুল আলম খানপন্থীরা ডাকসুও হল সংসদে চৌদ্দটি আসন পায়। ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙ্গে একই বছরের জুলাই মাসে। ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপ ২১-২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অ স ম রবের গ্রুপ পল্টন ময়দানে আর নুরে আলম সিদ্দিকী-আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন আহ্বান করে। উভয় গ্রুপই শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেরটা উদ্বোধন করেন। ফলে ২১ জুলাই ১৯৭২ তারিখেই ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। এক গ্রুপের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ এবং অপর গ্রুপে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-সংক্ষেপে জাসদ গঠিত হয়। সিরাজুল আলম খান নেপথ্যে থেকে সমস্ত কলকাঠি নাড়লেও দলে তিনি প্রকাশ্যে আসলেন না। নতুন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক করা হলো মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল (অব) এবং আ স ম আবদুর রবকে।

একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেজর জলিলকে সভাপতি, আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক ও শাহজাহান সিরাজকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এরপর নবগঠিত জাসদ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং একটি মাত্র আসনে জয় লাভ করে।

একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবেই জন্ম হয়েছিল জাসদের। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এক উদ্ভট তত্ত্ব প্রচার করলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিই ছিল তাদের রাজনৈতিক লাইন। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ সে লাইনচ্যুত হয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। মূলত তাদের পর্দার অন্তরালের তাত্ত্বিক নেতার অতি বিপ্লবী চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা দলটিকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পন্থা বাদ দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে দেশে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী গ্রহণ করে জাসদ সর্বনাশের কূপে পা রাখে। মুলত ১৯৭৪ সাল থেকেই জাসদের রাজনীতিতে এ পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়ার এক পর্যায়ে গঠিত হয় গোপন সংগঠন গণবাহিনী। এ বাহিনীই শেষ পর্যন্ত জাসদের জন্য ‘মরণ ফাঁদ’ হিসেবে দেখা দেয়।

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা ছিল। সভার শেষে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী না থাকলেও জাসদ নেতা-কর্মীরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে। এ সময় সেখানে কয়েক ট্রাক পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী এসে উপস্থিত হয়। হঠাৎ শুরু হয় গোলাগুলি। এতে সরকারি হিসেবে ১৭জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়। যদিও নিহতের সংখ্যা ৫০ বলে দাবি করেছিল জাসদ। ওই দিন রাতেই জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ অফিস তছনছ করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় এর সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে।

চুয়াত্তরের ১৭ মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের অভ্যন্তরে পরবর্তীতে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি ‘গ্রন্থে লিখেছেন- “১৭ মার্চের মিছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়। প্রথম প্রশ্ন ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি কেন ঘেরাও করতে হবে, গণভবন নয় কেন ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো-প্রথম গুলি কারা ছুড়েছে। জাসদের পক্ষ থেকেই প্রথম গুলি ছোড়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এটা ছিল দলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার একটি অংশ। পরিকল্পনাটি সফল হয়। এ প্রসঙ্গে জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর ভাষ্য এরকম : মমতাজ (মমতাজ বেগম জাসদের কেন্দ্রীয় মহিলা সম্পাদক ও হাবিবুল্লাহর স্ত্রী) আমারে কইছিল, গুলি প্রথমে আমরার লোকেরাই করছিল।  পরে মে মাসে আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ের তিনতলায় তিনদিন বৈঠক হয়। প্রথমে শুনলাম গুলি করছে হাবিবুল হক বেনু। পরে জানলাম এইডা হাসানুল হক ইনুর কাম।” (পৃষ্ঠা-১১৩)

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে জাসদ তার গোপন  সংগঠন গণবাহিনী গড়ে তোলে। মেজর জিয়া নামে একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা কমান্ডার তার আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। বর্তমান ১৪ দলীয় জোট সরকারের আরেক মন্ত্রী নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান ছিলেন গণবাহিনীর মাদারীপুর শাখার কমান্ডার।

মূলতঃ গণবাহিনী গঠন করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুজিব সরকারকে উৎখাতের লাইন গ্রহণ করেই জাসদ সর্বনাশের পথে পা দেয়। এই গণবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের এমপি-নেতাদের হত্যা করে। বহুস্থানে তারা রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গণবাহিনীকে কঠোর হাতে দমনের পদক্ষেপ নেয়। ফলে রক্ষী বাহিনীর হাতে কয়েক হাজার জাসদ কর্মী-বেঘোরে প্রাণ হারায়। এ সবই ছিল জাসদের হঠকারী রাজনীতি ও তার বিষময় ফল।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও জাসদের হঠকারী রাজনীতি বন্ধ হয়নি। বরং ভিন্ন কায়দায় তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের নীলনকশা এঁকেছিল। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সে নীলনকশা বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার। ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলীর সুযোগ নিয়ে জাসদ ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। এ কাজে কর্নেল তাহের তৎকালীন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জিয়া ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। কর্নেল তাহের জিয়ার সে ইমেজকে ব্যবহার করে নিজের পরিকল্পনা সফল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বুদ্ধিমত্তা ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করে দেয়।

এর পর জাসদ আরেকটি হঠকারী পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর তারা ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ভারতীয় হাই কমিশন আক্রমণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণ ও জিম্মি করে সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করা। এ অপহরণ পরিকল্পনার মূলে ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর কমান্ডার ও কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। যিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগের একজন বড়মাপের বরকন্দাজ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তার গঠিত সুইসাইড স্কোয়াড- যেটাতে তার আরেক ছোট ভাই-ওয়ারেসাত হোসেন বেলালও (বর্তমানে এমপি) ছিলেন। হাই কমিশনার সমরসেনকে অপহরণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিরাপত্তা রক্ষীদের ব্রাশ ফায়ারে ঘটনাস্থলেই দলনেতা বাহারসহ চারজন নিহত হয়। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন বেলাল ও সবুজ) মহিউদ্দিন আহমদের উল্লিখিত গ্রন্থ পৃষ্ঠা-২০৯)।

মূলতঃ স্বাধীনতার অব্যবহতি পরেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মধ্য দিয়ে যে জাসদের অভূদ্যয়, তার পরিণতি খুব একটা সুখকর হয়নি। প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক লাইন পরিবর্তন এবং সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় না রেখে হঠকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে অতি বিপ্লবী সাজার চেষ্টা এ দলটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দলটি তখন কয়েকটি ক্ষুদ্রাংশে পরিণত হয়েছে। হঠকারী রাজনীতি যে কখনোই সফলতার মুখ দেখে না জাসদ তার অতি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কেন জাসদ সম্বন্ধে এমন নির্মম সত্য উচ্চারণ করলেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন। তবে, তার এ বক্তব্য যে একটি ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। জাসদ নেতৃবৃন্দ যতোই বলুন তারা ‘বঙ্গবঙ্গ কন্যা’র কর্মসূচী বাস্তবায়নে প্রাণপাত চেষ্টা করছেন, তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের বর্তমান গাঁটছড়া যে শুধুই ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ পাওয়ার জন্য সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সে হালুয়া-রুটির ভাগ নিশ্চিত ও নিরবচ্ছিন্ন করার জন্যই ‘মহাজোট’ সরকারে থাকা জাসদীয় মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনবরত অশালীন অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থায় দৃষ্টে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোধকরি বেগম খালেদা জিয়া সম্বন্ধে অশালীন কটুক্তি করার জন্য ওই মন্ত্রীজীকে বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান এখনো জানা যায় নি। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে কীভাবে নেন তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। এদিকে অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাতে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসতে পারে এমন একটা গুঞ্জন রয়েছে। যারা সেটা চান তারা এ বক্তব্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার মওকা পাবেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে এটা বোঝাতে পারবেন যে, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য মহাজোটে অনৈক্য সৃষ্টি করবে এবং তা সরকারের জন্য মহাসর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। নেত্রী যদি তাদের কথা আমলে নেন তাহলে সৈয়দ আশরাফের ভাগ্য বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন।