।। সাদিয়া নাসরীন ।।
প্রিয় পুত্র আমার,
তোমার এবং বিশ্বের সকল পুত্র সন্তানের কাছে এই চিঠি আমার স্বীকারোক্তি হয়ে পৌঁছুবে, যেখানে তুমি বুঝবে কিভাবে পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়েছ তুমি দিনের পর দিন ধরে। এমন সময়ে তোমার কাছে আমার এই বার্তা পৌঁছুবে, যখন তুমি চারপাশে নারী নিপিড়নের ভয়াবহতা দেখে আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে যাবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্য আর আগ্রাসন দেখে হয়তো নিজেকে পুরুষ ভাবতে অস্বস্তি হবে তোমার। তুমি দেখবে, বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় এই বিশ্বে এখনো কন্যাদের জন্য, নারীদের জন্য আলাদা দিবস পালন করা হয়! সেই একদিনের দিবস দেখেই তুমি বুঝতে পারবে বছরের আর বাকি সব দিন তোমার। তুমি বড় হতে হতে বুঝতে পারবে কিভাবে একটি লিঙ্গের ভেতর আটকে ফেলছি তোমাকে আমরা যেখানে আস্ত একটা পুরুষ মানুষ হয়ে উঠছো তুমি।
তোমার তুমি যেদিন ভ্রূণ হয়ে এলে, সেদিন মাতৃত্ব-পিতৃত্বের আনন্দ বুঝে উঠার আগেই আমরা অধীর হয়ে ছিলাম তোমার লিঙ্গ চিন্তা করে। কারণ, তোমার লিঙ্গ পরিচয়ের ওপর আমাদের সামাজিক অবস্থান নির্ভর করে কিনা! নয় মাসের প্রতিটা মুহূর্ত আমি তোমার নড়াচড়া অনুভব করেই তোমার লিঙ্গ বুঝতে চাইতাম। মুখে যাই বলি না কেন, আমি জানতাম তুমি, মানে একটা না দেখা পুত্রসন্তানই আমার সংসারটা নিরাপদ আর টেকসই করে তুলবে। এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তুমি হয়ে উঠেছিলে আমার ভাগ্যবিধাতা। আমার জঠরে তোমাকে ধারণ করেও আমি আমার সবকিছু সমর্পন করে বসেছিলাম তোমার লিঙ্গের কাছে।
তোমার জন্মের সাথে সাথেই আমি এবং আমরা তোমার লিঙ্গের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তোমার নাম দিয়ে দিলাম ‘পুত্র’। তোমার কানে জোরে আজান দিয়ে জানিয়ে দিলাম তুমি ‘পুত্র’। পৃথিবীর সমুদয় শক্তির সাথে মিল রেখে তোমার নামকরণ করে জানিয়ে দিলাম তুমি ‘পুত্র’। একটি লিঙ্গের ভেতর বন্দি করে তোমাকে মানুষ করার বদলে পুরুষ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা এখান থেকেই। গর্ব ভরে তোমার লিঙ্গ খোলা রেখেছি। তোমাকে লজ্জা আর পরিশীলতার শিক্ষা আমি দিইনি। বরং বলেছি- তোমার কাম-ক্ষুদা নিয়ন্ত্রণে কন্যারা ‘পরিশীলিত’ থাকবে। তোমাকে বলেছি, তোমার লিঙ্গের কোনো লজ্জা নেই। তোমাকে জনসম্মুখে উলঙ্গ করতে আমি লজ্জা পাইনি, আদর করার ছলে তোমার লিঙ্গ নিয়ে খেলা করেছি, গর্ব বোধ করেছি।
পুত্র আমার! তুমি একদিন বুঝতে পারবে, লিঙ্গ নিয়ে বিশ্বব্যাপি যে নির্লজ্জ রাজনীতি চলেছে, তার শিকার শুধু নারী হয়নি, তুমিও হয়েছো। লিঙ্গ রাজনীতি তোমাকে এনে ফেলেছে সভ্যতার এমন তলায়, যেখান থেকে তুমি আর মানুষ হয়ে উপরে উঠে আসতে পারোনি। প্রকৃতির করুণায় পাওয়া এক লিঙ্গের জন্য আমরা তোমাকে ইশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতা দিয়েছি। আমাদের হাত ধরেই সে ক্ষমতার চর্চা করেছ তুমি। তোমার লিঙ্গে ঘুঙ্গুর পড়িয়ে উৎসব করেছি, তোমার লিঙ্গ কাটার জন্য মহা সমারোহে উৎসব করেছি। তোমার লিঙ্গ পুজা করেছি। লিঙ্গ তোমাকে এমন নির্ভয় করেছে যে, তুমি চাইলেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিসু করতে পারো, নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটতে পারো, যেখানে সেখানে উদ্যত হতে পারো। এমনকি প্রয়োজনে অন্যকে ভয় দেখাতেও পারো এই লিঙ্গ দিয়েই। তুমি জেনে গেলে তোমার লিঙ্গের অপ্রিসীম ক্ষমতার কথা। তোমার শরীরের এই প্রত্যঙ্গটিকে তুমি অস্ত্র হিসেবে একসময় তাক করলে নারীর দিকেই।
তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছি আমরা, কন্যা আর পুত্র এই পৃথিবী সমানভাবে ভোগ করতে পারবে না। জন্মের পরই তোমার জন্য দুটো খাসি জবাই করে আকিকা করে জানিয়ে দিলাম তুমি ‘পুত্র’, আর কন্যা সন্তানের জন্য একটা খাসি। ‘স্ত্রীলিঙ্গ’ কথাটি কতটুকু অবমাননার তা আমরাই তোমাকে বুঝিয়েছি চোখের সামনে কন্যা শিশু জীবন্ত কবর দিয়ে। তুমি জেনেছো, কন্যা সন্তান বেঁচে থাকে পিতার দয়ায়। আমিই তোমার কানে কানে বলে এসেছি কন্যারা অপবিত্র, অচ্ছ্যুত। তাদের জন্মে আজান দিতে হয় নিচুস্বরে। তোমাকে বলেছি, তোমার পবিত্রতায় কন্যারা নিজেদের রজঃ লুকিয়ে রাখবে, তোমার জন্য কন্যারা তাদের ‘সতীত্ব’ রক্ষা করবে। তোমাকে বলেছি, তোমার জন্য আজীবন সহমরণের চিতায় পুড়তে প্রস্তুত আছে কন্যারা, সাদা থানে জীবনের রঙ লুকিয়ে রাখবে কন্যারা তোমার জন্য ।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তোমার জন্য এমন স্কুলিং করেছি, যেখানে তুমি এবং তোমার বোন সম্পূর্ণ বিপরীত পাঠ পেয়েছো। তোমাকে বলেছি, ওই বারবি পুতুল আর রান্না রান্না খেলা তোমার নয়। তোমার জন্য আছে ফুটবল, পিস্তল। তোমার পাতে মাছের মুড়োটা পড়ে, কপালে ফুল চন্দন পড়ে। তোমার বোন যখন রান্না-বান্নার তালিম নেয়, ঠিক তুমি বিছানাটা এলোমেলো করে যাও। আর আমরা আমি খুশি হয়ে ভেবেছি আমাদের সন্তান পুরুষ হয়ে উঠলো বলে! আমরাই বলেছি, তোমার হাতে লাঠি মানায়, ঘরের ঝাড়ু নয়। ক্ষমা করো প্রিয় পুত্র, তোমাকে আমরাই বলেছি, কেঁদো না, হার স্বীকার করো না, দুঃখকে স্বীকার করো না। তোমাকে বলেছি, পুরুষ পাথর হও, আগুন হও, কঠোর হও। তোমাকে বলেছি, কোমলতা পুরুষকে মানায় না, চোখের জলে পৌরুষ থাকে না, আপোষ পুরুষের জন্য নয়।
তোমার বোনটি যখন নিজের শরীর আর অস্তিত্বের ভার নিয়ে বিব্রত, লজ্জিত হয়ে উঠার প্রথম পাঠ নিচ্ছিল, ঠিক তখন তুমি পাঠ নিচ্ছিলে এক লিঙ্গের জোরে ‘বাদশা’ হওয়ার। আমরা তোমাকে বলেছি, ‘কন্যা’ নামে এই গ্রহে এক প্রজাতি আছে যারা মাংস আর লিঙ্গ বৈ আর কিছু নয়। পুরুষের সমাজে আমাদের কন্যাকে যখন অবাঞ্ছিত, অসহায়, অধস্তন করে রাখছিলাম, সেই সময়টাতেই তুমি হয়ে উঠছিলে সমাজের একেশ্বর। তোমাকে বলেছি কন্যা হবে তোমার অর্ধাঙ্গিনি, তোমার শয্যাসঙ্গিনী, তোমার শস্যক্ষেত্র। আমরা দিয়েছি তোমাকে প্রেম ও শরীরের একচ্ছত্র মালিকানা আর অবাধ যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতা। তুমি পুরুষ হয়ে উঠেছো, ভোগ করেছো, সম্ভোগে মেতেছো, জোর করেছো, অত্যাচার করেছো।
আমরাই তোমাকে শিখিয়েছি ‘আমি পুরুষ’ এই কথাটি কতটুকু গর্বের! আমরাই তোমার কাছে নারীকে ‘নিচু জাত’, বলে প্রতিষ্ঠিত করেছি। নারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যেদিন থেকে ‘প্রথম’ আর ‘দ্বিতীয়’ শ্রেণির লৈঙ্গিক বিভাজনের রাজনীতির ঢাল হিসেবে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি ‘ধর্ম’কে। এই ধর্ম তোমাকে বলেছে, নারী শয়তানের ফাঁদ, নারী দোজকের কাঠ, নারী দেখলেই পুরুষের ধ্যান নষ্ট হয়। নারী তোমার পাজরের বাঁকা হাড় থেকে তৈরি হয়েছে, তাকে নিত্য শাসনে রাখা তোমার কর্তব্য। আমরাই তোমার ভেতরে তৈরি করেছি এমন এক চেতনা, যে চেতনায় তুমি নিজেকে ভেবেছো কর্তা, নারীকে কর্ম। তোমার হাতে তুলে দিয়েছি মানুষকে মাপার মানদণ্ড আমরা, যে মানদণ্ডে তুমি ‘শুভ’ হয়েছো, ‘প্রভু’ হয়েছো আর কন্যা হয়ছে অশুভ, দাসি।
পুত্র আমার! আমরা তোমাকে দিয়েছি, এই পৃথিবীর আলো বাতাস, ইহকাল, পরকাল, সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান সবটাতেই অপার আধিপত্য। বলেছি তুমি চাওয়া মাত্র পাবে সবকিছু। তোমার জন্য আমরা রচনা করেছি সমগ্র বিশ্বসম্ভার। তোমার জন্য অবারিত করেছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, আকাঙ্ক্ষা আর উচ্চাভিলাষের অধিকার। এই উচ্চাভিলাষে তুমি রাজ্য জয় করেছো, মহাদেশ আবিষ্কার করেছো, পৃথিবীর মানচিত্র বদলেছো, ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেছো। আমি তোমাকে গড়েছি শক্তিধর, পরাক্রমশালী করে। আমি তোমাকে বলেছি তুমি বাদশা, এই পৃথিবী, নারী, সমাজ, পরিবার, ধর্ম সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে তুমি। তারপর এভাবেই একদিন তুমি দেখবে তুমি তলিয়ে গেছো লিঙ্গ রাজনীতির চোরাবালিতে।
ক্রমশ পুরুষ হয়ে উঠতে উঠতে তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারবে তোমার হাতেই আছে একজন মানুষকে ‘নারী’ করে তোলার নিরঙ্কুশ অধিকার। নারীকে তুমি নিয়ন্ত্রণ করবে, শোষণ করবে, দমন করবে, বঞ্চিত করবে, উপেক্ষা করবে, নির্যাতন করবে, ধর্ষণ করবে। তুমি নারীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে পরিবারের নামে, মাতৃত্বের নামে, সমাজের নামে, চরিত্রের নামে, বিজ্ঞানের নামে, সভ্যতার নামে, ধর্মের নামে, ধর্মগ্রন্থের নামে, ঈশ্বরের নামে। কখনো নারীকে তুমি রক্ষাও করবে পিতা হয়ে, স্বামী হয়ে এবং পুত্র হয়ে। তুমি নারীর অধিকার সুরক্ষায় সনদে স্বাক্ষর করবে, নীতি প্রণয়ন করবে। এত সব ইনভলবমেন্ট তোমাকে সমাজে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। শুধু নিম্ন থেকে আরো নিম্নতর হতে থাকবে যার জন্য তুমি এত সব করছো তার অবস্থান। কারণ ততদিনে পুত্র-আর কন্যার বৈষম্য, বঞ্চনা আর অবিশ্বাসের পরিধি। কঠিন হয়ে যাবে সমতার ক্ষেত্র তৈরি।
প্রিয় পুত্র, তবু হতাশ হয়ো না তুমি। একদিন এই বিশ্ব বদলাবে। এই বদল ঘটাবে তোমরাই। লিঙ্গ রাজনীতির চোরাগলি পেরিয়ে, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষ হয়ে আলোর মহাসড়কে আসবে তোমারা, আমাদের পুত্ররা। কন্যারা তৈরি হচ্ছে। তোমরাও প্রস্তুত হও।
একদিন আমাদের পুত্র কন্যারা ‘মানুষ’ হয়ে মানবতার মিছিলে এসে সাম্যের গান গাইবে এক সুরে। হাজার বছরের লিঙ্গ রাজনীতির মসনদ গুড়িয়ে দিয়ে একদিন মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠবে এই বিশ্বে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি,
পুরুষতন্ত্রের শিকার ‘মা-বাবা’
লেখকঃ প্রধান নির্বাহীঃ সংযোগ বাংলাদেশ